যুদ্ধ নিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার। যত নিচের স্তরের দ্বন্দ্ব, সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই লড়ে। যুদ্ধ যত উচ্চস্তরে পৌঁছয়, তত যাঁরা সিদ্ধান্ত নেন আর যাঁরা লড়েন, সেই মানুষগুলো আলাদা হয়ে যান। জমিজমা নিয়ে লড়াইয়ের কথা মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়। প্রতিবেশী থেকে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই। সেই মারামারিতে প্রাণহানির মত ঘটনাও ঘটে। এর থেকে লড়াইয়ের উচ্চতা বাড়লে তা পৌঁছে যায় পঞ্চায়েতে। তখন দুই পঞ্চায়েত প্রধানের মারামারি, বা সময়ের লেখচিত্রে একটু পিছিয়ে তাকালে দুই জমিদারের। সেখানে পরস্পরবিরোধী প্রধানদের হাতাহাতির সম্ভাবনা কমতে থাকে। বরং লড়াই চলে তাঁদের চেলা-চামুণ্ডাদের মধ্যেই। জমিদার তামাকু সেবন করেন, নায়েব-গোমস্তারা আদেশ দেন, লাঠিয়ালেরা মাথা ফাটান। তবে সেক্ষেত্রে যাঁরা কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁদের অন্তত ধারেকাছে পাওয়া যায়।
কারখানার লড়াই আর এক ধরনের। সেখানে মজুরদের নেতার সঙ্গে কারখানার মালিকের দ্বন্দ্ব। মারামারি করে মজুর এবং মালিকের রক্ষীবাহিনী। অবশ্যই ট্রেড ইউনিয়নের নেতা অনেক সময় মাঠে নামেন। তবে এমন ঘটনা বিরল নয় যেখানে শ্রমিক নেতা এবং মালিক ঠান্ডাঘরে চা খাচ্ছেন, এবং বাইরে বেদম মারপিট হচ্ছে। শ্রমিকদের অতর্কিত আক্রমণে অনেক সময় উচ্চপদস্থ কর্মচারী কিংবা খোদ মালিক পর্যন্ত মার খেয়েছেন, এমনটা শোনা যায়, তবে তা ব্যতিক্রম মাত্র। এর মধ্যে প্রাণ না গেলেও তুলনায় নিচের দিকের কর্মচারীদের বেশ ঝামেলা সহ্য করতে হয়।
কিছুটা অহিংস উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে যে কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে দুই রাশভারী অফিসারের ঠান্ডা লড়াই। সে মোটেই মার্কিন সোভিয়েত দ্বন্দ্বের থেকে কম হিংস্র নয়। তাদের দু'জনের পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে কেরানির প্রাণ ওষ্ঠাগত। এদিকে এক অফিসার অন্য অফিসারের কনিষ্ঠ শ্যালকের পাকাদেখায় গিয়ে জমিয়ে ফিশ ফ্রাই সাঁটাচ্ছেন, কিন্তু অফিসে সারাক্ষণ চু কিত কিত। পিয়ন বেচারি কোন দিকের বুড়ি ছোঁবে বুঝতে গিয়ে গলদঘর্ম। একজন যদি একটা চিঠি ফেলে আসতে বলেন, তো অন্যজনের সেই সময়েই ফটোকপি দরকার। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বে একটি বস্তু একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে পারে না, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে নিউটন বা আইনস্টাইন ফেল।
আরও পড়ুন: ভারত-চিনে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল!
ফিশ ফ্রাইয়ের গল্প অবশ্য বঙ্গপ্রদেশে অন্য মাত্রা আনে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা নবান্নে গিয়ে কুটিরশিল্প-জাত চপ-সিঙ্গাড়া না খেয়ে বহুজাতিক রেস্তোরাঁর আঁশটে মাছ ভাজা শোঁকেন। নিচে সমর্থকরা ব্যারিকেড ভেঙে স্লোগান দেন। আধভাঙা লাঠি হাতে মাসে বহুকষ্টে আট হাজার টাকা মাইনে পাওয়া সিভিক ভলান্টিয়ার পড়ে যান মহা আতান্তরে। অর্থাৎ যে কথাটা আবার বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, কিছু নেতা অবশ্যই আছেন, যাঁরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন। কিন্তু সভ্য সমাজ বা অগ্রবর্তী রাজনীতির প্রেক্ষিতে সেটা একেবারেই তাঁদের কাজ নয়। তাঁদের কাজ হলো মারপিট বাঁধানো, মারপিট দেখা, মারপিট বোঝা, দরকারে মারপিট থামানো এবং আবার শুরু করা। সেই মারপিটে ক'জন মরল এবং কোথায় মরল, সেই হিসেব মোটের ওপর বলে দিতে হয়।
অর্থাৎ আনুমানিক। সবসময় তা ঠিক হতে হবে এমনটা নয়। তবে একটু বেশি মরলে সেই দিনগুলো লিখে রাখতে হয়। কারণ তখন বছর বছর ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে শহিদ দিবস পালনের একটা কর্মসূচি জোটে। সেখানে নেতানেত্রীরা চোঙা ফুঁকে বক্তব্য রাখেন, সুরে বেসুরে গান হয়, শহিদ পরিবারের সদস্যরা হঠাৎ একদিন জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মঞ্চে জায়গা পান। অনেক সময় একটু গুলিয়ে ফেলে শহিদ স্মরণে আপন মরণে রক্তঋণ শোধ করার বদলে ছায়াছবির নায়কের দমকা নাচেও স্টেজ কাঁপে। তবে শহিদদের মনে করতে গিয়ে সবসময় শোক পালন করতে হবে, তাই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে? যে মরেছে সে কি জীবনে নাচে গায় নি? শহিদ স্মরণে তাই কোমর দুলিয়ে জীবনের উদযাপন হলে ক্ষতি কী? আর অচেনা লোকের মৃত্যুতে কার কী যায় আসে? নিজের প্রিয়জনের মৃত্যুই সময়ে সয়ে যায়, সেখানে আবার মায়ের চেয়ে মাসির দরদের অঙ্ক!
এখন ঘোর গণ্ডগোল রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে। দু'দেশের হাতাহাতিতে কে ঠিক কোন জায়গায় ঢুকে কাকে মেরেছে, সেই নিয়ে হিসেবের গোলমাল। রাষ্ট্রনেতার বক্তব্যের মধ্যে অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছেন বিরোধী রাজকুমার। তাই নিয়ে কত কাটাছেঁড়া। নেহাত কোভিড পরিস্থিতিতে পটলাদার চায়ের দোকান বন্ধ। নাহলে ওখানে গিয়ে খুব সহজেই আসল খবর জেনে যাওয়া যেত। আশেপাশের চায়ের দোকানগুলোয় নবান্ন, বিধানসভা, রাষ্ট্রপতি ভবন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আবাস থেকে সরাসরি খবর আসে। কিন্তু পীত ভাইরাসের চাপে চায়ের ভাঁড়ও দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বাণপ্রস্থে। সেক্ষেত্রে গোপন খবরের আশায় সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত টেলিভিশন বিতর্কেই নজর রাখতে হয়। মুশকিল হলো মাধ্যমিকের ইতিহাস আর ভূগোলে টেনেটুনে পাস। ফলে কোথায় যে কাশ্মীর, কোথায় লাদাখ, আর কোথায় রোটাং পাস, সেটা ঠিক মাথায় ঢোকে না।
তারপর সেই বাষট্টি থেকে শুরু করে নেহেরু কী কী বলেছিলেন, সে সবও মনে রাখতে হচ্ছে। বহু কষ্টে আসল প্রশ্নটা বোঝা গেল। তা হলো, এক দেশের সেনা অন্য দেশে ঢুকে মারামারি করেছে, নাকি উল্টোটা? একজন আবার বুঝিয়ে দিলেন, 'নো ম্যানস ল্যান্ড'। ম্যান মানে মানুষ, আর ঐ ঠাণ্ডায় যে মানুষ থাকার কোনও কারণ নেই, তা বোঝাই যায়।
আরও পড়ুন: লাদাখে চিনের অনুপ্রবেশ যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তার মোকাবিলা করতেই হবে
কিন্তু দেশ গড়া বড় দায়। সেখানে রেখা টানতে হয়। খাতার ওপর রঙিন পেনসিলে দু'দেশের সীমারেখা টানা কত মজার। ভুল হলে বড়জোর গৃহশিক্ষকের বকা। কিন্তু বাস্তব তো, তাই কাঁটা লাগানো লাঠি, কিংবা আঙুল অবশ হয়ে যাওয়া ঠান্ডার মতই কঠোর দেশের মানচিত্র। সেখানে দেশনেতাদের আঁকা বক্ররেখা রক্ষা করতে হয় রক্ত দিয়ে। আর শহিদের রক্ত যে ব্যর্থ হয় না, তা তো আমরা সবাই জানি। তাই শহিদ বানানোর প্রয়োজনে যুদ্ধ চলতেই থাকে। সঙ্গে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি শব্দের ফুলঝুরি।
কোথায় ঠিক কতজন সমরে অংশ নিয়ে মরে গেলেন, সেই তথ্য আমজনতার এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁজে পাওয়ার দরকার কী? ক'দিন পরে আপনিই সব ভুলে যাবেন। মনে রাখবেন শুধু দেশনেতারা। কারণ বছরের সেই দিনগুলোয় আবার মঞ্চ আঁকড়ানোর দায় থাকবে। ফলে দেশের নিরাপত্তার খাতিরেই হোক, কিংবা নিজেদের রাজনীতি বাঁচাতে - মৃত্যুর সংখ্যা অথবা শহীদস্থানের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নেতানেত্রীদের মনে থাকলেই হলো।
এর মধ্যে যে সমস্ত লোকজন একটু সাহস করে যুদ্ধ নয় শান্তি চাই গোছের কথা বলবেন, তাঁদের বিরোধিতায় একটা মোক্ষম অস্ত্র আমাদের হাতে আছে - মগজাস্ত্র নয়, কোভিডাস্ত্র। কোভিডে যত মানুষ মরছেন, তার চেয়ে অনেক কম মরছেন দেশের সীমানায়। কোভিডে আবার দেশনেতারা আক্রান্ত হয়। তাই সে বড় সাংঘাতিক। সীমান্তের যুদ্ধে সে ভয়টা তো নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এবারের যুদ্ধে গোলাবারুদের গন্ধ নেই, সবটাই সাবেক সংস্কৃতি মেনে লাঠিসোঁটার লড়াই। আইনস্টাইন বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে কী হবে বলতে পারব না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে মানুষ অবশ্যই লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল নিয়ে লড়বে। কোভিড তৃতীয়, সেখানে জীবাণুযুদ্ধ। আইনস্টাইন বুঝে উঠতে পারেন নি। চতুর্থটা মিলে গেছে।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন