কিছুদিন আগেই লোকসভায় বাংলার সাংসদের শ্লোগান প্রতিযোগিতা দেখে মুখ টিপে হেসেছিল সারা দেশ। যে বাংলার রাজনীতি একসময় বুদ্ধিজীবীদের উর্বরভূমি ছিল, সেখানকার নেতানেত্রীদের মধ্যে এখন লড়াই মাথার তুলনায় অনেক বেশি পেশীর। সঙ্গে ঠিকানাহীন দলবদল, কাটমানির পাটিগণিত, সব কিছু মিলিয়ে একেবারে তলানিতে চলে গিয়েছে রাজ্যের মান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অধীর চৌধুরী এবং মহুয়া মৈত্রের বক্তব্য অবশ্যই অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে রাজনীতি সচেতন বাঙালিদের। পাশাপাশি দুই জেলার যথাক্রমে কংগ্রেস এবং তৃণমূল সাংসদ তাঁদের বক্তব্যে বারবার বলেছেন উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিপদের কথা। তীব্র সমালোচনা করেছেন ডানপন্থী রাজনীতির। সংখ্যার জোর না থাকলেও, গুণগত মান উন্নত হলে সংসদের একটা ভালো ভাষণ যে সারা ভারতের সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তা প্রমাণ হল মহুয়া মৈত্রের বক্তব্যে। অবশ্যই তার সঙ্গে একই জায়গায় থাকবে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরীর ভাষণ। কম সাংসদ নিয়ে বিরোধী রাজনীতির জোর বাড়াতে গেলে বিধানসভা বা লোকসভায় চেয়ার টেবিল ভাঙা থেকে অযৌক্তিক ওয়াক-আউটের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী দেশ এবং সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। বিজেপির অনেক নেতাও, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীও বেশ গুছিয়ে বলেছেন। কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্যে ধার অনেক বেশি থাকে, আর সেই সুযোগটা পুরোপুরি নিয়েছেন বাংলার দুই নেতা-নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে তলানিতে এসে নেমেছে, সেই অন্ধকারের প্রেক্ষিতে এই আলো দ্বিগুণ উজ্জ্বল। এই ধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক খবর পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে আসে নি।
আরও পড়ুন, নতুন পদে পুরনো নেতা অধীর চৌধুরী: পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় পক্ষ?
অধীরবাবু সঠিকভাবেই বলেছেন এই লোকসভা নির্বাচনে রোগা হয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু দলটার উপস্থিতি এই দেশের সর্বত্র। আসনের হিসেব তলানিতে, কিন্তু মানুষের সমর্থনে একেবারে হারিয়ে যায় নই কংগ্রেস। সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ছিল অধীর চৌধুরীর বক্তব্যে। ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ। এমনটাই তো সংসদীয় গণতন্ত্রের চাহিদা। অধীরবাবু বোঝাতে চেয়েছেন বিজেপি টুকছে কংগ্রেসের দেখানো রাজনৈতিক পথ, আর এড়িয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস আমলের উন্নতির কথা। একথা তো সত্যি যে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে বিজেপি আর কংগ্রেসের খুব মতের তফাৎ নেই। আর সেই প্রেক্ষিতেই অধীরবাবু একটি গভীর রাজনৈতিক চালচিত্র সামনে এনেছেন। কংগ্রেস বেসরকারিকরণ শুরু করেছিল আর এবারের মোদী সরকার সেই কফিনে শেষের দিকের পেরেক পুঁতবেন। বাংলার সাংসদের কথায়, মোদী এবার রাজনীতিটা বেচেছেন ভালো, কংগ্রেস যেখানে অসফল। ডানপন্থার তীব্রতায় আর মধ্যপন্থার মোড়কে আসলে দুদলের নীতি যে অনেকটা কাছাকাছি তাও কি বুঝিয়ে দিলেন অধীরবাবু? আপাতভাবে অধীরবাবুর বক্তব্যের ছত্রে ছত্রে বিজেপি বিরোধিতা এবং কংগ্রেসের প্রশংসা। নিজের দলকে দেশের আত্মা বলে পেশ করেছেন তিনি। তাঁর সহজ সরল শব্দরাশিতে মিশে গেছে পরিমিত আবেগ। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বিজেপির রাজনীতি যে অনেক ক্ষেত্রেই কংগ্রেসের লেজধরা সেই কথা সুকৌশলে পেশ করেছেন তিনি। বিজেপির অত্যন্ত শিক্ষিত এবং মাটির কাছাকাছি থাকা সাংসদ প্রতাপ সারাঙ্গীর অতিরিক্ত মোদীবন্দনাকে ব্যঙ্গ করতে ভোলেন নি। খুঁজে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে নেহেরুর উজ্জ্বল অনুপস্থিতি। বহরমপুরের সাংসদের নাম দিয়ে অন্তর্জাল ঘাঁটলে অনেক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাছে তাঁর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা। ভোটপিপাসু বাঙালির কাছে এ এক শ্লাঘার বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর সরল বক্তব্যের মধ্যে কিন্তু বার্তার অভাব নেই।
আরও পড়ুন, জরুরি অবস্থার স্মৃতি আজও প্রাসঙ্গিক
তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী অনেক সময়েই বামপন্থার গুণগান করেন। সেই দলের সৈনিক হিসেবে মহুয়া মৈত্রের বক্তব্য তীব্রভাবে ডানপন্থা বিরোধী। আর এ রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল সাংসদের ভাষণে তাই বারবার উঠে এসেছে ফ্যাসিবাদের কথা। দেশ যে সেই দিকে এগিয়ে চলেছে তার লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্যে এসেছে বিভাজনের রাজনীতির তত্ত্ব, এসেছে সামরিক জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ। বলেছেন বিভাজনের রাজনীতির হাত ধরে কিভাবে দেশের অন্তরাত্মা কার্যত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণগুলো যে বিজেপির সাংসদেরা দেখতে পাচ্ছেন না সেই নিয়ে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন গুণী মানুষের কথা থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন মহুয়া। তবে তাঁর বক্তব্যের সবথেকে ভালো অংশ নাগরিকপঞ্জী নিয়ে বক্তব্যে — “এই দেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাঁদের গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রির স্বপক্ষে নথি দেখাতে পারেন না। অথচ দাবি করা হচ্ছে যে দরিদ্রতম মানুষটিকে তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণে নথি দাখিল করতে হবে!” রাজনৈতিক নেতাদের ডিগ্রি না থাকলেও তাঁরা যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার শংসাপত্র নিয়ে গোলমালে পড়ে যান, সেকথা সংসদে মনে করিয়ে দিয়ে উচিৎ কাজ করেছেন তৃণমূলের এই নেত্রী। সামরিক জাতীয়তাবাদের আলোচনায় তিনি তুলে এনেছেন দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এক, সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব সরকারের বলে দাবি করা এবং দুই, জাতীয় নিরাপত্তার নামে দেশজুড়ে এই ভয়ঙ্কর উন্মাদনার সৃষ্টি হওয়া। দুইয়ের জন্যেই বিজেপিকে সরাসরি দায়ী করেছেন তিনি। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করে একমাত্রিক রাজনীতি এবং তার অনুসিদ্ধান্তে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের আগমনী গান তিনি ভালোই গাইলেন। লোকসভায় তাঁর পরবর্তী বক্তব্যগুলো শোনার অপেক্ষায় থাকবে বাংলা এবং হয়ত অন্য রাজ্যের মানুষও।
আরও পড়ুন, মুজফফরপুরের মহামারীর রাজনীতি
অপেক্ষা এখন বাংলা থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদের কথা শোনার জন্যে। বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চট্টোপাধ্যায় বা দিলীপ ঘোষ বিজেপির সমর্থনে জমিয়ে বলবেন এ আশা করাই যায়। বক্তব্য ভালো হলে তাঁরাও অনেক হাততালি পাবেন। তবে বাঙালি মধ্যবিত্তের একাংশের মনের কোণে একটা ব্যথা চিনচিন করবেই। যদিও মুখ ফুটে সেকথা বলা যায় না। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত কিংবা গুরুদাস দাশগুপ্তের মত বামফ্রন্টের বক্তারা এখন ইতিহাসের পাতায়। সংসদীয় গণতন্ত্রের অঙ্কে তাঁদের দলের সাংসদদের উপস্থিতি খুঁজতে দূরবীন লাগবে নিম্নকক্ষে। বামপন্থার কথা তাই এবার তৃণমূল আর কংগ্রেসকেই বলতে হবে। বিজেপির অন্তত সে দায় নেই। আর বিরোধী ঐক্যের সুরে এ রাজ্যেও মুখ্যমন্ত্রী বাম-কংগ্রেসকে বার্তা দিচ্ছেন প্রকাশ্যে। কিন্তু জোট হলেই পাটিগণিতের নিয়মে ভোট বাড়ে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে মহাজোটের তত্ত্ব হয়ত বিজেপিকেই আরও শক্তিশালী করে দিতে পারে। তাই অধীরবাবু বা মহুয়াদেবীর বক্তব্য লোকসভায় আলোড়ন তুললেও বাংলার ভোট রাজনীতিতে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব খুঁজতে চেষ্টা না করাই ভালো।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যাক্তিগত।)