ভারতের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা লোকসভা নির্বাচন এবার শেষ হতে চলেছে। শেষ পর্বে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকে সমগ্র দেশের নজর। এক মস্ত বড় প্রশ্ন হলো, এবার পশ্চিমবঙ্গে কি বিজেপির আসন সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যাবে? এই প্রশ্নটাকেই একটু বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করা যেতে পারে। প্রশ্নটা একটু অন্য ভাবে করা যাক। বাঙালি কি তাহলে এতদিন পর বিজেপিকে মতাদর্শগত ভাবে গ্রহণ করছে?
লালকৃষ্ণ আডবানীর রথযাত্রার সময় আমি ওঁর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসেছিলাম। তখন গোটা দেশে রামমন্দির আন্দোলন সফল হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি রামকে গ্রহণ করেনি। সেটা ছিল ১৯৯০ সালের কথা। আজ এত বছর পর কলকাতায় ধর্মতলা থেকে যে রোড শো শুরু হলো, তাতে প্রথম শুনলাম 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি। হিন্দিভাষী পশ্চিমবঙ্গবাসী নয়, একদম বাঙালির মুখ থেকে শোনা গেল এই ধ্বনি। এ এক নতুন বাংলা। এই বাংলাকে আমি এর আগে কখনও দেখি নি। ভোটের ফল কী হবে? বিজেপি কতগুলি আসন পাবে? শতকরা ভোটই শুধু বাড়বে নাকি আসনও বাড়বে? এসব তো পৃথক বিশ্লেষণ, কিন্তু এবারের ভোট দেখে আমি নিশ্চিত যে বাঙালি মননেরই এক বিরাট পরিবর্তন হচ্ছে। বাঙালির এই 'ডিএনএ' বদলে বামপন্থী বাঙালি রামপন্থী হয়ে উঠছে কীভাবে?
ডায়মন্ড হারবার নামক লোকসভা কেন্দ্র। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার অধীন। এখানে তৃণমূল প্রার্থী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই এলাকায় বাস স্ট্যান্ডের কাছে রাস্তার ধারে এক ছোট চায়ের দোকান। দোকানে মাছ-ভাত, ডিম-ভাত বিক্রি হচ্ছে। বাস কন্ডাক্টর, স্থানীয় শ্রমিক, অন্যান্য সাধারণ মানুষ বেঞ্চিতে বসে মধ্যাহ্নভোজন করছেন। দোকানটি চালাচ্ছেন এক মধ্যবয়স্কা গৃহবধূ। তাঁকে প্রশ্ন করলাম, "কী হবে এবার দিদি?" জবাবে মহিলা প্রথমে মাথায় ঘোমটা টেনে বললেন, "বলা মুশকিল, কী যে হবে।" তারপরই বললেন, "যখন এরাজ্যে সিপিএম-কে তারিয়ে তৃণমূল হঠাৎ ক্ষমতায় এসে গেল, তখন বুঝতে পেরেছিলেন? বুঝতে পারেন নি। আজও বুঝতে পারছেন না বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস বিদায় নিচ্ছে আর বিজেপি আসছে।" কী সাংঘাতিক এক বিবৃতি।
আমার সঙ্গে ছিলেন ক্যামেরাম্যান অনিল মিত্র। তিনি বললেন, "এই কথাটা আপনি ক্যামেরার সামনে বলবেন?" মহিলা নির্ভয়ে তাও বলে দিলেন। আমি বললাম, "কী করে জানলেন গোটা রাজ্যের কথা? আপনি তো থাকেন এই গ্রামে।" মহিলা বললেন, "আমার ছেলে গাড়ির কন্ট্র্যাক্টারি ব্যাবসা করে। জেলায় জেলায় ওর গাড়ি যায়। জেলা শাসকদের অফিসেও গাড়ি চলে। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্র। তা আমার ছেলে বলছিল, 'মা, এবার বিজেপিকেই ভোট দেব আমরা। কারণ সব জায়গায় জিতছে বিজেপি'।"
ছেলে বলেছে বলে আপনি বিজেপিকে ভোট দেবেন? "দেখুন ছেলেরা অনেক সময়ে মায়ের কথা শোনে না, কিন্তু মা ছেলের কথা শোনে সব সময়েই। গতবার ভোট দিয়েছিলাম তৃণমূলকে, এবার দেব বিজেপিকে।" এটা একটা বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা। কিন্তু অনেক সময় হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় ভাত কতটা সেদ্ধ হয়েছে। এ হলো বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।
২০১৪ সালে গোটা দেশে মোদী ঝড় থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়েছিল দুটো আসন। তার মধ্যে একটা আসন ছিল দার্জিলিংয়ের। এবার ২০১৯ সালে যখন প্রশ্ন উঠছে উত্তরপ্রদেশ তথা হিন্দি বলয়ে সেই মোদী ঝড় নিয়েই, তখন পশ্চিমবঙ্গে মোদীর জনপ্রিয়তা ২০১৪ সালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যাদবপুর কফি হাউসের এক অধ্যাপকের মন্তব্য, এটাই হল রাজনীতির প্যারাডক্স।
এখন প্রশ্ন হলো, বাঙালি কি 'জয় শ্রীরাম রাজনীতি' গ্রহণ করছে? আসলে বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থী র্যাডিকাল রাজনীতি এবং তথাকথিত বৌদ্ধিক চর্চা দেখতে দেখতে অনেকটা ক্লান্তও বটে। সিপিএম তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকেছে, কিন্তু রাজ্যের আর্থসামাজিক মানের উন্নতি তো দূরের কথা, আরও অবক্ষয় হয়েছে। এরপর এসেছে তৃণমূল। তৃণমূল তো এই কু-সিপিএমের এক পরিবর্তন। বাঙালি কিন্তু সম্প্রতি আরও বেশি ধর্মকর্ম আস্তিকতা পুজো আচ্চার মধ্যে ঢুকে গেছে। বাঙালি আগেও যথেষ্ট ধর্মবিশ্বাসী ছিল, কিন্তু আজ কুসংস্কারের প্রকোপ আরও বেড়েছে। দক্ষিণেশ্বর ও কালীঘাটে দেখছি এখন দৈনিক দর্শনার্থীদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু গোটা বিশ্বেরই ‘ট্রেন্ড’। মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে যে 'God is Back', অর্থাৎ মানুষ আবার দুর্বল হয়ে পুজো করছেন। কুসংস্কার বিশ্বাস করছেন। এর কারণও আর্থিক মন্দা দুনিয়া জুড়ে।
পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ৩০ ভাগ সংখ্যালঘু। এই ভোট ব্যাঙ্ককে বিজেপি ছাড়া সকলেই তুষ্ট রাখতে চায়। বিজেপি এখন এই হিন্দু বা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের তাস খেলছে। হিন্দিভাষী শুধু নন, বাঙালি হিন্দুও এই মেরুকরণের রাজনীতিতে ভোটের সময় বেশ তেতে উঠেছেন।
ক্ষিতিমোহন সেন হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, গঙ্গার জল সাদা যমুনার জল কালো। পদ্মার পানি সাদা মেঘনার জল কালো। তাই গঙ্গা-যমুনা বা পদ্মা-মেঘনা নদীর সঙ্গমের পরও অনেক দূর পর্যন্ত একই ঘাটে সাদা ও কালো, এই দুই স্রোত পাশাপাশি চলতে দেখা যায়। সাগরের নীল জলের মধ্যে নদীর ধারা মিশলেও অনেক দূর পর্যন্ত নীল জলরাশির মধ্যে নদীর জলের পরিচয় পাওয়া যায়। জলের রঙ দেখে পাকা নাবিক নদীর সান্নিধ্য টের পান। ভারতে প্রচলিত হিন্দুধর্মের মধ্যেও প্রদেশগত ও নানাবিধ মানব শ্রেনীগত বিশেষত্ব আছে। এই সব লক্ষণ অনুসারে হিন্দু ধর্মও অনেকরকম। ব্রাহ্মাবর্তের কথা বলতে গিয়ে মনু বলেছিলেন, যে দেশে যা পরম্পরাগত আচার, তাই সদাচার। ব্যবহার ময়ূখকার নীলকন্ঠ বলেন দাক্ষিণাত্য বিপ্রেরা মাতুল কন্যা বিবাহ করেন, মধ্যদেশে কর্মকার ও শিল্পীরা গোমাংস খায়, পূর্বদেশে মৎস্য ও নারী ব্যাভিচার চলে, উত্তরে নারীরা মদ্যপায়ী। আচারাধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক্য তাই বললেন, যস্মিন দেশে য আচারো ব্যবহারঃ কুলে স্থিতিঃ। তথৈব প্রতিপাল্যে যদাবিশমুলাগতঃ।।
তিরুপতিতে বিষ্ণুর যে উপাসনা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুর বৈষ্ণবধর্ম, গৌড়িয় বৈষ্ণব। রাম উত্তর ভারতে ঠিক যে ভঙ্গিতে পূজা পান, পশ্চিম বাংলায় রঘুবীরের পুজো বা রামনবমী হলেও তার ধরন আলাদা। এখন বিশ্বায়নের ফলে উত্তর ও পূর্ব ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিল অনেক বেড়েছে। তাই বহু ক্ষেত্রে বাঙালির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আসছে। এক নতুন বাঙালি জন্ম নিচ্ছে, যে বাঙালি এখন মতাদর্শগত ভাবে বিজেপিকেও গ্রহণ করছে। এখানেই এক নতুন বাংলাকে ভোটের সময় দেখছি। মা-মাটি-মানুষের বদলে দেখা যাচ্ছে নতুন স্লোগান, মা-মাটি-মোদী।
ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হতে চলেছে ২৩ মে। ভোটের ফল গোটা দেশে কী হবে, পশ্চিমবঙ্গে কী হবে, তা জানি না। কিন্তু এবার গোটা দেশে যখন এই আলোচনা হচ্ছে যে ২০১৪ সালে বিজেপির যে ঝড় আমরা দেখেছি, ২০১৯-এ তা নেই কারণ অধিকাংশ হিন্দি বলয়ের রাজ্যে বিজেপি প্রায় ব্যাকফুটে চলে গেছে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টি পেয়েছিল, তার ওপর এবার হয়েছে মায়াবতী আর অখিলেশের মহাগঠবন্ধন। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের আশা, যদি হিন্দি বলয়ে আসন সংখ্যা কমেও যায় তাহলেও পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ ভারত থেকে আসন বাড়বে। ফলে নতুন রাজ্য থেকে নতুন আসন ঘাটতি পূরণ করে দেবে। প্রায় ১২৫টা আসন এমন হবে যেগুলো বিজেপির নতুন আসন। এমন পরিসংখ্যান দলের সভাপতি অমিত শাহ নিজেই দিয়েছেন।
পশ্চিম বাংলায় বিজেপি যে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে, সে ব্যাপারে তো কোনও সন্দেহ নেই। আবার কংগ্রেসকে কলকাতায় বলা হচ্ছে ‘মাম’ পার্টি, মানে মালদা আর মুর্শিদাবাদের পার্টি। সিপিএমের শতকরা ৩০ ভাগ ভোট ব্যাঙ্ক ছিল, সংঠন ও নেতৃত্বের সঙ্কটে বহু বামপন্থী শুধু মমতার বিরুদ্ধে ভোট দিতে চাইছেন। গোটা দেশে মোদী ঝড় প্রশমিত হলেও পশ্চিম বাংলায় কিন্তু উল্টো চিত্র। এখানে বিজেপি এখনও রাজ্যস্তরে পরীক্ষিত শাসক দল নয়। তাই বামপন্থীদের এ হল tactical ভোট। সন্তোষপুরের এক চায়ের দোকানের আড্ডায় বামপন্থীরা বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন, এখন তো সিপিএমকে ভোট দেওয়ার মানে ভোটটা নষ্ট করা। জানেন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শক্তি আবার আসতে পারে যদি রাজ্যে তৃণমূলের জায়গায় বিজেপি আসে। তখন বিজেপির সঙ্গে কমিউনিস্টদের মতাদর্শগত লড়াই শুরু হবে এ রাজ্যে, বিকাশ হবে বামেদের।
কী অদ্ভুত ব্যাপার। এজন্য আপতত বামপন্থীরা রামপন্থী হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির এই বিজেপি-প্রেম ক্ষণস্থায়ী, নাকি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, সেটা এখনই বলা কঠিন। এই বিজেপি-প্রীতি ভোটে কতটা প্রতিফলিত হবে, এ প্রশ্নটাও থেকেই যাবে। তবে এটা বলতেই পারি, শুধু হিন্দিভাষী নন, বাঙালিরাও অধিকাংশ মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদীর আর একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
দিল্লি থেকে রাজ্যওয়ারি পরিস্থিতি দেখে শুধু এটুকু বলতে পারি, এবার নরেন্দ্র মোদী নিজে যেভাবে পরিশ্রম করেছেন, যেভাবে একের পর এক জনসভা করেছেন, তা অভূতপূর্ব। গায়ের রঙ কালো হয়ে গেছে রোদে পুড়ে। ওজনও কমেছে। বার বার কুর্তার রঙ বদলেছেন জনসভায় - কখনও সাদা, কখনও হালকা হলুদ বা গেরুয়া। ২৩ তারিখ কী রঙের পাঞ্জাবি পরবেন তিনি, সেটাই দেখার।
(জয়ন্ত ঘোষাল দিল্লিতে কর্মরত বর্ষীয়ান সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত)