/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/10/me-too-1.jpg)
প্রত্যাশিতভাবেই বিদেশ-প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর ‘#মিটু’-আন্দোলনে তাঁর বিরুদ্ধে যৌনহেনস্থার অন্যতম অভিযোগকারিণীপ্রিয়া রমানির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কর্মক্ষেত্রে যৌনলাঞ্ছনার প্যান্ডোরাবাক্সটি খুলে দিয়েছিলেন যিনি, সেই প্রিয়ার বিরুদ্ধে সোমবার মামলা দায়ের করে তিনি কার্যত সকলকেই আইনি জুজু দেখিয়ে রাখলেন। বিষয়টি মোটেই কার্যকারণহীন নয়। কেননা, আগেভাগেই আকবরের হয়ে ব্যাট করতে নেমে অমিত শাহ এমন ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। মনে হওয়া অবাস্তব নয় যে, প্রধানমন্ত্রীর চিত্রনাট্য মেনেই (কেননা, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই সরকারের পাতা নড়ে) রবিবার আকবর উত্থাপিত অভিযোগগুলি নস্যাৎ করে জানিয়ে দেন, তিনি অভিযোগকারিণীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানায় বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি যখন একাদিক্রমে হয়ে উঠছে ধর্ষণের রাজপুরী, ধর্ষণের অভিযোগে জেলে যেতে বাধ্য হয়েছেন কুলদীপ সিং সেঙ্গারের মতো দলীয় বিধায়ক, তখন ঘটনার গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য কোনও জ্যোতিষীর প্রয়োজন ছিল না। সঙ্ঘের আকবর-বিরোধিতা বা কেন্দ্রের তিনজন মহিলামন্ত্রী প্রকাশ্যে মিটু-আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ালেও, তা-ও যে চিত্রনাট্যেরই অঙ্গ, তা বুঝতেও রাজনৈতিক মনীষা বাহুল্যমাত্র। সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই জেনেছে, মনুবাদী শাসকদলটি দর্শনগতভাবেই নারীবিরোধী। সে-ক্ষেত্রে আকবরের মতো এক অভিযুক্ত সাধারণ মন্ত্রীকে রক্ষা করাও তাদের রাজনৈতিক দায়। সেই লক্ষ্যে এই সরকার ইতিমধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যা পড়ানোর আর্থিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছে। এবার আকবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কেবল দেশের সরব মেয়েদের বা নিজের তিন নারী-সহকর্মীকেই বিদ্রুপ করলেন না, দেশের প্রতিটি নারীকেই চেতাবনি দিয়ে রাখলেন। নতুন করে বোঝালেন, তর্জনীই স্বৈরাচারের একমাত্র আয়ুধ। তবে, আগে কুলদীপের ক্ষেত্রে শেষরক্ষা হয়নি, এবারও হবে কি না, তার উত্তর জানে সময়। আমেরিকায় মিটু-আন্দোলনের জেরে জেলে গেছেন হলিউডের সম্রাটপ্রতিম প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টাইন। দেশেও যে এই আন্দোলন শাসকের যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ হয়েছে, তীব্রতর হয়েছে তার অভিঘাত, আকবরের ঘটনা তারই প্রমাণ। আপাতত সেখানেই মিটু-র সদর্থকতা।
আরও পড়ুন, #MeToo: মুখ খুললেন মন্দাক্রান্তা সেন
২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী অ্যালিজা মিলানো টুইটারে ‘#মিটু’ শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘যেসব মেয়ে জীবনে কখনও নিগৃহীতা হয়েছেন, তাঁরা যদি এই পরিসরে নিজেদের অভিজ্ঞতা জানান, তাহলে সমস্যাটির বিস্তার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হতে পারে। রচিত হতে পারে ভিন্ন-প্রতিবাদক্ষেত্র।’ সেই বার্তা থেকেই ‘মিটু’-আন্দোলন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে এ এক শান্ত-বিস্ফোরণ, ভিন্নমাত্রিক-পরিসররচনা। পৃথিবীর-বিভিন্ন-ক্ষেত্রে-বিখ্
বিদেশের ‘মি টু’ স্বভাবতই প্রভাববিস্তার করেছে স্বদেশেও। বস্তুত, রক্ষণশীল ও ভণিতাসর্বস্ব ভারতীয় সমাজে এই ঢেউ উঠেছিল ত্রিশ-বছর আগে পাঞ্জাবে। ১৯৮৮ সালে একটি পার্টিতে রাজ্যের পুলিশপ্রধান কানওয়ার পল সিং গিল আইএএস-আমলা রূপান দেওয়ল বাজাজের নিতম্বস্পর্শ করেন। রূপান তখন রাজ্যের অর্থ-দফতরের কমিশনার। রাজ্যপাল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে তাঁর প্রিয়পাত্র গিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কোনও ফল পাননি রূপান। তিনি আদালতে গেছেন। সকলের চোখের সামনে ওই কদর্য ঘটনা ঘটলেও, নিম্ন-আদালত ও হাইকোর্ট সাক্ষীর অভাবে তাঁর অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছিল। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দোষীসাব্যস্ত হন গিল। শীর্ষ আদালত বলেছিল, নিগৃহীতার বয়ান যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে সাক্ষীর প্রয়োজন থাকে না। ঘটনার পরের বছরই রাজীব গান্ধীর সরকার অভিযুক্ত গিলকে পদ্মশ্রী-সম্মানে ভূষিত করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে ভারতীয় ওলিম্পিক সংস্থা অবশ্য হকি ফেডারেশন থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়। তখনই দেশ বিস্মিত হয়েছিল এই ভেবে যে, দেশে একজন আইএএসের যদি এই হাল হয়, তাহলে সাধারণ প্রান্তিক মেয়েদের দশা কতটা মারাত্মক হতে পারে!
রূপানের মতোই আজ সরব হয়েছেন দেশের আলোকপ্রাপ্ত মেয়েরা। তবে, ‘মিটু’-র দুই-দশক আগেই বাংলায় এই ধারার সুচনা করেছিলেন তসলিমা নাসরিন। প্রখ্যাত ও প্রবীণ লেখকরা নানা সময়ে তাঁর প্রতি কীভাবে যৌনাকুল হয়েছিলেন, আত্মজীবনীতে তা সবিস্তার লিখেছিলেন তিনি। পরে, টুইটারে যৌননিগ্রহের অভিযোগ করেছিলেন একদাঘনিষ্ঠ মৃত্যুমুখী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বাংলাভাষায় সেই ধারার সুচনা হলেও, সম্প্রতি রাজ্যের কোনও নারীনক্ষত্র এখনও বলেননি, ‘আমিও’। একদা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছেল। তারপর সব শান্তিকল্যাণ। হলিউডে ‘মিটু’-র সূচনায় বলিউডের প্রবীণ নৃত্যপরিচালক সরোজ সিং-ই প্রথম সুযোগশয্যার অভিযোগ তোলেন। তিনি অবশ্য ওই ব্যবস্থার মধ্যে কোনও অসঙ্গতি দেখেননি। তারপর বোমাটি ফাটান ডাকাবুকো সাংসদ রেনুকা চৌধুরি। তাঁর অভিযোগ ছিল, সংসদীয় রাজনীতিতেও সুযোগশয্যা কম পরিব্যাপ্ত নয়। পরে অবশ্য নিজের অভিযোগ গিলতে হয়েছিল রেনুকাকে। হলিউডের প্রভাবে সম্প্রতি বলিউড থেকে ক্রিকেট ও রাজনীতির জগতে তৈরি হয়েছে ‘মিটু’-র নিদারুণ অভিঘাত। অভিনেতা নানা পাটকর, লেখক চেতন ভগত সুহেল শেঠ, প্রযোজক গৌরাঙ্গ দোশি, পরিচালক সুভাষ ঘাই সাজিদ খান বিকাশ বহেল, টেলিস্টার অলোকনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত ও বিনতা নন্দা ও নবনীত নিশান, ফ্লোরা সাইনি প্রমুখ। অভিযোগের নিশানায় আছেন ক্রিকেটকর্তা রাহুল জোহরি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি-পরীক্ষকরাও।
কিন্তু, সকলকে ছাপিয়ে গেলেন আকবর। তেমনই অনিবার্য ছিল। কেননা, অন্যান্য অভিযুক্তের তুলনায় তিনি অনেক বেশি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর। আশাবাদী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ভেবেছিলেন, বিদেশভ্রমণ সেরে দেশে ফিরলে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে পদত্যাগের কথা বলবে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ক্ষমতার অন্দরমহলে নাকি আকবরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিং, নিতিন গডকড়ী, সুষমা স্বরাজ। অভিযোগকারিণীদের পক্ষে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন তিনজন মহিলামন্ত্রী মেনকা গান্ধী, নির্মলা সীতারমণ ও স্মৃতি ইরানি। সকলেরেই এক সুর, নিগৃহীতা মহিলারা নিজেদের জড়িয়ে মিথ্যা বলছেন এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মনে করা হয়েছিল, মোদীর মন্ত্রীরা কখনও স্বকণ্ঠে কথা বলেন না। নাগপুরও আকবরকে নিয়ে ক্ষোভ গোপন রাখেনি। এবিভিপি-র রশ্মি দাস সংবাদপত্রে আকবরের মন্ত্রিত্বে থাকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আরএসএসের দত্তাত্রেয় হোসবালেও দলের ফেসবুক-আধিকারিক আঁখি দাসের ‘মি টু’-র সপক্ষ পোস্ট শেয়ার করেছেন। কিন্তু, অমিত শাহ যখন সব বিতর্কে জল ঢেলে বলে দিলেন, অভিযোগের সত্যতা সন্দেহাতীত নয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল, আকবরের রক্ষাকবচ স্বয়ং-প্রধানমন্ত্রী। ফলে, আকবরের মতো একজন ধারাবাহিক-অভিযুক্ত যে সব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক’ বলে উড়িয়ে দেবেন, তা ছিল অনুমিতই।
আকবরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন চোদ্দোজন সাংবাদিক। সেই মেয়েরা যে একযোগে নির্দিষ্ট অভিসন্ধিতে আকবরের মতো অকিঞ্চিৎকর রাজনীতিকের সম্মানহানির চক্রান্ত করেছেন, এমন-কোনও প্রমাণ নেই। প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে যাওয়ায়, আকবরের নাগালের বাইরে যেতে পেরে ভুক্তভোগী মেয়েরা এখন একে-একে সরব হয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে। হলে হবে কী! স্বৈরাচারীর কাছে গণতান্ত্রিক বিরুদ্ধ-মতের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। আবার বিপরীতভাবে আছেও। সে-কারণেই আকবরের ক্ষেত্রে যা ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’, নানা পাটকরের বিরুদ্ধে তা-ই সত্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে শাসকের কাছে। আমরা দেখেছি, সরকারবিরোধী নানার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে মহারাষ্ট্র পুলিশ। শাসক চিরকালই মুদ্রার পছন্দসই দিকটি বেছে নেয়।
তবু, আকবরের প্রত্যাঘাতে ও প্রধানমন্ত্রীর এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ‘মি টু’-র মতো একটি স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের প্রাথমিক জয়ই সূচিত হল। দেশের মেয়েরা চেনাতে পারলেন রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ভিন্ন-পরিসরটিও। কেননা, পাপ্পু যাদবদের মতো দুর্বৃত্তদের এতদিন সহজেই চেনা গেছে। এখন তথাকথিত শিক্ষিত-দুর্বৃত্তদের চেনাবার কাজটির সূচনা অন্তত করল এই আন্দোলন। কেননা, ‘আমিও লাঞ্ছিতা’ বলার মধ্যে যে-গ্লানিবোধ রয়েছে, এই মেয়েরা তা সহ্য করেই বৃহত্তর স্বার্থে প্রকাশ্য হচ্ছেন। আদালতনির্ভরতা নেই তাঁদের। তাঁরা কেবল এই কলরবটুকু সৃষ্টি করতে চান যে, এই দেশ মেয়েদের কাছে এখনও নরকতুল্য। দেশের মেয়েরা আজও রূপ কানোয়ারের মতোই আধিপত্যের শিকার।
কিন্তু, একটি বিপরীত প্রশ্নও উঠে আসে এই উচ্চকোটির আন্দোলন ঘিরে। দেশের খ্যাতজনরাই আপাতত অভিযোগের আঙুল তুলছেন খ্যাততরদের বিরুদ্ধে। বিতর্কের অবতারণা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। অথচ, এই নরকের দেশে সাধারণ প্রান্তিক নারীরা প্রতি-মুহূর্তে নিগৃহীত হচ্ছেন পারিবারিক বা সামাজিক পরিসরে। তাদের কোনও মুখপত্র নেই, তারা মূক ও নিরক্ষর। তাদের সামনে কেবল ঝুলে থাকে বিজ্ঞাপনবাহিত ‘বিটি বাঁচাও, বিটি পড়াও’-এর স্তোকবাক্য। এই আন্দোলন যদি তাঁদের কোনও দিশা দেখাতে না-পারে, তাহলে তা কি শেষপর্যন্ত অভিজাতদের শৌখিন মজদুরিতে পর্যবসিত হবে না?