সম্প্রতি কলকাতার এক নামী ব্র্যান্ডের শো-রুমে ঘটে যাওয়া একটি বিষয় খবরের শিরোনামে আসে। ঘটনাটি এইরকম, সংস্থার কর্তৃপক্ষ নাকি কর্মীদের নির্দেশ দেন, গ্রাহকদের 'নমস্কার' নয়, 'নমস্তে' বলে আপ্যায়ন জানাতে হবে। এর আগে গত বছর ১৫ অগাস্টের দিন কর্মীরা ইংরেজি গানের পরিবর্তে দেশাত্মবোধক গান চালানোর অনুরোধ জানান। এছাড়াও প্রতিবাদ স্বরূপ সবাই মিলে জাতীয় সংগীতও গান সেদিন। এভাবেই কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন তাঁরা। এরপর সংস্থার পঁচিশজন কর্মীকে সাসপেন্ড করেন কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি খবরে আসার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঝড় তোলে।
শেষে কর্তৃপক্ষ জনমতের চাপে নতি স্বীকার করেন ও সাসপেন্ড হওয়া কর্মীদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান। স্বাভাবিক, গ্রাহক মুখ ফেরালে সমূহ বিপদ। আর বাইরের চরিত্রে এ শহর যতই বিশ্বজনীন হোক, বাংলাভাষী মানুষের রাজ্য তো বটে। কোথাও মাতৃভাষার হেনস্থা হতে দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতেই পারে। সেখানে অনেক কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করতে করতেই কোনও এক সময় ছোট করে হলেও একটি স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে।
এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারলে খুশি হতাম। মেনে নেওয়াই আজকাল আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অভ্যাস বিষয়টাও মাঝে মাঝে নড়েচড়ে বসে। স্থির জলের পুকুরে একটা ঢিল মারলেও তো একটা তরঙ্গ ওঠে। আর সেই তরঙ্গও কোনও এক সময় আর ছোট পুকুরে আবদ্ধ থাকে না। তরঙ্গ হতে তরঙ্গে। এক মন থেকে আর এক মনে। এক মুখ থেকে অন্য মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জীবনচর্চায় আমরা সর্বভারতীয় কেন, আন্তর্জাতিক হতে পারি। কিন্তু বাঙালি আদতে মনেপ্রাণে বাঙালি। মাতৃভাষা নিয়ে তার আবেগের ব্যাপারটা তখনই আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যখন তার ভাষাকে কেউ অপমান করে।
এই অবজ্ঞা, ছোট করে দেখানোর চেষ্টাটা আগে রাজ্যের বাইরে ঘটেছে। সেটা হয়তো অনেকদিন ধরেই ঘটছে। ইদানিং রাজ্যের মধ্যেও প্রবেশ ঘটছে চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতির। দেশ জুড়েই ভাষা সন্ত্রাসের যে চরম নিদর্শন ইদানীং প্রকট, তাতে বাংলা ভাষাও সমান বিপন্ন, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে, এই বিপন্নতার আসল চেহারাটা সত্যি যদি আমরা দেখতে চাই, তাহলে কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদেরও একবার আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও অরুন্ধতী রায়, শেষ পর্যন্ত দুজনেই…
ভাষা ও সংস্কৃতি মানুষের পরিচয়। বস্তুত, জীবনসংস্কৃতির প্রথম পাঠটাই তো শুরু ভাষার মাধ্যমে। ভাষা এখানে গৌরবার্থে মাতৃভাষা। বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, তার ভাষার বিপন্নতা চিরকালই ঘরে ও বাইরে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ব্রিটিশ আমলে তাকে ইংরেজি শিখতে হয়। সেটা দোষের কিছু নয়। ইংরেজি সারা বিশ্বে স্বীকৃত একটি অতি সমৃদ্ধ ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষায় সেই সূত্রেই ঢুকে পড়ে প্রচুর বিদেশি শব্দ।
তারও আগে মুঘল শাসনের আমলে উর্দু ভাষাও প্রবেশ করে। তবে কিনা, ভাষা নদীর মতো। স্রোতে ভেসে ভেসে, মিশে যায় শব্দরা। আর এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আর যাই হোক, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়। স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা মেনেই ঘটেছে যুগ যুগ ধরে। পরিবেশ, পরিস্থিতির কারণেই বাংলার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। মিশ্রণ অর্থাৎ মেলবন্ধন। সেটা কিন্তু দূষণ নয়। এখন যেটা হচ্ছে, সেটা হলো ওই 'নমস্তে' বলতেই হবে। এক প্রবল সন্ত্রাস ও তার ফলে দূষণ।
ঘরে-বাইরে বিপন্নতা। কেন না ঘরে-বাইরে শত্রু। বাইরের শত্রুদের চেনা যায়। প্রতিরোধও হয়তো গড়ে তোলা যায়। সমস্যাটা প্রকট ঘরের মানুষ অবুঝ, অচেতন, অচেনা হয়ে গেলে। গত কয়েক দশকের ইতিহাস দেখলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আজ অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টাটা চলছে, সেটা নিঃসন্দেহে চূড়ান্ত অন্যায়। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, সেটা শুরুও হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিরোধের আগে ঘরের কথা।
চোখ ফেরালেই বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষা চর্চার যে নমুনা দেখি, তা বড়ই হতাশাব্যঞ্জক। সব বাদ দিয়ে, এই সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করতে গিয়েই অনেকের বাংলা বলা বা লেখায় শব্দ প্রয়োগের বহর দেখে একই সঙ্গে বিস্মিত, লজ্জিত ও আতঙ্কিত হয়েছি। একেবারে সাধারণ স্তরের কথা যদি বলি, সার্বিকভাবে মেলামেশা, আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা তার নিজের রাজ্যের মানুষের কাছেও কম অবহেলিত নয়। স্কুল-কলেজের পাঠক্রমে মাতৃভাষা ব্যাপারটাকে কতখানি কম গুরুত্ব দেওয়া হয় আজকাল, তা শুধু কথা বললে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করলেই উপলব্ধ হয়। পোস্টারে, ব্যানারে, পথেঘাটে চলতে ফিরতে বানান, শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের কথা ছেড়েই দিলাম। লেখাপড়া থেকে অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভাষার সার্বিক অধোগতি বড়ই প্রকট। সেই দিকটা নিয়ে কি ভাববে নব্য বাঙালি?
আরও পড়ুন: হর্নশূন্য আইজল, কলকাতা কি সপ্তাহে একটা দিনও হর্নশূন্য হতে পারে?
নাকি তারা শুধু কোনও এক পক্ষের 'প্রতিবাদ' হুজুগেই মাতবে? আসলে, আর সব কিছুর মতোই ভাষা নিয়েও একটা রাজনৈতিক খেলা চলে আসছে। যেটা আবার এদেশের ভোটের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। আছে গভীর জলের কর্পোরেট খেলাও। যেখানে যত ভাবাবেগ, সেখানেই তো রাজনীতির সুড়সুড়ি। এটারও একটা ইতিহাস আছে। কখনও প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়া। কখনও ইংরেজি মাধ্যমে বাংলাকে অন্ত্যজ করা। কখনও হিন্দি চাপানো। কখনও এলাকার রাস্তা, স্টেশন, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির নাম বদল। সব শেষে প্রতিবাদের নামে ঘোলা জলে মাছ ধরা। যে ভাষায়, যে ভাষার পক্ষে প্রতিবাদ ও আন্দোলন, সেই ভাষার অভিব্যক্তিই যদি ভুলে ভরা হয়, তবে, মূল বিষয়টাই খেলো হয়ে যায় না কি?
সাম্প্রতিক কালের বহু চর্চিত 'বাংলা পক্ষ' সংগঠন নিয়ে এই বিতর্কই প্রবলভাবে দানা বেঁধেছে। শুরুতে অনেকেই এদের কর্মকান্ডে উদ্বেলিত হন। ভাষা বিপন্নতা নিয়ে যে উদ্বেগ ও সংকট, সেখানে এদের উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হওয়ারই কথা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে নানা কারণে, বিশেষত এদের প্রতিবাদ প্রদর্শনের উগ্র সংস্কৃতি, যা প্রকৃত বাঙালি মনস্কতার পরিপন্থী, তাতে একটা সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের পথ কখনও সন্ত্রাস হতে পারে না। বাংলা ভাষা সংরক্ষণ করতে গিয়ে এ রাজ্যের হিন্দিভাষী মানুষদের শত্রু প্রতিপন্ন করাটা সুস্থতা নয়।
সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল সবারই প্রচারের উৎকৃষ্ট ময়দান। সেখানেও এদের পোস্টের বক্তব্য প্রকাশে শব্দ চয়ন থেকে বাক্য বিন্যাস, চিরন্তন ও শিক্ষিত বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির অনুসারী নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। নিছক বাংলা ভাষা ও বাঙালির সামগ্রিক স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে সামনে রেখে প্রচ্ছন্ন ভাবে কোনও এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের বি-টিম হিসেবে কাজ করছে এরা, এমন অভিযোগও রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নাতীত নয়।
মোদ্দা কথা হুজুগ। নাকি কোনও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা? যেটাই হোক, এর দ্বারা ভাষা সন্ত্রাস দমন করার ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়। আসল কথা হলো অপমানবোধ। যা একেবারে অন্তঃস্থলে আঘাত করে। যে আঘাতের তীব্রতা ও গভীরতা এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের সৃষ্টি করে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন নিরীহ সাধারণ মানুষও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। অগণিত মানুষের এই মুখরতাই একদিন 'বাংলাদেশ' নামের এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।
এপারের বাঙালি তার প্রাণের ভাষাকে কিভাবে যাবতীয় দূষণ ও সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, সেকথা হয়তো সময়ই বলবে। তবে, সবার আগে সেই ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সচেতনতার পাঠ নিতে হবে নিজেকে। বছরে একদিন মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে এটা সম্ভব নয়। মা যেমন জীবন জুড়ে থাকেন, আজন্ম, আমৃত্যু। মাতৃভাষাও তেমনই সংবেদনশীল, গভীর ও স্পর্শকাতর এক চর্চার বিষয়। আর এক্ষেত্রে বড়দেরই দায়িত্ব পরের প্রজন্মকে এটা অনুধাবন করানো। নাহলে ছোটরা ওই পক্ষে-বিপক্ষের হুজুগের জোয়ারে ভাসবে। গভীরে ডুব দিতে শিখবে না।