Advertisment

সাপ্লাই লাইন, মদ কিংবা ছড়িয়ে থাকা রুটি

মদ খাওয়া বিষয়টা নিয়ে আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে এই বাংলায় প্রচুর দ্বন্দ্ব আছে। গরিব মানুষ খাবার খেতে পায় না এদিকে মদ খায়, এই অবাক করার মত বিষয়টা মধ্যবিত্ত বাঙালি বেশ বিরক্তির চোখেই দেখে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lockdown wine shop

লকডাউন শুরু থেকেই মদের দোকান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা জরুরি

মদের দোকান খোলা এবং সেখানে অতিদীর্ঘ জনসারি দেখে দেশ এবং রাজ্যের কোভিড দুনিয়ায় প্রচুর আলোচনা। তবে সবটুকু শুনে মধ্যবিত্তের যে মতামত সামনে এলো তা হচ্ছে মদের দোকানে যারা লাইন দিচ্ছে তাদের বিনা পয়সায় খাবার দেওয়া উচিৎ নয়। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা যে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিরন্ন মানুষের সেবায় রত, সেখানে একজন নিম্নবিত্ত মানুষ, যে কিনা এই ধরণের ত্রাণ নিচ্ছে, তার পক্ষে মদের দোকানের সামনে ধাক্কাধাক্কি করা মহাপাপ। এমনিতেই মদ খাওয়া বিষয়টা নিয়ে আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে এই বাংলায় প্রচুর দ্বন্দ্ব আছে। গরিব মানুষ খাবার খেতে পায় না এদিকে মদ খায়, এই অবাক করার মত বিষয়টা মধ্যবিত্ত বাঙালি বেশ বিরক্তির চোখেই দেখে।

Advertisment

অনুভূতি অনেকটা বহুতলের সতেরো তলার বারান্দা থেকে অনেক নিচে পাশের বস্তিতে খেলে বেড়ানো শিশুদের দেখে গা-রি-রি করার মত। বহুকষ্টে একটি বা দুটি সন্তান প্রতিপালনেই মধ্য কিংবা উচ্চবিত্ত হিমশিম, এদিকে কত নিশ্চিন্তে ভোটার বাড়ছে দারিদ্র্যসীমার নীচে। কিন্তু অন্য উত্তরটা কিছুতেই খুঁজতে চায় না শিক্ষিত সমাজ। সেটা হচ্ছে মদের দোকানে নিম্নবিত্ত ধাক্কাধাক্কি করছে, হয়ত তার কারণ উচ্চবিত্তের মত ঘরে বসেই মদের যোগান তাদের কাছে পৌঁছয় না।

আরোগ্য সেতু বন্ধনেই মুক্তি না আরও বন্ধন করার জন্যই তৈরি এই মোবাইল অ্যাপলিকেশন?

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বৈঠকখানায় ঠাণ্ডা জল আর বিয়াল্লিশ শতাংশ অ্যালকোহল জুটে গেলে তারা কি আর কোভিড জমানায় ধস্তাধস্তি করত? পথ বা রেল দুর্ঘটনার পর যেমন অনেকে অবাক হয়ে উত্তর খুঁজছেন যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাজপথের মাঝখান দিয়ে কিংবা রেল লাইন ধরে হাঁটে কেন? তারা তো ধার দিয়ে হাঁটলেই হত। এর উত্তর অনেক ধরণেরই হয়। তবে তার মধ্যে একটা হল বায়ুসেনার হেলিকপ্টারে চড়িয়েও তো তাদের মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশ পৌঁছে দেওয়া যেত।

মদ খাওয়া যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণভাবে অপরাধ নয়, তাই মদের দোকান খুললে সেখানে মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের শৃঙ্খলাবোধ কোনকালেই জার্মানদের মত ছিল না। তাই সেখানে ধস্তাধস্তি হবে এটাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত মানুষের যা জনসংখ্যা তাতে সামাজিক দূরত্বের গোটা গল্পটা যে কোন বস্তিতেই একেবারে অবাস্তব, চূড়ান্ত নিয়মানুবর্তিতা লাগু থাকলেও। ফলে দেড় মাস বন্ধ থাকার পরে মদের দোকান খুললে মানুষ যে স্কেল দিয়ে মেপে দূরে দূরে দাঁড়াবে না এটা বুঝেই যা ব্যবস্থা সেটা নেওয়া উচিৎ ছিল। সে লাইনে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত উপস্থিত থাকায় বারণ নেই।

তবে এখানে যে বিষয়টি বুঝতে হবে তা হল সচ্ছলের প্রতিনিধি হিসেবে মদের দোকানে লাইন দিয়েছেন অনেক অসচ্ছল মানুষ। তাঁরা নিজে মদ খাবেন না, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানোর সাম্মানিক হিসেবে কিছু টাকা পেয়ে হয়ত খাবারই কিনবেন। ফলে এই মানুষগুলোকে যদি একই দিনে খিচুড়ি বিতরণ এবং বোতল সংগ্রহে সারিবদ্ধ দেখেন, তাতে খুব সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে তারা চালের টাকা বাঁচিয়ে বাংলা খাচ্ছেন। অর্থাৎ সঠিক পরিসংখ্যান এবং সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানে ধন্দ থাকলে গরিব কেন মদের দোকানে লাইনে দাঁড়াবে কিংবা রেললাইন ধরে হাঁটবে এই প্রশ্ন বারবার তোলা যায়। তাতে কোথাও কোথাও খিঁচ লাগে নিজের মননশীলতায়। তবে মনটা মুখোশে ঢেকে সেটা না বুঝতে পারলেই চিত্ত অচঞ্চল।

করোনার নিয়ম তো অনেক, মানা হবে কি?

মোটের ওপর লকডাউন শুরু থেকেই মদের দোকান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন ওঠা জরুরি। দোকান যদি নিয়মিত খোলা থাকত, তাহলে মানুষ যেভাবে রেশন দোকানে, কিংবা সবজির বাজারে যাতায়াত করছে, সেভাবেই মদের দোকানেও যেত। কোভিডের সংক্রমণ চাল কিনতে গিয়ে যতটা ছড়াত, মদ কিনতে ততটাই। এই গোটা ধস্তাধস্তির চিত্রনাট্য লেখার দরকারই হত না, ভয় পেতে হত না যে এতে হঠাৎ করে সংক্রমণ অনেকটা বেড়ে গেল কিনা। আসলে নিয়ম যারা ঠিক করেন তাঁদের একটা মূল বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিৎ, তা হল কোন একটি চালু বিষয় চটজলদি বন্ধ করার আগে মাথা ঠাণ্ডা করে কিছুটা সময় ভাবা প্রয়োজন।

লকডাউনে হঠাৎ করে সমস্ত ট্রেন অল্প সময়ে বন্ধ করে দেওয়ায় সংক্রমণ যে কিছুটা কমেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু শতাংশের হিসেবে তা কতটা লাভজনক তা কিন্তু বোঝা যাবে না কখনোই। এ প্রসঙ্গে খুব সহজ একটা অঙ্কের কথা বলা যাক, যদিও তার উত্তর মেলা কঠিন। মুম্বাইতে আটকে থাকা শ্রমিক তো আর গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার উল্টোদিকে পাঁচটারা হোটেলে থাকছে না, থাকছে কোন বস্তিতেই। চটজলদি লকডাউন ঘোষণার পর সে গেল আটকে। মুম্বাইতে করোনার সংক্রমণ দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি। ফলে সেই শ্রমিক ঘিঞ্জি বস্তিতে সংক্রমণের শিকার হল অকারণে।

তার প্রায় দেড়মাস বাদে যখন সে কোনভাবে ট্রেনে করে বিহার বা পশ্চিমবঙ্গে ফিরল তখন তার কাছ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তুলনায় শুরু থেকেই যদি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার কথা সরকার ভাবত সেক্ষেত্রে হয়ত আজকের থেকে পরিস্থিতি ভালো হতেও পারতো।

হিপোক্রেটিক শপথ বনাম হিপোক্রিসি

অন্যদিকে এমনটাও হতে পারে সরকার যা করেছে সেটাই ঠিক। এর মধ্যে কিছু মানুষের দুর্ঘটনায় মৃত্যু প্রতীকী হিসেবে চিত্তচাঞ্চল্য জাগায়, সংবাদমাধ্যমের ব্যবসা বাড়ায়, কিন্তু আদতে তা ব্যতিক্রম মাত্র। আসলে সবটাই এখানে সম্ভাবনার কথা। তাই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত কী ভাবছেন, তার ওপরই নির্ভর করে সার্বিক সমাজবোধ। নিম্নবিত্ত ভাবেন কি ভাবেন না সেটা ভাবারও দায় নেই কারও। স্বাধীনতার পরে এবং কোভিড পরিস্থিতির আগে এ বাংলায় বাংলা খেয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। সরকার তো আর সমীক্ষার খাতা হাতে তাদের কাছে খবর নেওয়ার জন্যে লোক পাঠায় নি যে তারা ঠিক কি কারণে খাবার না খেয়ে মদ খেয়েছে।

সহজ যুক্তিতে হতাশা ভোলার জন্যে দরিদ্রের নেশা করার যুক্তি উঠে আসে বারবার। সঙ্গে বিপরীতমুখী প্রশ্নটা তো থাকবেই যে নেশা না করলে হতাশা কি কাটত? সবথেকে বড় কথা এই দেশের আশিকোটির বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত। তাদের সকলের জন্যে ন্যূনতম সুবিধেটুকু দেওয়ার কথা কোন শাসকই ভেবে উঠতে পারেন নি। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ সমাধানের পথ আসলে ভীষণ শক্ত। আর সেই পথ একেবারে জটিল হয়ে উঠেছে কোভিড পরিস্থিতিতে। পরিসংখ্যান সেখানে ডাহা ফেল, বরং শাসক পরিচালিত এবং শাসকের বিজ্ঞাপনে পুষ্ট সংবাদমাধ্যম যা খাওয়াবে সেটাই মধ্যবিত্তের মনন-সুরা। আপাতত তাই মদের লাইন ভুলে রেল লাইনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা রুটির ছবি। লকডাউনে মধ্যবিত্তের তর্কে সাপ্লাই লাইন বজায় রাখতে হবে তো — একপক্ষ বনাম অন্যপক্ষে।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Anyo Paksha Lockdown COVID-19
Advertisment