Advertisment

মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও অরুন্ধতী রায়, শেষ পর্যন্ত দুজনেই...

ড্রয়িং রুমে যতটুকু অশিষ্টতা প্রয়োজন, সেটুকুই মনোরঞ্জন ব্যাপারীর উপযোগিতা। একদম মাপে মাপ ও খাপে খাপ। একটুও বেশি নয়। একটুও কমও নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Arundhati Roy Manoranjan Byapari

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

সাহিত্যের ব্যাপারিরা যা মুখ ফুটে কখনও বলবেন না, তা হল, যদিও দুজনেই নানা লিট ফেস্টে মনোরঞ্জন করেন, তবুও মনোরঞ্জন ব্যাপারী আর অরুন্ধতী রায়ের মধ্যে বিস্তর তফাত। তফাতটা এই নয়, যে, ইনি বুকার পেয়েছেন, উনি পাননি। বরং গোদা ভাষায় বললে পার্থক্যটা এই, যে, অরুন্ধতী রায়, উচ্চবর্ণের 'আমাদের লোক'।

Advertisment

বলাবাহুল্য এই 'উচ্চবর্ণ'-এর সঙ্গে জাত-পাতের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এটা 'এনলাইটেনমেন্ট'এর আলোকদীপ্তির উচ্চবর্গতা। অরুন্ধতী এনলাইটেন্ড, তিনি ফরফরিয়ে ইংরিজিতে কথা বলেন, আরও স্পষ্ট করে বললে 'সাম্প্রতিক' ভাষায় কথা কন। তাঁর সাহিত্যের শৈলী প্রয়োগ যথাযথ। এমনকি মাওবাদীদের নিয়ে লেখা ডকু ফিচারেও তিনি স্পষ্ট করে নভেল লেখার কৃৎকৌশল অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেন।

বইমেলায় ক্যা-এনআরসি-র বিরুদ্ধে ছোট ছোট প্রতিরোধ

ফলত পছন্দ হোক বা অপছন্দ, অরুন্ধতীর রাজনৈতিক ন্যারেটিভ সবসময়ই সব পক্ষের কাছেই 'গুরুত্বপূর্ণ'। তিনি আজ অক্সফোর্ডে কাল কেম্ব্রিজে স্রেফ নিজের বক্তব্য রাখার জন্যই ডাক পান, এবং সে নিয়ে মাঝে মাঝেই হট্টগোলও হয় বিস্তর, কারণ, মতামত পছন্দ হোক বা না হোক, সারস্বত সমাজের রইস আদমিরা সেসবের আয়নায় নিজেদের দেখতে পান। যে চর্বিতচর্বণে তাঁরা অভ্যস্ত তারই একটি অভয়ারণ্য খুঁজে পান। উল্টো দিকে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সঙ্গে এ হেন রইসির কোনো সম্পর্ক নেই।

আবারও, রইসি অর্থে এখানে যাপনের উচ্চতার কথা বলা হচ্ছেনা। এ হল বোদ্ধাদের নিজস্ব অভয়ারণ্যের গোষ্ঠীবদ্ধতা। মনোরঞ্জন ব্যাপারী সেখানে খাপ খান না। একে তো তাঁর উচ্চারণ রীতিমতো অশিষ্ট। তদুপরি তিনি লেখায় নাগরিক শৈলী বা কৃৎকৌশলের ধার ধারেন না। ইংরিজি তো বলেননই না, তাঁর লেখা অন্যকে অনুবাদ করে দিতে হয়।

কলোনির সাহিত্যের জগতে তিনি সম্পূর্ণ 'বাইরের লোক', এক আদর্শ 'অপর'। এক কথায় তাঁকে 'আদার ব্যাপারি' বললেই চলে। এ হেন মনোরঞ্জন যে তবুও সাহিত্যের নানা জাহাজের কারবারে ডাক পান বা চর্চিত হন তার এক ও একমাত্র কারণ হল, ভদ্রলোকীয় বাবু ও বিবিদের স্রেফ নিটোল চর্বিতচর্বণ ও আভ্যন্তরীণ কূটকচালি নিয়েই দিন চলেনা। সে অতি ঝুল ব্যাপার। তাঁদেরও জীবনে এবং ডিসকোর্সে নতুনত্বের প্রয়োজন আছে, ধমনীতে দরকার অ্যাড্রিনালিন, তদুপরি সমাজ সচেতনতা নামক বস্তুটিকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিলে আত্মপ্রসাদের অভাবও হয়।

“বইমেলার আগুনের কারণ একটি দায়িত্বজ্ঞান সিদ্ধান্ত”

তাই তাঁদের সাজানো ড্রয়িং রুমে প্রয়োজন হয় কিছু অশিষ্ট শো-পিসের। তাঁরা শরীরে জাঙ্ক জুয়েলারি পছন্দ করেন, ফ্রিজের মাথায় বসিয়ে রাখেন ডোকরার কারুকার্য, তাঁরা 'দলিত সাহিত্য' নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেন, কিন্তু তা বলে তো আর সেসবের কারিগরদের ডেকে রাজনীতি আলোচনা করতে যান না। এই কারণেই মনোরঞ্জন কখনও সাহিত্যের কর্মশালায় ক্লাস নেবার সুযোগ পাবেন না। কখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি নিয়ে বলতে ডাকবেনা। কারণ তিনি শো-পিস মাত্র।

ড্রয়িং রুমে যতটুকু অশিষ্টতা প্রয়োজন, সেটুকুই মনোরঞ্জন ব্যাপারীর উপযোগিতা। একদম মাপে মাপ ও খাপে খাপ। একটুও বেশি নয়। একটুও কমও নয়। সাহিত্যের ব্যাপারীরা এই সহজ সত্যকথন কখনও উচ্চারণও করবেন না। কারণ, সেটা আবার তথাকথিত প্রগতিশীল সঠিকত্বের গায়ে আঁচড় ফেলবে।

কিন্তু এহ বাহ্য। কারণ, মজা হল এই, যে, বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ি এমনকী বিক্রম শেঠও মনোরঞ্জনের থেকে খুব আলাদা কিছু নন। সেই দাড়িওয়ালা রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যকে এমন বিচ্ছিরি ঋষিপ্রতিম রহস্যময়তায় ঢেকে দিয়েছিলেন, যে, তারপরে দীর্ঘদিন প্রাচ্য আর তেমন কল্কে পেতনা। কিন্তু রুশদির পর থেকেই হিসেব ঘুরতে শুরু করে। আর এখন তো ভারত ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বেজায় হিট।

তার কারণও সেই একই। পাশ্চাত্যের ড্রয়িং রুমও বড়ই নিটোল ও একঘেয়ে। সেখানে প্রাচ্য কর্কশতার অল্প ডোজ বৈচিত্র আনে। স্বাদে আনে বদল। অরুন্ধতী ঝুম্পা ও বিক্রম তাই অনায়াসে শোভা পান পাশ্চাত্যের সুসজ্জিত বসার ঘরে। তার মানে একেবারেই এই নয়, গোটা প্রাচ্যের সাহিত্যরীতিকে বুঝে ফেলে বাড়িতে ডেকে নিতে পশ্চিম খুব উদগ্রীব। একেবারেই তা নয়, এবং কে কতদূর যেতে পারে তার একেবারে নিক্তি ধরে মাপ ঠিক করা আছে। যেমন মুম্বইয়ের ধারাবি বা কলম্বিয়ার এসকোবারের রোমহর্ষক যাপন টিভিতে বসে দেখার জন্য খুবই উপাদেয়, কিন্তু তার সঙ্গে কেউ ম্যাজিক রিয়েলিজমকে গুলিয়ে ফেলেনা।

এই নিরিখে তৃতীয় বিশ্বের ছাগলছানাদের স্থান একেবারে নির্দিষ্ট, এবং সেই বিচারে অরুন্ধতী ও মনোরঞ্জন মোটামুটি একই স্থানে দাঁড়িয়ে। যদিও এটাও স্বীকার করতে আমাদের এলিটদের প্রবল সমস্যা হবে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের লেজুড়তায় ডিনায়ালই তো বেঁচে থাকার অন্যতম উপকরণ।

সব গুরুনিন্দা একসঙ্গে

Guruninda
Advertisment