বানান ভুল হয় নি মোটেই। কথাটা আবেদন নয়, 'আ'-কারের লেজ কেটে অ-এ 'অবেদন'। ওই যে, যাকে আমরা মাতৃভাষায় অ্যানাসথেসিয়া বলি। তারপর অন্য মাত্রার সার্জিকাল স্ট্রাইক। হালকা চালে চা-মুড়ি খেতে খেতে পেটে তিনটে ফুটো করে কাজ শেষ। কেটে যাবে, কিন্তু রক্ত পড়বে না। সেই চালে পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গ, সব কিছু বাগে এসে গেছিল। লোকসভায় বিপুল জয়। তার আগের বিধানসভায় কিছুটা আব্বুলিশ আর দুধভাত মার্কা এক্কাদোক্কা খেলায় কংগ্রেসকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনটে বিধানসভা নির্বাচনে।
দেশের শিক্ষিত জনগণ সেই জয়ে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের লম্বা পথ হাঁটার অনুসিদ্ধান্ত খুঁজে পেয়েছিলেন। লোকসভার ঠিক আগে আগে সেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভোরের স্বপ্নে অনেকে রাহুল গান্ধী কিংবা চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে নিজেকেও প্রধানমন্ত্রী ভাবছিলেন। তারপর উত্তুঙ্গ হিন্দুত্ব আর সামরিক জাতীয়তাবাদ এমন খাপে খাপ মিলে গেল যে বোতাম টিপতে গেলেই আঙুলে পদ্মফুল।
কিন্তু একপেশে জিতে গেলে কি খেলা জমে? ছিপ ফেললেন, আর মাছ সেটাকে কপ করে গিলে ফেলে সোজা হেঁটে আপনার থলেতে ঢুকে পড়ল। এমন হলে মাছ ধরার মজাটাই মাটি। তাই বিরোধী পক্ষকে নাচানোর ব্যাপারটা খুব জরুরি। মহারাষ্ট্র আর হরিয়ানার ভোটে এমন ফল হলো, যে দেশের শিক্ষিত বামমনা কিংবা মধ্যপন্থী জনগণের ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি। যাক, বিজেপি কিছুটা হলেও ধাক্কা খেল। কিন্তু নিট ফলে হরিয়ানায় সরকার গড়ল সেই বিজেপি। সারা দেশের সামনে ডুগডুগি বাজিয়ে দুষ্যন্তের বাবাকে জেল থেকে ছুটি দেওয়া হলো। তিনি এলেন ছেলের উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের অভিষেকে।
আরও পড়ুন: বাঙালির হিন্দু উগ্রবাদ কখনোই বিজেপি-নির্ভর নয়
বিজেপি কিন্তু অন্য কয়েকটা নির্দল ভাঙিয়েও সরকার গড়তে পারত। কিন্তু তাতে সারা দেশকে দেখানো যেত না যে, যা খুশি তাই করতে পারি। পেনাল্টি বক্সে বল পেয়ে এক লাথিতে বল জালে জড়ানোর থেকে অনেক বেশি আনন্দ তিন চারটে রক্ষণের খেলোয়াড়কে চুক্কি দিয়ে শেষে গোলরক্ষককে চিৎপাত করে বল পায়ে গোলের মধ্যে ঢুকে পড়া।
শনিবার ভোরবেলায় ঠিক সেটাই করেছে বিজেপি, আর সবটুকু দেখে সপ্তাহান্তের বারবেলায় গলার শির ফুলিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন শোনাচ্ছে শিবসেনা, কংগ্রেস আর এনসিপি। এনসিপি যে যখন তখন বিজেপির দিকে পাল্টি খেতে পারে, জানাই ছিল। আপাতত যে ক'জন লোক বিজেপির খাতায় সই করেছেন, তাঁদের শরদ পাওয়ার কী বুদ্ধি দিচ্ছেন সে কথা সংবাদমাধ্যমের এই মুহূর্তে জানা শক্ত। তবে ভাইপো অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী আসনে দেখে তিনি যে অনেকটা স্বস্তি পাবেন তাতে কোনও সন্দেহই নেই।
পারিবারিক লড়াই, বিশ্বাসঘাতকতা, এই ধরণের শব্দগুলো কংগ্রেস বা এনসিপির রাজনীতিতে এতটাই 'ক্লিশে' যে এই দুটো দলের পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী না করাই মঙ্গল। কংগ্রেস, এনসিপি আর শিবসেনার দিকে তাকালেই খুব সহজে বোঝা যায় যে এই দলগুলি আসলে পারিবারিক সম্পত্তি। সেই জায়গায় বিজেপির মত একটি শক্তিশালী এবং নীতিভিত্তিক (সে নীতি অনেকের কাছে সমর্থনযোগ্য না হতেই পারে) রাজনৈতিক দল যে এদের নিয়ে সুযোগমত সুতো নাড়িয়ে পুতুলখেলা খেলবে, তা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা মামলা: একতার রায়
ফলে শনিবার দুপুরে মুম্বই জুড়ে বিরোধী পক্ষের স্লোগান, কিংবা তিন দলের নেতাদের জ্বালাময়ী ভাষণে কিছুই যায় আসে না। তারা সত্যি বিজেপির সঙ্গে লড়াই দিতে চায় কিনা, তা বোঝা যাবে বিধানসভার মাটিতে। আস্থা ভোটে যদি দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জিতে যান, তাহলে বুঝতে হবে শিবসেনা, এনসিপি এবং কংগ্রেস, তিনজনেই তলায় তলায় বিজেপির সরকার গড়ায় সামিল হয়েছে।
আর নীতির প্রশ্নে এই পদক্ষেপ তো একেবারেই সঠিক, কারণ বিধানসভা নির্বাচনের জনমত বিজেপির পক্ষেই ছিল। ফলে তাদেরই মহারাষ্ট্রে সরকার গড়া উচিৎ। সরকার গঠনে সাহায্য করার প্রতিদান হিসেবে বিজেপি নিশ্চয় এই তিন পরিবারকে খুব বেশি ঝামেলায় ফেলবে না। খুব খুশি হলে দু'একটা পদ্ম পুরস্কারও শিকে থেকে ছিঁড়বে কোনও কোনও পরিবারের ঘরের মেঝেয়। সব মিলিয়ে ভোরবেলার শপথ এই সপ্তাহান্তের জবর খবর।
তবে সমস্যাটা একেবারে অন্য জায়গায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলার, কিংবা তার পরের লৌহমানব স্টালিন, আমাদের দেশে জরুরি অবস্থার সময়ের ইন্দিরা গান্ধী, আজকের রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, কিংবা তুরস্কের এরদোগান, এরা কিন্তু গণতন্ত্রের সাড়ে সর্বনাশ করেছেন অথবা করছেন। দেশের মানুষের স্বাধীনতা চটকে গেলে ঠিক কী কী মুশকিল হয় এবং দেশকে পরবর্তীকালে কতটা ফলভোগ করতে হয়, তা নিয়ে ইতিহাসের সবকটা পাতা সাজালে আর কষ্ট করে চন্দ্রাভিযান করতে হবে না।
একনায়কতন্ত্রের একটাই গোলমাল, যে সময়বিশেষে বিরোধী বলে আর কিছু থাকে না, আর যদি বা খুচরো কয়েকজন থাকে, তাহলে বিভিন্ন উপায়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবু একসময় না একসময় শাসক বদলায়। কখনও গণতন্ত্র ফেরে, কখনও বা লৌহমানব বদলে অন্য কোনও আরও কঠিন ধাতব-মানব ক্ষমতার দখল নেয়। বিজেপি দল হিসেবে এখন অসম্ভব শক্তিশালী, এবং তাদের মূল সংগঠন অভেদ্য। ফলে শাসক শক্তির পুরো বিষয়টাকে শুধু নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহ হিসেবে না ভাবাই ভালো।
আরও পড়ুন: বেশি বুঝলেই সমস্যা
বিজেপি ছাড়াও পেছনে আছে অত্যন্ত শক্তিশালী আরএসএস। হাতের কাছে পরিসংখ্যান না থাকলেও জনগণ মোটের ওপর বিশ্বাস করেন যে বামপন্থীদের মতোই বিজেপি বা আরএসএস-এর একেবারে ওপরের সারির নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি অনেকাংশে কম। এর মধ্যে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থীরা মোটামুটি নিশ্চিহ্ন। তাদের লাগাতার আন্দোলনে বিজেপির ভোট কয়েকটি জায়গায় সামান্য কমলেও, সেই ভোট যাদের দিকে যাবে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে ঠুনকো। ফলে বিজেপির ফল একটু খারাপ হলেও, নিজেদের দুর্নীতি সামাল দেওয়ার জন্যে বিরোধীদের বিজেপির কাছে মাথা বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া গতি নেই।
এই ধারা বজায় থাকলে শাসকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়লেও দেশের অন্যান্য দল মুখে মাখার ক্রিমের যোগান দেবে। ঠিক যেমনটা হচ্ছে মহারাষ্ট্রে। তবে অনেক সময় একটু অন্যরকম কিছু ঘটে, কয়েকদিনের জন্যে। সেই হিসেবেই বিজেপি কর্নাটকে সরকারের বাইরে ছিল কিছুটা সময়। সেরকমই যদি মহারাষ্ট্রের আস্থাভোটে বিজেপি হেরে যায় (যার সম্ভাবনা ভীষণ কম), তাহলে কিছুদিনের জন্যে হয়ত শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস নীতিহীন মিলিজুলি সরকার চালাবে। তারপর আবার ফিরে আসবে বিজেপি।
গোটা বিষয়টির দিকে নজর রাখলে, এবং প্রেক্ষিতটা মহারাষ্ট্র থেকে আমাদের রাজ্যে নিয়ে এলে, ২০২০ আর ২১-এ কী হতে পারে তার একটা আভাস পাওয়া যাবে। বিজেপির সুবিধে হলো, তাদের সরকার গড়তে অর্ধেকের বেশি আসন পেতে হয় না। নিজেদের আসন কম থাকলেও নীতির প্রশ্নে আপস করা দলগুলোর কাছ থেকে কীভাবে কম খরচে বিধায়ক ভাঙানো যায়, সে অঙ্ক দারুণভাবে রপ্ত করেছে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি।
দুই ডানপন্থী দলের ক্ষমতা দখলের লড়াইতে মহারাষ্ট্রে শিবসেনাকে আপাতত পেছনের পায়ে খেলতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ইজেলটা বিজেপি একইভাবে ব্যবহার করতে পারছে কিনা, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে সামনের সপ্তাহে তিনটি উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর। রাজনীতি চলছে, তবে ঘুমপাড়ানি ওষুধে মাঝে মাঝে এলিয়ে পড়ছে গণতন্ত্র। গোলাপি বলে কোহলির শতরানের পর হেমন্তের সপ্তাহান্তে সে বেচারি দিবানিদ্রা দিলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংসদীয় ব্যবস্থার খুব কিছু যায় আসে কি?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)