/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/04/jayanta-1.jpg)
ভবিষ্যতের চিত্রটা কি এরকমই? ছবি: বিশাল শ্রীবাস্তব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
করোনা আক্রান্ত এই সময় আমায় অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, অতঃ কিম? এরপর কী হবে?
হোয়াট উইল বি দ্য ফিউচার? প্রয়াত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত দিল্লির নানা ধরনের সংকট 'কভার' করার সময় বলতেন, যে সংকট ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে, তার বিশ্লেষণ তো সবাই করছে। ভবিষ্যৎ কী হবে, তা আগাম লেখার চেষ্টা করো। যাকে বলা হয় 'ফিউচারিস্টিক স্টোরি'।
শুধু এই ভারত, মানে অতীতের আর্যাবর্ত থেকে হস্তিনাপুর হয়ে আজকের নেহরু-মোদীর ভারত তো শুধু নয়, এ দুনিয়ার ধারাপাত কী হবে, সেও এক বিরাট জিজ্ঞাসা।
এই ভয়াবহ করোনা কাণ্ড মে মাসেই শেষ হয়ে যাবে, নাকি আরও অনেক দিন চলবে, তাও তো জানি না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দল তাঁদের জার্নাল 'সায়েন্স'-এর এক প্রতিবেদনে বলেছেন, আমেরিকার ক্ষেত্রে এই একক লকডাউনে সমস্যা অতিক্রান্ত হবে না। তাই ২০২২ পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব-নীতি সে দেশে বজায় রাখতেই হবে। এই বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে আমরা আশাবাদী মানুষ। আশা করি, আমরা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আবার জিতব। সামাজিক ডারউইনবাদ। যোগ্যতমের উদবর্তন হবে।
আরও পড়ুন: একটি অবাস্তব গল্প
তবে সে হবে এক নতুন পৃথিবী। এক নতুন ভারত। যেদিনই ঝড় থামুক, আমরা নতুন এক যাত্রাপথের পথিক হব।
অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক, মানসিক বা মনস্তাত্বিক ক্ষেত্রে নানা অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসবে। প্রথমে দেখা যাক আর্থিক অসাম্যের বিষয়টি। ধনী-দরিদ্র বিভাজন। শ্রেণী সংঘাতের সাবেকী তত্ত্বের প্রাসঙ্গিতার মূল্যায়ন হবে নতুন করে। করোনা আপাতভাবে ধনী-দরিদ্র দু'পক্ষকেই একইভাবে বিপদে ফেলে দিয়েছে। ঔপনেবেশিক পৃথিবীর একদা সম্রাট-দেশের আজকের গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। স্পেনের বৃদ্ধা রাজকুমারীর মৃত্যু হলো। জার্মানির অর্থমন্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। আর অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের 'দিন আনি দিন খাই' শ্রমিকরা লকডাউন ভেঙ শুধু গুজবের ভিত্তিতে ট্রেনে চেপে শিকড়ের টানে বাড়ি ফিরে যেতে চাইছে। রোটি-কাপড়া-মকানের জন্য।
মনে হচ্ছে, আগামী দিনের পৃথিবীতে অন্তত কয়েক দশকের জন্য অর্থান্ধতা, ক্ষমতান্ধতাকে শিকেয় তুলে রাখতে হবে। যাঁরা আকাশে বিশেষ বিমানে বিয়ের পার্টি দেন, মধুচন্দ্রিমা করেন, বা ব্রুনেইয়র সুলতানের মতো কয়েকটি প্রমোদ তরণী নিয়ে সমুদ্রপথে জন্মদিন পালন করেন, তাঁদেরও ভাবতে হবে, এহেন ঐশ্বর্যের অপচয় কি দৃষ্টিনন্দন? নাকি বিজ্ঞাপনে মুখ না ঢাকাই ভালো?
এক বিশিষ্ট শিল্পপতির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, "আমাদের ব্যবসার লাভ না হলে, রোজগার না হলে আমরাই বা মাইনে দেব কী করে? বিনিয়োগই বা হবে কী করে?" এখনই ব্যবসায়ীরা ভাবতে শুরু করেছেন কীভাবে খরচ কমানো যায়। 'কস্ট কন্ট্রোল অস্টেরিটি'-তে এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতি এবং ভারতের অর্থনীতি কটে যাওয়া ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খাচ্ছিল, আর এখন তো করোনার পর সবাইকেই বেল্ট বাঁধতে হবে, আরও শক্ত করে।
আরও পড়ুন: ইঞ্চিতে মাপা সামাজিক দূরত্ব
বিশ্ব অর্থনীতির যে রিপোর্ট সদ্য আমাদের হাতে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার শতকরা এক ভাগের সামান্য বেশি হবে। আর ইতালির মতো সুসভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যান শূন্যের নীচে চলে যাবে। রেনেসাঁ তো সপ্তদশ শতাব্দীতে হয় সেখানে। আর আজ সেখানে করোনার মৃতের সংখ্যা? হায় সভ্যতা! ব্যাঙ্ক ঋণ দেবে বলছে। লােকে ঋণ নিচ্ছে না। কেননা, বিনিয়োগ নেই। ব্যাঙ্ক বলছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, বাঁচাও। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও কাঁদছে। হায়!
আর এক ব্যবসায়ী বললেন, "গত একমাসে আমরা এতগুলো ভিডিও কনফারেন্স করলাম, 'জুম' প্রযুক্তির মাধ্যমে ১০০-২০০ লোক একসঙ্গে আমরা বৈঠক করলাম, এখন মনে হচ্ছে, এত পয়সা খরচ করে ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট, এমডি-দের বিদেশ পাঠিয়ে বৈঠক করানোর দরকার কী? তার চেয়ে এই তো ভালো! এমনকী, এ ধরনের বৈঠকে চেয়ারম্যান তো নিজেও মাঝেমাঝেই ইন্টারভেন করছেন। হােটেল খরচ, বিমানে আসা-যাওয়া, এসব বন্ধ করে দেওয়াই যায়। এভাবে ব্যবসায়ীরা ভাবলে ভাবুন তো কী হবে? দুবাই বা ব্যাঙ্কক-এ বা বালি-তে বোর্ড বৈঠক, এসব সংস্কৃতিকে দাও বিদায়।
কিন্তু এটাই যদি ভবিতব্য হয়, তবে পর্যটন ব্যবসার কী হবে? রিয়াল এস্টেট ব্যবসার কী হবে? আমার মনে হয়, বদলে যাওয়া পৃথিবীতে ব্যবসার অগ্রাধিকারগুলিও পরিবর্তিত হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের পর। নদীর এক পাড় ভাঙে আর এক পাড় গড়ে। পর্যটন ব্যবসা মার খাবে তো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা প্রযুক্তির ব্যবসা হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াবে। বহু 'স্টার্ট-আপ' উত্থিত হবে। পরিবেশ, ক্লাইমেট, অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, প্রকৃতি, চিকিৎসা, দূষণ প্রতিরােধে, স্বাস্থ্য গবেষণায় হয়তো নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
আরও পড়ুন: মহামারীকালে দায়িত্ব ভাগাভাগি
আমি একজন ব্যবসায়ীকে জানি, যিনি কোনও দিন চিকিৎসা ক্ষেত্রের যন্ত্রপাতি আমদানি-রফতানি করেন নি, কিন্তু করোনার জন্য অনেক টেস্ট হবে আগামী দিনেও, এটা উপলব্ধি করে এক বিদেশি সংস্থার সঙ্গে এখনই শরিকি সম্পর্ক তৈরি করে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসা। আমি তো ব্যবসার লোক নই। সাধারণ মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থেকে আর ব্যবসায়ীরা যেমন বলছেন, সেভাবেই আপনাদের জানালাম।
সামাজিক-পারিবারিক ব্যক্তিগত সম্পর্কেও কি পরিবর্তন আসবে না? এই যে আমরা ইঁদুর দৗেড়ে নেমে শুধু সমৃদ্ধি আনতে গিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, পরিজন, সহ-নাগরিক, পাড়া - সবিকছুই ভুলতে বসেছিলাম, সেখানেও কি নতুন চিন্তা আসবে না?
রামবিলাস পাসোয়ানের দাড়ি বড় হয়ে গিয়েছে, বাড়িতে বসে থেকে থেকে। নাপিত নেই। ছেলে, ফিল্ম অভিনেতা চিরাগ বাবার দাড়ি কেটে দেবে। ঠিক আছে, সে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার মধ্যে প্রচারের একটা উপাদান আছে বটে। কিন্তু বাবা-ছেলের ব্যক্তিগত সময় উদযাপনের বার্তাও তো আছে। আজকাল তো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বাবা-মা'কে কার্যত তাদের কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইতে হয়। এই যে মেকি পিপলি লাইভ 'মিডিয়াটাইজড' গণতন্ত্র! বদল হবে এতেও?
আরও পড়ুন: ‘যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, তাঁদের জন্য সরকার হাত খুলে খরচ না করলে পথ হারাব আমরা’
আর সবেচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, পরিবর্তন কি হবে সমাজের এই জাতপাত, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আর আর্থিক অসাম্য ভিত্তিক রাজনীতিতে? আমরা আমজনতা কি এবার বলব, ঢের হয়েছে এই লোক-ঠকানো রাজনীতি? এবার জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে মানুষের মঙ্গল, মানুষের উন্নয়নের রাজনীতি হোক। তিনের দশকের 'গ্রেট ডিপ্রেশন' কাটিয়ে, বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া পেরিয়ে আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের হিংস্রতা, সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা 'ঠান্ডা যুদ্ধের' পরেও থামে নি। এবারও কি তা থামবে না?
জাপান বলেছে, চিন থেকে সমস্ত জাপানি ব্যবসা প্রত্যাহার করবে। যে লোকসান হবে বেসরকারি সংস্থার, রাষ্ট্র সেই লোকসানের খরচও বইবে। এবার কি চিন-বিরোধী এক নতুন রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠবে?
মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। একটা সময় মনে হয়েছিল, সমাজতন্ত্র মৃত। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ অসত্য। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা ঘোষণা করেন, ইতিহাস মৃত। তবে রিচার্ড ডি উলফ, 'রিথিঙ্কিং মার্ক্সসিজম' নামের মার্ক্সসীয় জার্নালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাটা, বলেছিলেন, "মার্ক্স অসত্য নন। পুঁজিবাদও সর্বরোগহরা বটিকা নয়।"
আমরা ভেবিছলাম, পুঁজিবাদই সব সমস্যার দাওয়াই। সমাজতন্ত্র, মিশ্র অর্থনীতি থেকে সৃজনশীল পুঁজিবাদ, পরোপকারী পুঁজিবাদ, নানা ধরনের টোটকা। এবার নতুন পৃথিবী হয়তো আবার নতুন পথ তৈরি করবে। মানুষ আবার বলবে, অনেক ব্যাখ্যা তো অনেকে দিয়েছে, এবার গড়তে হবে নতুন পৃথিবী।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন