করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পরই প্রয়োজন মানুষের দুবেলা দুমুঠো অন্ন। তা নাহলে রোগে নয় পেটের জ্বালায় মৃত্যু হবে অসংখ্য মানুষের। অথচ সরকারি রেশন ব্যবস্থা নিয়েই জেলায় জেলায় ডিলারদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠছে। চলছে ক্ষিপ্ত গ্রাহকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ। করোনা আবহে গণবণ্টন ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করাই খাদ্য দফতরের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
বামফ্রণ্ট আমলে গ্রামের পর গ্রামে রেশন বিদ্রোহ হয়েছিল। ডিলারের ঘর পুড়েছিল। ব্যাপক অশান্ত হয়ে উঠেছিল গ্রাম-বাংলা। ঘুম ছুটেছিল পুলিস- প্রশাসনের। প্রতিদিন একাধিক গ্রামে রেশন নিয়ে গন্ডগোল লেগেই থাকতো। মহামারির মতো গ্রামের পর গ্রামে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। শনিবার যে ভাবে মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু গ্রামে রেশন নিয়ে ঝঞ্ঝাট পেকেছে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। বিক্ষোভের খবর আসতে শুরু করেছে বর্ধমান, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে। করোনা পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পকেট ফাঁকা। খাবার কেনার অর্থ নেই। ভরসা বলতে একমাত্র গণবণ্টন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, জরুরি ভিত্তিতে কড়া পদক্ষেপ করা দরকার সরকারের।
আরও পড়ুন- পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক
রেশন নিয়ে বিক্ষোভের আগুন ক্রমশ বাড়ছে। শনিবার মুর্শিদাবাদে একাধিক রেশন ডিলারের বিরদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন গ্রাহকরা। সেখানে অগ্নিসংযোগের মতোন ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রাহকদের মূল অভিযোগ, পরিমানে কম দিচ্ছে রেশন ডিলাররা। তাছাড়া চালের মান নিম্ন বলেও অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগ হয়ত নতুন নয়, তবে করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের না আছে কাজ, না আছে বাড়িতে মজুত খাবার। বেঁচে থাকার কোনও রাস্তাই নেই বেশিরভাগ মানুষের কাছে।এই পরিস্থিতিতেও যদি মানুষ নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তাঁদের সামলানো মুশকিল। তাই একটু এদিক-ওদিক হলেই সব রোষ গিয়ে পড়ছে রেশন ডিলারের ওপর।
প্রথম দিকে অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক দলগুলির একাংশ কিছু ডিলারের কাছ থেকে জোর করে বস্তা বস্তা চাল সংগ্রহ করছে। খাদ্যমন্ত্রীও বিষয়টি একেবারে উপেক্ষা করতে পারেননি। কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তাছাড়া নানা রেশন দোকানে সামগ্রীর নিম্ন মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। একই সঙ্গে ঘোষণার থেকে কম চাল দেওয়া হচ্ছে বলেও একাংশ ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। ওজনে কারচুপির অভিযোগও রয়েছে অনকে ক্ষেত্রে। শুক্রবার ছিল এমাসের রেশন দেওয়ার প্রথম দিন। ফ্রি ৫ কিলোগ্রাম চাল দেওয়া শুরু হতেই নতুন করে ডিলারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে।
এদিকে জলপাইগুড়ির বানারহাটে বিজেপির কার্যালয়ে রেশনের মাল উদ্ধারের পরই রাণাঘাটে রেশনের চাল পাচারের অভিযোগ ওঠে একটি রাইস মিলের বিরুদ্ধে। যদিও বিজেপির দাবি, ওই কার্যলয়ের সামনে দলীয় পতাকা থাকতে পারে কিন্তু তারা ওই অফিস কয়েক মাস আগেই ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাত এই চাল রাখার দায় তাদের নয়। তাঁদের ফাঁসানো হচ্ছে। এরপরই রাণাঘাটে রাইস মিলে চাল বদলানোর অভিযোগ ওঠে। যদিও এটাও কোনও বেআইনি কারবার নয় তার ওপর সিলমোহর দিয়েছে সরকার। রাণাঘাটের ভিডিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করায় বিতর্ক ফের বেড়ে গিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রেশন প্রক্রিয়ায় রাজনীতির ছায়া- জাল ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
আরও পড়ুন- কোভিড-১৯: বিজ্ঞান, তথ্য, এবং কিছু বিকৃতি
এদিকে খাদ্য দফতরের সচিবকে বদলি করা হয়েছে। কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি রেশন নিয়ে সরব। বিজেপি দাবি তুলেছে কেন্দ্র খাদ্য-সামগ্রী দিলেও রাজ্য তা রেশনে দিচ্ছে না। অন্য দিকে রাজ্যের খাদ্য মন্ত্রীর দাবি, কেন্দ্র যে পরিমান ডাল দিয়েছে তা অনেক কম। তাছাড়া কেন্দ্রের দেওয়া চাল নিম্ন মানের। বিরোধীরা আবার খাদ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সংকটময় অবস্থায় রাজনীতি আরও বেড়েছে। অথচ মানুষের মধ্যে খাদ্য ও অর্থ সংকট দুইই বেড়ে যাচ্ছে। তাঁদের কাছে এখন একমাত্র ভরসা রেশন-সামগ্রী। এখন অন্তত রেশনে কোনও দুর্নীতি বরদাস্ত করা যায় না। করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধকী রেশন কার্ড ফিরে পেয়েছেন পুরুলিয়ার সার্যূমাতু গ্রামের কয়েকজন গ্রাহক। আবার এই পরিস্থিতিতে উঠে এল পুরুলিয়ার শয়ে শয়ে শবর উপজাতীর রেশন কার্ড ডিলারদের কাছে রাখা থাকে।
খাদ্য দফতরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সপ্তাহে সাড়ে পাঁচ দিন রেশন দোকান খোলা থাকার কথা। সারা বছর কোন জেলায় নিয়মমতো রেশন দোকান খোলা থাকে?এই প্রশ্ন আমজনতার। কোনও খেয়াল থাকে না খাদ্য দফতরের স্থানীয় আধিকারিকদেরও। তা সত্বেও এসব নিয়ে সারা বছর তেমন কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা যায় না। অনেকে আবার রেশন তোলেনও না। কিন্তু এখন মানুষের গভীর সংকট। সবাই যখন রেশন দোকানের দরজা খটখট করছেন তখনই ডিলারদের একাংশ তাদের স্বভাব বদল করতে পারেনি। অনেকেই আবার মন্তব্য করেন, তাঁদের আর কত টাকা আয়। ফায়দা না থাকলে কেউ জীবনভর কি রেশন ডিলার থাকে? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। খাদ্য-সামগ্রী ভর্তি গাড়ি বা ভ্যান যে সবসময় রেশন দোকানের দিকে যায় না এই অভিযোগও নতুন কিছু নয়। এই বিপদে নতুন করে এসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, করোনা আবহে রেশন ব্যবস্থা কড়া হাতে সামলানো দরকার। এক্ষেত্রে কোনওরকম আপোষ করা উচিত নয়। রেশন কাণ্ডেই গ্রামের জনভিত্তি নড়ে গিয়েছিল বামেদের।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন