Advertisment

ভূমিসংস্কার ও বিপরীত বর্ণবিদ্বেষ: একটি আফ্রিকান ট্রাজেডি

ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে মনে করেন যে সাদা চামড়াই সর্বশ্রেষ্ঠ, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকরা নিশ্চিতভাবেই ভাবেন না যে কালোই জগতের আলো। কিন্তু শয়ে শয়ে বছরের বঞ্চনা ও প্রবঞ্চনার ইতিহাস তাঁদের অসহিষ্ণু করে তুলেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
reverse racism south africa zimbabwe

ভেঙে যাচ্ছে নেলসন ম্যান্ডেলার 'রেনবো নেশন'-এর স্বপ্ন?

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল লিম্পোপো - বহির্বিশ্ব দূরস্থান, কেপটাউন বা জোহানেসবার্গের মানুষরাও এ জায়গা নিয়ে চট করে মাথা ঘামান না। সেই লিম্পোপোই আচম্বিতে বিশ্বের তাবড় সংবাদপত্রগুলির শিরোনামে। গত ২১ মে লিম্পোপোর দুর্গম এক পাহাড়ী খামার থেকে পাওয়া গেছে কৃষক ও সমাজকর্মী অ্যানেট কেনিলীর মৃতদেহ। বিকৃত এক শব। লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে অ্যানেটকে যে ভয়ঙ্কর উন্মত্ততার সঙ্গে খুন করা হয়েছে তা দেখে শিউরে উঠেছেন পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসাররাও।

Advertisment

দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৭ সালে সেদেশে খুন হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিদিনের হিসাবে গড়ে ৫৭ জন করে মানুষ খুন হন দক্ষিণ আফ্রিকায়। এহেন নিরাপত্তাবিহীন দেশে অ্যানেটের খুন শুধু পরিসংখ্যান হিসাবেই থেকে যেতে পারত, কিন্তু অ্যানেটের অতীত ও তাঁর কাজ এই খুনকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।

আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের সুরক্ষার দাবিতে বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছিলেন অ্যানেট। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বহুবার তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিবারই আবেগ ও যুক্তি দিয়ে অ্যানেট জানিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে যে অত্যাচার দুর্বৃত্তরা চালিয়েছে (অভিযুক্ত দুর্বৃত্তদের প্রায় সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ) তা নারকীয় বললেও কম বলা হয়। অত্যাচারের মাত্রা ও ধরন যে কোনো সভ্য সমাজকে বহু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাবে। অ্যানেটের খুনী সন্দেহে যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনিও কৃষ্ণাঙ্গ, অ্যানেটের সহকর্মীও বটে। অভিযুক্ত কেনি রামাতশিম্বিলা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করলেও এখনো পুলিশি হেফাজতেই রয়েছেন।

আরও পড়ুন: মানবাধিকার বিরোধী জোড়া আইনে শিলমোহর সংসদে, প্রতিবাদই একমাত্র পথ

অ্যানেটের আত্মীয় ও বন্ধুরা দাবি করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ভূমিসংস্কার নীতি জনসমক্ষে আসার পরেই শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের ওপর অত্যাচার বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে তাঁরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পাশের দেশ জিম্বাবোয়ের ভূমিসংস্কারের ইতিহাস দেখলে মনে হতে বাধ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার আসন্ন ভূমিসংস্কার শুধু দুর্বিপাকই নিয়ে আসবে। এবং ঔপনিবেশিকোত্তর দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবোয়েতে শ্বেতাঙ্গদের আদৌ কোনো নিরাপত্তা দেওয়া যাবে কিনা, প্রশ্ন উঠছে সে বিষয়েও।

ভূমিসংস্কার বিষয়টিকে এই বর্তমান প্রেক্ষিতে বোঝার জন্য ইতিহাসে চোখ বোলানো নিতান্তই দরকার। দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবোয়ে, দুই দেশেই ব্রিটিশ শাসনকালে জমির মালিকানা একচেটিয়াভাবেই ছিল শ্বেতাঙ্গদের। ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পরেও দুই দেশেই বহু শ্বেতাঙ্গই তাঁদের পূর্বপুরুষদের ভিটেজমি ছেড়ে ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডে নতুন করে সংসার পাততে রাজি ছিলেন না। স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা বা জিম্বাবোয়েতে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কতটা থাকবে সে নিয়ে একটা সন্দেহ থাকলেও অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গই সে নিয়ে বিশেষ ভয় পান নি।

পুরুষানুক্রমে অর্জিত শিক্ষা, সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি তাঁদের যে একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বহুদিন রেখে দিতে পারবে, সে নিয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। কট্টর দক্ষিণপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যাও কমে আসছিল। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের ভোট পেয়েছিলেন। অথচ পাশাপাশি এটাও সত্যি যে অ্যানেটের মতন বহু শ্বেতাঙ্গ কৃষক বহু বছর ধরে বহু একর জমির মালিক হয়ে বসেছিলেন, এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সংসার চলছিল এই বিশাল বিশাল খামারে কষ্টসাধ্য কায়িক পরিশ্রম করে।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে এসে কে ভূমিপুত্র আর কে নয়, সে বিতর্ক ছিল অর্থহীন। অ্যানেটরা দক্ষিণ আফ্রিকারই ভূমিকন্যা, এমনকি তাঁর বাবা বা দাদুরাও। কিন্তু সর্বহারা কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকের কাছেই গায়ের রঙই হয়ে দাঁড়ায় স্বত্বাধিকারীর আসল পরিচয়। অ্যানেটদের কোনো এক পূর্বপুরুষ জমি জবরদখল করেছিলেন বলেই বংশানুক্রমে অ্যানেটদের কাছে এসেছে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, এ বিশ্বাস থেকে টলানো যায়নি বহু জিম্বাবোয়েয়ান বা দক্ষিণ আফ্রিকানকে।

এই অসন্তোষ টের পেয়ে ১৯৮০ সালে জিম্বাবোয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন সরকার ভূমিসংস্কারের কাজ শুরু করে। শ্বেতাঙ্গ মালিকানার অধীনে থাকা প্রায় তেইশ শতাংশ জমি বিলি করা হয় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের মধ্যে। জমির নতুন মালিকদের অনেকেই ছিলেন পূর্বতন গেরিলা যোদ্ধা বা পূর্বতন ভূমিহীন কৃষক, জিম্বাবোয়ের স্বাধীনতার লড়াইয়ে যাঁদের অবদান ছিল সর্বাধিক। কিন্তু আধুনিক পুঁজিপ্রধান ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা নিয়ে স্বচ্ছ (অনেক সময়ে ন্যূনতমও) ধারণা ছিল না এই মানুষগুলির। ফলে উৎপাদন কমতে লাগল। এল না বিদেশী বিনিয়োগও। জিম্বাবোয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার সময় ব্রিটেন নতুন পুঁজি আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাও রক্ষা হল না। ফলে সরকারের উৎসাহ-উদ্দীপনাও কমতে শুরু করল। রাজনীতিবিদরা ভোল পাল্টে স্থিতাবস্থাতেই আস্থা রাখতে চাইলেন।

আরও পড়ুন: জন ও স্বাস্থ্য: স্ত্রীরোগ এবং আমাদের সমাজ

ছবিটা আবার বদলাল যখন রবার্ট মুগাবের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের ভরসা উঠে যেতে শুরু করল। মুগাবে যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর, অথচ স্বৈরাচার, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ সব কিছু মিলিয়ে তাঁর সরকারের ক্ষমতা নেই দেশকে নতুন কিছু দেওয়ার। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য তলানিতে ঠেকায় মুগাবে সরকারের পতন তখন প্রায় অবধারিত। বিপদ বুঝে সরকার শুরু করল 'ফাস্ট ট্র্যাক' ভূমিসংস্কার। সরকার মেনে নিল ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’, বা জোর যার মুলুক তার। নতুন আইনে সরকার কোনোরকম মূল্য না দিয়েই জমি দখল করতে শুরু করল, কাগজে কলমে বলা হলো, পূর্বতন জমির মালিক শুধুমাত্র জমির উন্নতির জন্য যা খরচ করেছেন সেটুকু পেতে পারেন, জমির দাম বলে কিছু নেই।

এদিকে নব্বইয়ের দশকের শেষে ব্রিটেনের লেবার সরকার জানায়, জিম্বাবোয়ের সরকারের কেনা জমির দাম মেটানোর কোনো দায় তাদের নেই। ফলে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ জমিদার প্রায় সব কিছু খুইয়ে আশ্রয় নিয়ে শুরু করলেন পড়শি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, এমনকি কেনিয়া বা উগান্ডাতেও। অরাজকতা এমন জায়গায় পৌঁছল যে জমির মালিকদের তাড়াতে কারা যে সরকার থেকে আসছেন আর কারা 'বেসরকারি', সেটাই বোঝা গেল না। বিপরীত বর্ণবিদ্বেষও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় এই পর্যায়।

আশির দশকে যে ভূমিসংস্কার হয়েছিল, সেখানে জিম্বাবোয়ে সরকারের নীতি ছিল, 'willing seller, willing buyer'। ফলে অন্তত কিছু খামারের মালিকানা যায় যোগ্য মানুষের হাতেই। নতুন পর্যায়ের জুলুমবাজিতে অধিকাংশ সময়েই স্থানীয় নেতা এবং দুর্বৃত্তদের মধ্যে যারা 'ফার্স্ট মুভার’স অ্যাডভ্যান্টেজ’ পেয়েছে তারাই মালিক হয়ে বসেছে, কৃষিকাজ এবং কৃষিপরিচালনের সামান্যতম যোগ্যতাটুকু না থাকা সত্ত্বেও। এই জবরদস্তির কী অপরিসীম মূল্য জিম্বাবোয়েকে দিতে হয়েছে সেটা বোঝার জন্য নিচের কয়েকটি সংখ্যায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০০০ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে জিম্বাবোয়ের কৃষি উৎপাদন কমে যায় পঁচাত্তর শতাংশ। টাকার হিসেবে এই অঙ্কটা ১২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যসামগ্রীর দামও বাড়তে থাকে। তাই এই একই সময়ে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮০ হাজার কোটি শতাংশ! শোনা যায়, জিম্বাবোয়ের সরকার তার পরে আর হিসেব রাখারও প্রয়োজন অনুভব করেনি।

জিম্বাবোয়ের চরম দুর্দিনেও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই বর্ণবিভাজন ও ভূমিসংস্কারের আঁচ সেভাবে পড়েনি। বরং নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে জিম্বাবোয়ের শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানরা দক্ষিণ আফ্রিকার দিকেই পা বাড়িয়েছিলেন। প্রায় এক দশক পর ছবিটি খানিক আচম্বিতেই বদলে গেছে। রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসার নেতৃত্বাধীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রস্তাব এনেছে ভূমিসংস্কারের, নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে যে সংস্কার আশ্চর্যজনক ভাবে রবার্ট মুগাবের সংস্কারের তুল্যমূল্য। শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা জানিয়েছেন, রামাফোসা জিম্বাবোয়ের পথেই হাঁটতে চলেছেন। সরকারের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তার পর তাঁরা নিশ্চিতভাবেই বুঝেছেন, জমি হারানোর পরেও তাঁরা একটা পয়সাও পাবেন না। সরকার স্কিলড ওয়ার্কার হিসাবে তাঁদের কাজের নিশ্চয়তা দিলেও দিতে পারে অবশ্য।

আরও পড়ুন: গাছ লাগান, গাছ কাটুন, তাহলে হাতে রইল কী?

রামাফোসা ক্ষমতায় আসার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেকব জুমা, আরেক চরম দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ। জুমার আমলে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বহুলাংশে সাধারণ মানুষের সমর্থন হারায়। অথচ এই আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরেই দক্ষিণ আফ্রিকা ‘রেনবো নেশন’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল একদিন, যে দেশে সর্ব বর্ণের মানুষদের থাকবে সমানাধিকার।

আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার সুযোগ নিতে শুরু করেছে একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল। সেরকমই একটি দল ‘ইকোনমিক ফ্রীডম ফাইটারস’ জেকব জুমার পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে দাবি জানায়, দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত জমি তুলে দিতে হবে কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষদের সমর্থন পুরোপুরি ভাবেই এই নতুন দলগুলির কাছে চলে যেতে পারে আশঙ্কা করে আসরে নেমে পড়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস-ও। স্বাধীনতা লাভের প্রায় পঁচিশ বছর পর তাই ডাক দেওয়া হয়েছে আমূল ভূমিসংস্কারের।

রামাফোসার ঘোষণার পর থেকেই শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা জানাচ্ছেন, জমি দখল, সম্পত্তি লুঠ, খুন ইত্যাদি বেড়ে গেছে ভয়ঙ্কর ভাবে। সেসব খবর পেয়ে নড়ে বসেছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তথা 'হোয়াইট সুপ্রেমেসিস্ট' ডোনাল্ড ট্রাম্পও। একাধিক টুইটে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর অত্যাচার নিয়ে। ট্রাম্পের টুইটকে উপলক্ষ করে একাধিক সহমর্মী রাজনীতিবিদ বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এহেন বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। একাধিক অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন ‘জেনোসাইড’ এর কোনো প্রমাণ নেই, বরং এহেন একবগগা মন্তব্যই বাড়িয়ে দিচ্ছে অশান্তি।

