ভারতবর্ষের ধর্মচর্চায় দেখি অন্যতম প্রধান এক স্থান নিয়েছে জল। ‘ভারতীয় ধর্ম’ বলবার কারণ ঋগ্বেদের প্রাচীন অংশ কিংবা তার বেশ পরবর্তী সময় অবধিও এখানে হিন্দু বা অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নাম সেভাবে শোনা যায় নি। ‘হিন্দু’ শব্দ, সকলেই জানেন, এদেশের শব্দমঞ্জুষায় এসেছে আলেক্সান্ডারের সময়, সিন্ধুনদীর নাম উচ্চারণে অপারগ গ্রিক সেনানীদের জিহ্বা হয়ে। সেদিক থেকে বরং ভাবতে ভালো লাগে একটি নদীর নামেই আমাদের দেশের নাম।
এদেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি বরাবরই পর্বত নদী ঝর্ণা মেঘের মত প্রকৃতির নিজস্ব জিনিসগুলির অর্চনা করেছে। এই অর্চনার প্রধান অংশ ছিল সংরক্ষণ। যত্নে রক্ষা করা। একটি কৃষি-সংস্কৃতির দেশ সবচেয়ে যত্নশীল হবে তার জল সরবরাহ ও জল সংরক্ষণ বিষয়ে এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য তাই জলের কথা উপকথায় ভরা।
বেদের কথা বাদ দিলে যে দুটি সাহিত্যকর্ম এ দেশের আপামর জনমানুষের কাছে খুব পরিচিত, সেগুলি হল রামায়ণ আর মহাভারত। নানাভাষায়, নানা জনগোষ্ঠীতে এই দুই মহাকাব্যের নিজস্ব রূপ আছে। সব ভিন্নতা সত্ত্বেও একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে প্রতি জনগোষ্ঠী নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে, মূল্যবোধে, নানা জীবন্ত প্রসঙ্গে এই দুটি বইয়ের সঙ্গে অতি সহজে পরিচিত। এই মহাকাব্যে কতো জায়গায় কীভাবে যে ধারাজল অথবা জলাশয়ের কথা আছে, খেয়াল করলে পাঠক পরমাশ্চর্য হয়ে থাকেন।
মহাভারতের সূচনা ও অবসানে যে ভাবে দুটি দ্বীপ ও জলের, ব্যাসদেবের জন্মস্থান গঙ্গার দ্বীপ ও দুর্যোধনের মৃত্যুর পটভূমি দ্বৈপায়ন হ্রদের ফ্রেমে যেন সমগ্র উপাখ্যানটিকে বাঁধা হয়েছে- সে বিষয়ে এই কলামে আগে একবার কথা হয়েছিল। অমন বিরাট তাৎপর্য ছাড়াও জলের কথায়, জলাশয়ের মহিমার কথায় মহাভারতের মহা-আখ্যানটি যেন সিক্ত হয়ে আছে। তার সামান্য একটি খণ্ডে নজর দিয়ে দেখা যাক।
কৌরবপক্ষের অসাধু উপায়ে পাশাখেলায় হেরে পাণ্ডবরা চুক্তিমত বারো বছরের জন্য বনবাসে এসেছেন। তাঁরা চান এমনভাবে এই দীর্ঘ সময়টি কাটাতে যাতে কিছু ভালোজায়গা দেখা ও শিক্ষালাভ হয়। ‘বনপর্বে’ পাণ্ডবেরা একের পর এক অরণ্যবাসী তপস্বীদের কাছে যাচ্ছেন বনবাসকালে কোনকোন জায়গায় যাওয়া তাঁদের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে, সেই সন্ধান জানতে। অনেকের মধ্যে মহাঋষি পুলস্ত্য ধার্মিক রাজপুত্র যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিচ্ছেন নানা তীর্থে যেতে।
এইখানে আমরা আবিষ্কার করি এই কথার সত্যতা যে ‘তীর্থ শব্দের আসল অর্থ হল সরোবর বা নদীর ঘাট’। পুষ্কর, প্রভাস, কোটিতীর্থ, দমী, বরদান তীর্থ- প্রত্যেকটিতেই ঋষিরা বলছেন ডুব দিয়ে স্নান করার কথা। ‘বরদান তীর্থে অদ্যপি ত্রিশূলাঙ্কিত পদ্মসকল দৃষ্ট হয়, তথায় ভগবান ভবানীপতির সান্নিধ্য আছে।...রেণুকাতীর্থে স্নান করিলে চন্দ্রমার ন্যায় নির্মলকান্তি...’ ‘বনমধ্যস্থ বড়বাতীর্থে সন্ধ্যাসময়ে স্নান করিয়া ভগবান হুতাশনকে যথাসাধ্য চরু নিবেদন’ করার সুফল বলবার সঙ্গে সঙ্গেই আছে জলাশয়টির অমন নামের কারণ- বিষ্ণু জলস্থলের সকল প্রাণীদের চরুদানে প্রসন্ন হয়ে তাদের সকলকে বর দিয়ে ‘জলদজালমধ্যস্থ বিদ্যুতের ন্যায়’ ওই জলে অন্তর্হিত হন বলেই বড়বা – অশ্বরূপী অগ্নি।
‘পঞ্চযোজন দীর্ঘ ও অর্ধযোজন বিস্তৃত দেবিকাতীর্থ, ‘পূর্বে যেখানে পৃথিবীর ছিদ্র ছিল’ সেই হিমবৎসুত অর্ব্বুদতীর্থ, সেই রামতীর্থ যেখানে ‘ক্ষত্রিয়রুধিরে পঞ্চহ্রদ পরিপূর্ণ করেন পরশুরাম, পরে পিতৃগণ ও দেবগণের আশীর্ব্বাদে তা নির্মল জলপূর্ণ হয়’ এরকম অনেক অনেক প্রধান আর বিখ্যাত তীর্থ ছাড়াও পুলস্ত্য ঋষি পান্ডবদের শোনাচ্ছেন শীতবন তীর্থ, স্বাবিল্লোমপহ তীর্থ, সরক, মৃগধূম, পবনহ্রদ, দেবীতীর্থ, সপ্তসারস্বত তীর্থ...এরকম অজস্র বিচিত্রনামী তীর্থের বিবরণ।
কিছু কিছু নদীর কথাও আছে গঙ্গা ব্যতিরেকেও। সেখানে দেখি দুই জলের সঙ্গমের মহিমা বেশি। সিন্ধু বা সরস্বতীর সাগরমিলনক্ষেত্রে স্নানের পুণ্য যেমন আছে তেমনি আছে বধূসরা নদীতে স্নানপুণ্যের উপাখ্যান। জমদগ্নি ঋষির উদাসীনতায় দুঃখী তাঁর গর্ভিনী স্ত্রী পুলোমা নিজের পূর্বজীবনের বান্ধবের সঙ্গে স্বামীগৃহ ও আশ্রম ছেড়ে চলে গিয়েও আবার ফিরে আসেন। তাঁর গভীর দুঃখের অশ্রু থেকে জন্ম নেওয়া নদীকে স্বয়ং ব্রহ্মা নাম দেন বধূসরা, যে বধূকে অনুসরণ করে। পরে মাতৃহত্যার পাতকী পরশুরাম হাতের কুঠার মুক্ত করতে না পারায় দেবতারা তাকে সেই বধূসরা তীর্থেই গিয়ে স্নান করার নির্দেশ দেন। যুদ্ধের অনেক আগে থেকে পবিত্রভূমি কুরুক্ষেত্রের পবিত্রতা চিহ্নিত হয় তার নদীচিহ্ন দিয়ে- ‘উত্তরে সরস্বতী ও দক্ষিণে দৃষদ্বতী নদী’র অবস্থানই কুরুক্ষেত্রকে বিশিষ্ট করেছে। অন্যভাবে ভাবলেও, বিশাল যুদ্ধের স্থলে যথেষ্ট জলের অবস্থিতি তো থাকতেই হবে, উভয়পক্ষেরই সৈন্যগণের স্বার্থে।
এই ‘বনপর্বে’র শেষদিকেই রয়েছে ধর্মবকের সেই আশ্চর্য উপাখ্যান বক-যুধিষ্ঠির সংবাদ। সেখানে তৃষ্ণার্ত কনিষ্ঠ পাণ্ডবপুত্রদের একে একে মৃত্যু হলে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির স্বয়ং জলাশয়ের প্রহরী বকপক্ষীর প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে শুরু করেন। আর, পাঠকের সামনে খুলে যায় সেই সুদূর অতীতের কিছু মূল মানবিক ভাবনা – কিসে সুখ? আশ্চর্য কী? কী এই জীবনের বার্তা?
মনে না হয়ে পারে না- বারো বছর নানা বিপদ, দুঃখ ও অণ্বেষণের শেষে নৈমিষারণ্যে বকরূপী এই ধর্মের প্রশ্নসমূহের উত্তর দেবার ছলে যুধিষ্ঠির যেন বিবৃত করছেন তাঁর শিক্ষা আর অনুভবের সারাংশ। স্বজনদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছাড়া তাঁর কোন উপায় নেই নিজস্ব কোন নিশ্চিন্ত গৃহলাভের একথা নিশ্চিত জেনেই যেন তৎকালীন অন্যতম প্রধান রাজবংশের জ্যেষ্ঠ কুমার ‘সুখ কিসে?’ বকের এই প্রশ্নের উত্তরে বলছেন সাধারণ মানুষের সেই পরম আকাঙ্ক্ষার কথা- ‘অঋণে অপ্রবাসে আত্মীয়স্বজন সঙ্গে নিয়ে যিনি দিনের পঞ্চমপ্রহরে শাকান্ন ভক্ষন করেন, হে বক, তিনিই সুখী’।
এই সমস্তটাই ঘটছে কিন্তু একটি জলাশয়ের তীরে। সেখান থেকে তৃষ্ণার জল আহরণ করার শর্তই এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। যেন বনবাস শেষ করে অজ্ঞাতবাসের যে কঠিনতর যাপনে তাঁদের ঢুকতে হবে, তারপর দেশে ফিরতে পারলে আবার স্বজনঘাতী যুদ্ধ, তার কতোখানি মানসিক প্রস্তুতি তিনি অর্জন করেছেন, তারই এক পরীক্ষা দিচ্ছেন দলনেতা যুধিষ্ঠির। জলই যেহেতু জীবন, তাই সেখানেই তাঁর পরীক্ষা নেবার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করেছেন ধর্ম।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে