Advertisment

যুক্তি প্রমাণের দুনিয়ায় তথ্যের স্বচ্ছতা

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তথ্য এবং পরিসংখ্যানের পুরো বিষয়টাই “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সহায়তায় তথ্যের সত্যতা বজায় রাখা এবং তা যাচাইয়ের সুযোগ বেড়েছে অনেক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
যুক্তি প্রমাণের দুনিয়ায় তথ্যের স্বচ্ছতা

প্রতীকী ছবি

২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কাজ শুরু হয়েছে স্বচ্ছ ভারতের। যে কোন প্রকল্প নেওয়া হলেই তাতে কিছু কাজ হয়, আবার অনেকটা আশা পূরণ হয় না। তবে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের কাছে পরিচ্ছন্ন বিশ্ব পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই এক ইতিবাচক পরিকল্পনা। গ্রাম এবং শহর এই দুভাগে ভাগ করে জোর দেওয়া হয়েছে এই প্রকল্পে। সাধারণ মানুষের কাছে শৌচালয় ব্যবহারের পরিকাঠামো পৌঁছে দেওয়া এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খোলা জায়গায় নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্মিত শৌচাগার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষকে। ২০১৪ সালের দোসরা অক্টোবর শুরু হয় এই প্রকল্প। সরকারি আকাশপাতায় দাবি করা হয়েছে যে এপর্যন্ত প্রায় দশ কোটি শৌচালয় নির্মিত হয়েছে এই প্রকল্পে। সরকারি পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে পাঁচ বছর আগে মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে দেশের ৩৮.৭০% মানুষ ঢাকা জায়গায় গিয়ে হালকা হতেন, বাকিরা কাজ সারতেন নীল আকাশের নীচে। আজকের দিনে ছাদ, দরজা এবং দেওয়াল দিয়ে বানানো শৌচাগার ব্যবহার করছেন ৯৯.৪৬% মানুষ। অবশ্যই সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিরোধিতা থাকবেই, এবং সেটাই স্বাস্থ্যকর। ঠিক সেই জায়গাতেই প্রশ্ন উঠবে যে এই তথ্য কতটা সঠিক। আরও জটিল প্রশ্ন হল এই সমস্ত পরিসংখ্যান যে সঠিক তার প্রমাণ হবে কীভাবে?

Advertisment

আসলে এই ‘প্রমাণ’ বিষয়টি খুব গোলমেলে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রমাণের কিছু যুক্তি থাকে, এবং সেই যুক্তির ফাঁকও থাকে প্রচুর।

আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার

তাত্ত্বিক প্রমাণের ক্ষেত্রে তুলনায় মুশকিল কম। এই ধরণের প্রমাণে ব্যবহৃত হয় আঙ্কিক যুক্তি। প্রমাণ শুরু করার জন্যে আমরা কিছু প্রাথমিক ধারণা পেশ করি এবং তারপর সেই ভিত্তিতে এগোয় গোটা অঙ্কটা, সম্পূর্ণ হয় প্রমাণ। মনে করার চেষ্টা করতে পারেন মাধ্যমিক স্তরের একটি সহজ জ্যামিতিক উপপাদ্য “ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ”। এটি প্রমাণ করার জন্যেও কিন্তু আমাদের তার আগের অনেক কিছু ধারণা প্রমাণ করতে হয়, যার মধ্যে আছে সমতলের ওপর সমান্তরাল সরলরেখার কিছু ধর্ম। সেগুলো যুক্তি দিয়ে খাড়া করার উদ্দেশ্যে আরও কিছু জ্যামিতি ঘাঁটাঘাঁটি করা অবশ্যকর্তব্য। পেছোতে পেছোতে এমন জায়গায় পৌঁছে যেতে হয় যেখানে কয়েকটি জিনিস ধরে নেওয়া বাধ্যতামূলক। উদাহরণস্বরূপ এইরকম পাঁচটি মৌলিক নীতি সমতলের জ্যামিতির ক্ষেত্রে ইউক্লিড প্রথম জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেসব খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ইতিহাস। একটা প্রমাণে তাই প্রয়োজন প্রচুর প্রস্তুতি, যা অর্জন করতে হয় কয়েক হাজার বছর ধরে।

মুশকিল হল তথ্য এবং পরিসংখ্যান যেখানে চলে আসে, সেখানে এই ধরনের প্রমাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার মূল কারণ আবার অঙ্ক। ধরুন একই বিষয় নিয়ে দুজন দু ধরনের মতামত দিলেন। কেউ বললেন ‘স্বচ্ছ ভারত’ সফল, কেউ বললেন ব্যর্থ। দুজন বলছেন দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এটুকু বুঝতে অসুবিধে নেই যে এই দুটো সিদ্ধান্ত একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না। অর্থাৎ একজন অবশ্যই অসত্য বলছেন। এখানে গেলাস আর্ধেক খালি কিংবা ভর্তির প্রসঙ্গ আসছে, অর্থাৎ পরিমাণের হিসেবে সত্য মিথ্যার হিসাব। কে কেমন ভাবে দেখছেন? ক্ষমতায় যিনি আছেন তাঁর বক্তব্য ইতিবাচক কৌণিক বিন্দু থেকে, বিরোধীপক্ষ খুঁজছেন নেতিবাচক ছিদ্র। সেখানে সমস্যা সমাধানের জন্যে বলা যেতেই পারে যে গেলাসে কত মিলিলিটার জল আছে সেটা সঠিকভাবে পরিমাপ করা হোক। দাগ দেওয়া বিকার এনে সেটা হয়ত মাপা গেল ঠিকঠাক। কিন্তু তারপর প্রশ্ন উঠবে যে জলের গুণমান কেমন? এই জল কি পানীয় হিসেবে ব্যবহার করার উপযোগী, নাকি শুধুমাত্র স্বচ্ছ ভারতের শৌচাগারে ব্যবহার করা যেতে পারে? অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হাজার হাজার প্রশ্ন এবং তার সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা সভ্যতার অগ্রগতির এক মূল্যবান সূচক। গণকযন্ত্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল উন্নতিতে হাতের কাছে তথ্য এখন প্রচুর। কিন্তু মূল মুশকিল হল সেই তথ্যের সত্যতা এবং গুণমান যাচাই করার ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন, স্বাস্থ্য ভিক্ষা নয়, অধিকার

এ প্রসঙ্গে আর একটা অদ্ভুত উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক একশো দিনের কাজ হল তিন বার। একবার কাটা হল পুকুর, একবার বোজানো হল, আর তারপর আর একবার কাটা হল। একবার খুঁড়লেই তো পুকুর বানানো সম্পুর্ণ হত। কেন কাজটা তিনগুণ বাড়ানো হল তার মধ্যে অনেক আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকবে। একই কাজ একাধিকবার করার যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও প্রশ্ন উঠবে সত্যিই কি তিনবার কাজ হল, নাকি পুকুরটা আগেই ছিল? এর সত্যমিথ্যা যাচাই করা সম্ভব মানুষের মুখের কথায়, অথবা প্রযুক্তি নির্ভর ছবি তুলে রাখার মধ্যে দিয়ে। সাক্ষী হিসেবে মানুষের মুখের কথা অবশ্যই পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর প্রযুক্তির সাহায্যেই ছবি নিয়ে অনেক কারসাজি করে ফেলা যায়। তাহলে শেষমেশ প্রমাণটা হবে কিভাবে? এই ধরনের ছোটখাটো বিষয়েই যদি প্রমাণের এতটা অসম্পূর্ণতা থাকে, তাহলে একটা গোটা বাজেটের আগে যে ধরনের সমীক্ষা হয় তার পেছনে থাকা অসংখ্য তথ্যের গুণমান বিচার হবে কিভাবে?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তথ্য এবং পরিসংখ্যানের পুরো বিষয়টাই “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সহায়তায় তথ্যের সত্যতা বজায় রাখা এবং তা যাচাইয়ের সুযোগ বেড়েছে অনেক। রাশিবিজ্ঞান (স্ট্যাটিসটিকস) এবং গণকবিদ্যার (কম্পিউটার সায়েন্স) বিভিন্ন শাখায় এই নিয়ে পড়াশোনা এগিয়ে গেছে অনেকটা। তথ্যের সততার সঙ্গে আসছে তথ্যের সুরক্ষার প্রসঙ্গও। সেখানে বহুল ব্যবহার সঙ্কেতবিদ্যার (ক্রিপ্টোলজি)। সব মিলিয়ে এমনভাবে গোটা বিষয়টা সাজানো যায় যে অনেকটা তথ্যই বিশ্বাসযোগ্যভাবে পৌঁছে যাবে জনসাধারণের কাছে, এবং অঙ্কের নিয়মে প্রমাণ হবে সত্য। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আমাদের দেশে রাজনীতির বিশেষ আলোচনার বিষয় হল ভারতের বিভিন্ন সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে বেসরকারি শিল্পপতিদের প্রচুর পরিমাণে ঋণ নেওয়া। অনাদায়ী ঋণ এবং তার জন্যে সরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষতির পরিমাণ যোগ করলে হিসেবের একক আসে লক্ষ কোটি টাকায়, যা নাকি আজকের অর্থনীতিতে ট্রিলিয়ন নামে পরিচিত। এবার ধরুন প্রত্যেক ব্যাঙ্কের তথ্য এমনভাবে জগতজোড়া জালে ছাপিয়ে দেওয়া হল যাতে ব্যাঙ্কের কিংবা শিল্পপতির নাম না জানা গেলেও, ঋণের পরিমাণ লেখা থাকবে জ্বলজ্বলে অক্ষরে। লেখা থাকবে কোন সময় সুদ বাড়ল কত। অল্প কয়েক হাজার টাকা ঋণখেলাপী চাষি আত্মহত্যা করার আগে একবার ভাবার সুযোগ পাবেন যে লক্ষ কোটি টাকা সাবাড় করে বাড়ির ছাদে সাঁতার বিলাস করছেন অনেক শিল্পপতি। অন্যপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীরা সুযোগ পাবেন গলা চড়ানোর। এইখানেই তথ্যের স্বচ্ছতার প্রয়োজন এবং তার জন্যে খুব ভালোরকম অঙ্ক জানা জরুরি।

আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি

তথ্য সামাল দেওয়া প্রসঙ্গেই প্রায় বিশ বছর আগে ২০০০ সালে রঙ্গরাজন মহাশয়ের সভাপতিত্বে শুরু হয়েছিল ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল কমিশন। সারা দেশে সরকারি তথ্যের সুরক্ষা এবং ব্যাখ্যা নিয়ে এই কমিশনের দায়িত্ব প্রচুর। সম্প্রতি এই কমিশনে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন অধ্যাপক বিমল রায় মহাশয়। নিজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসেবে তাঁকে দেখেছি অনেক দিন। তবে এই লেখায় তাঁর পরিচিতি একেবারে নৈর্বক্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠ ভাবে পেশ করা জরুরি। দেশের শিক্ষামহলে পরিচিত পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত এই মানুষটি। অংক, রাশিবিজ্ঞান এবং গণকবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে যথেষ্ট খ্যাতি আছে তাঁর। সংকেতবিদ্যা এবং তথ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণাতেও তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তথ্যের সুরক্ষা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রশ্নাতীত। সত্তরের দশকে উচ্চমাধ্যমিকে দ্বাদশ এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্সে সপ্তম স্থানাধিকারী এই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র পরবর্তীকালে রাশিবিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে। সেই দুটি ক্ষেত্রেও তাঁর স্থান যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং প্রথম। গবেষণার কাজ বিদেশে সেরে আশির দশকে তিনি বেঞ্চি থেকে চেয়ারে ফেরেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে, সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। সেখানকার অধিকর্তা হন ২০১০ সালে। সম্ভবত ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল কমিশনে তিনি সবথেকে কম বয়সে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে রাজনীতির ঊর্ধ্বের এই মানুষটি অবশ্যই সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের প্রতি জনমানসে অবিশ্বাসের পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে দিতে পারবেন। অতি উচ্চমানের পড়াশোনা করে এবং করিয়ে দেশকে যে প্রচুর সাহায্য করা যায় সেই প্রমাণ তিনি আগেও দিয়েছেন। এবার তাঁর হাত ধরেই নির্ভুল তথ্যের স্বচ্ছতা প্রমাণের অপেক্ষায় রইলাম আমরা। কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ, একটি সঠিক নির্বাচনের জন্য। বাকিটা জানা যাবে যখন ভবিষ্যৎ অতীত হবে, ইতিহাসের পাতায় ঢুকবে সত্যিকারের স্বচ্ছ ভারত।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Advertisment