এই চাপানউতোরের মধ্যেই এসে পৌঁছল অ্যানেট কেনিলীর মৃত্যসংবাদ। ফের খবরে উঠে এল আরেক ইওরোপিয়ান বংশোদ্ভূত কৃষক ডেভিড হলের নাম। ডেভিডকে তাঁর স্ত্রী বার্নাডেটের সামনেই খুঁটিতে বেঁধে মাথায় গুলি করে মারে এক দল দুর্বৃত্ত, সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ।

জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের কাছে ভূমিসংস্কার একটি অবধারিত নীতি। এই নীতি থেকে পিছিয়ে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জিম্বাবোয়ের বর্তমান সরকার ভিটেচ্যুত শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের কাজ দিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালালেও জানিয়ে দিয়েছেন, জমি হারানো কৃষকদের হাতে ফের জমি প্রত্যর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী দলনেতা দু’জনেই জানিয়েছেন শয়ে শয়ে বছর ধরে ঔপনিবেশিক সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে যে অবিচার ঘটেছে, তার প্রতিকারের একমাত্র উপায় ভূমি পুনর্বণ্টন। নৈতিকভাবে কথাটা ঠিক, কিন্তু তথাকথিত ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ ভূমিসংস্কারের ফলে একটি দেশের সম্পূর্ণ অর্থনীতি কিভাবে ধ্বসে পড়তে পারে তা আমরা দেখে ফেলেছি।

আরও পড়ুন: বাঙালির বাঙালিত্ব নয়, রাষ্ট্রীয় গর্ববোধকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি

বাজার এবং কৃষিনৈপুণ্য অগ্রাহ্য করে ভূমিসংস্কার করলে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক পতনও যে অবশ্যম্ভাবী, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। রামাফোসা দেখে শিখবেন না ঠেকে শিখবেন সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু দেশব্যাপী ভূমিসংস্কার যে পথ ধরেই আসুক না কেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে সবার আগে খাদ্যের নিরাপত্তাটুকু সুনিশ্চিত করতে হবে। হয়ত মাইক্রোফিনান্স নামক আর্থিক সাফল্যের দেখানো পথ ধরে পুনর্বণ্টিত জমিটুকু তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিকার দিতে হবে মহিলা ও তরুণদের। লিঙ্গ ও শ্রেণি উত্তরণ বহুলাংশে না ঘটলে এহেন ভূমিসংস্কারের সাফল্য অতীব সীমিত হয়ে থাকবে।

এবং এই সব কটি বিষয়ের সঙ্গেই সমান গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করতে হবে বিপরীত বর্ণবিদ্বেষ নামক জান্তব সমস্যাটির।

অ্যাডলফ হিটলার বা ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে মনে করতেন বা করেন যে সাদা চামড়াই সর্বশ্রেষ্ঠ, আফ্রিকার গরিব ভূমিহীন কৃষকরা নিশ্চিতভাবেই ভাবেন না যে কালোই জগতের আলো। কিন্তু শয়ে শয়ে বছরের বঞ্চনা ও প্রবঞ্চনার ইতিহাস তাঁদের অসহিষ্ণু করে তুলেছে, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং 'জেনোসাইড' জাতীয় হাওয়ায় ভাসানো কথা না ধরেও বলা যায়, সে অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ ইদানীং কালে একতরফা ভাবে হিংসাত্মক। জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই সার সত্যটি না মেনে নিলে আরো ভয়াবহ ট্রাজেডির সম্মুখীন হতে হবে দু’দেশের মানুষকেই।

মৃত্যুর ছ’ বছর পর নেলসন ম্যান্ডেলা যেন আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে মার্টিন লুথার কিং এর অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শুরু হয়েছিল সেই অমোঘ বাক্যবন্ধ দিয়ে, "আই হ্যাভ আ ড্রিম"। এক হিসাবে মার্টিন লুথারের সেই স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু ৫৬ বছর ধরে আফ্রিকান-আমেরিকানরা তাঁদের লড়াই জারি রেখেছেন মার্টিনের স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য। ম্যান্ডেলাও 'রেনবো নেশন'-এর স্বপ্ন দেখেছিলেন, শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, গোটা আফ্রিকার জন্যই। আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের প্রাণের সুরক্ষা সেই অঙ্গীকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ, একথা প্রতিটি আফ্রিকানেরই বোঝা উচিত। আর সেটা বোঝার জন্য বিত্ত বা বর্ণ কোনো আবশ্যিক শর্ত হয়ে উঠতে পারে না।

(প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment