Advertisment

প্রসঙ্গ মহারাষ্ট্রের ত্রিশক্তি এবং রাজনৈতিক আপস

ওমপ্রকাশ চৌতালা একদা বলতেন, "আমরা তীর্থযাত্রী নই। রাজনৈতিক নেতা। ক্ষমতার জন্য এসেছি, তীর্থ করতে আসি নি।" কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেও এখন এই বিতর্ক শুরু হয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
maharashtra government

মহারাষ্ট্রের মত ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে বিজেপির সঙ্গে শিবসেনার জোট ভেঙে গেল। জোট ভেঙে যাওয়া সবসময়ই রাজনৈতিক সেটব্যাক বা ধাক্কা বলেই পরিগণিত হয়। বিজেপির প্রাচীনতম শরিক পাঞ্জাবের আকালি দল। শিবসেনা হলো দ্বিতীয় প্রাচীনতম সঙ্গী, এবং শিবসেনা ও বিজেপি মতাদর্শগত ভাবেও খুবই ঘনিষ্ঠ। বলা হতো, শিবসেনা হল বিজেপির ‘ন্যাচারাল অ্যালাই’, অর্থাৎ স্বাভাবিক জোট সঙ্গী। দুজনেই হিন্দুত্ব মতাদর্শের ধ্বজাধারী।

Advertisment

তাই ১৯৮৯ সালে যে জোট হয়েছিল, তা ২০১৯ সালে যদি সত্যি সত্যিই ভেঙে যায় তবে তা বিজেপির জন্য সুখদায়ক ঘটনা কিভাবে বলা যায়? এই জোট ভাঙার ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে? এই জোট বিচ্ছেদের জন্য বিজেপির দোর্দন্ডপ্রতাপ সভাপতি অমিত শাহর রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতায় কি চিড় ধরল?

শিবসেনার কান্ডারী উদ্ধব ঠাকরে তো বিচ্ছেদের কারণ দর্শাতে গিয়ে একথা বলেছেন যে অতীতে ভোটের আগে একান্ত আলোচনায় অমিত শাহ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, এবার রাজ্য সরকারের কান্ডারী হবে শিবসেনা। পাঁচ বছরের আড়াই বছর শিবসেনা মুখ্যমন্ত্রিত্ব করবে, এবং তার পরবর্তী আড়াই বছর বিজেপি রাজত্ব করবে। কিন্তু বিজেপি এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। দুজনের মধ্যে এই আলোচনা হয়েছে বলে বলা হয়েছে, অতএব স্রেফ এই দুজনই জানেন, কে সত্যি বলছেন আর কে সত্যি বলছেন না। নরেন্দ্র মোদীকেও নাকি একথা জানানো হয়নি, এমন অভিযোগও শিবসেনার পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

এই বিচ্ছেদও যে আচমকা হয়েছে, এমন নয়। গত পাঁচ বছর ধরে উদ্ধব এবং তাঁর ‘সামনা’ পত্রিকা তীব্র ভাষায় নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেছেন। এখন কংগ্রেস শিবসেনাকে সমর্থন করায় বিজেপির অসুবিধা হবে কি? কারণ এতদিন বিজেপি-শিবসেনা ছিল হিন্দুত্ববাদী, আর কংগ্রেস ছিল সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের ধারক। এখন তো সেই হিন্দুত্ব ভোটে কংগ্রেসরও দাবি জন্মাল।

আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের এক ঘটনা। লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অটল বিহারী বাজপেয়ী দেশের প্রধানমন্ত্রী। মুম্বই শহরে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হওয়ার কথা। কিন্তু শিবসেনার তৎকালীন সুপ্রিমো বাল ঠাকরে ঘোষণা করেছেন যে তিনি কিছুতেই এই ম্যাচ হতে দেবেন না। শিব সৈনিকরা স্টেডিয়ামে ঢুকে পিচ খুঁড়তে শুরু করে দিয়েছে, যাতে খেলা অসম্ভব হয়ে যায়। বাজপেয়ী এ ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আডবাণীকে ডেকে বললেন, "এই ম্যাচটা তো নিছক ক্রিকেট ম্যাচ নয়, বা শুধু ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা নয়, এ হলো গোটা দুনিয়ার কাছে ভারতের সম্মান তথা কূটনৈতিক মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন। আপনি বালাসাহেব কে বুঝিয়ে ঠান্ডা করুন।"

আডবাণী ফোন করলেন বালাসাহেবকে। অনড় বালাসাহেব তাঁকে মাতশ্রী, মানে মুম্বইয়ের ঠাকরে ভবনে, আসতে অনুরোধ জানালেন। আডবাণী বৈঠকে বসে তাঁকে নরম করলেন, যাতে ক্রিকেট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। শিবসেনার এই বাগী চরিত্র। শুধু এই ঘটনার মাধ্যমে নয়, এমন বহু ঘটনার কথা মনে পড়ে যখন শিবসেনা পেশী প্রদর্শন করে বিজেপির শান্তি ছিনিয়ে নিয়েছে বারবার।

সেদিন আর আজকের মধ্যে অনেক ফারাক। সেদিন বিজেপির আজকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল:না। তখন বাজপেয়ীকে শরিক দলের সমর্থন নিয়েই সরকার চালাতে হতো। আর আজ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি একাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ২০১৪ সালের পর ২০১৯-এ মোদির দ্বিতীয় ইনিংসেও জনপ্রিয়তা এবং দলীয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অটুট। এবার মহারাষ্ট্রের ভোটের ফল প্রকাশের পর যখন দেখা গেল বিজেপি রাজ্যে একা সরকার গড়তে পারছে না, তখন উদ্ধব ঠাকরে ঘোষণা করেন, অমিত শাহকে মাতশ্রী আসতে হবে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য। শিবসেনাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ দিতে হবে, এবং ৫০:৫০ সরকার গড়া হবে।

কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া কী হলো? অমিত শাহ কিন্তু মুম্বই গেলেন না। আপাত নিরুত্তাপ হয়ে চুপচাপ দিল্লীতে বসে থাকলেন। একেই বলা হয় স্নায়ুর যুদ্ধ। ‘ব্রিংকম্যানশিপ’। এই স্নায়ুর শক্তিতে অমিত শাহ যে বলীয়ান, সেটা আজ আমরা হঠাৎ দেখছি এমন নয়। এ তো অমিত শাহর রাজনৈতিক ডিএনএ। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়ে গেল। কিন্তু কংগ্রেস-এনসিপি শিবসেনার মুখ্যমন্ত্রিত্ব মেনে নেবে, এমন একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরোধী পক্ষ অনেক বেশি সময় নিচ্ছে।

যুক্তি দিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, যখন কর্ণাটকে বিজেপি সরকার গঠনের বিষয় আসে, তখন রাজ্যপাল কতদিন সময় দেন, আর আজ মহারাষ্ট্রে কেন যথেষ্ট সময় দিলেন না? কারণ কংগ্রেসও তো শিবসেনার সঙ্গে দরকষাকষি করছে। এক কথায় ৫৬ টি আসন পাওয়া শিবসেনার মুখ্যমন্ত্রিত্ব কংগ্রেস কেন মেনে নেবে? কে উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কার হাতে থাকবে? স্পিকার কে হবেন? এসব নিয়েও ত্রিশক্তির মধ্যে আলোচনা করতে হবে।

তবে এখন কংগ্রেসের মূল লড়াইটা হলো, একদিকে মতাদর্শ, অন্যদিকে ক্ষমতার কৌশল। ওমপ্রকাশ চৌতালা একদা বলতেন, "আমরা তীর্থযাত্রী নই। রাজনৈতিক নেতা। ক্ষমতার জন্য এসেছি, তীর্থ করতে আসি নি।" কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেও এখন এই বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিপিএমের মতো কংগ্রেসেও এখন কেরল লবির বিদ্রোহ হয়েছে, মহারাষ্ট্রের রণকৌশল নিয়ে। এ কে অ্যান্টনির নেতৃত্বে কেরল কংগ্রেস বলেছে, মতাদর্শ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বড়, যেনতেন প্রকারেন সরকার গড়া চলবে না।

ভুলে গেলে চলবে না, শিবসেনা কিন্তু সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করে। একদা মুম্বইয়ের এক পুরনির্বাচনেও শিবসেনা কংগ্রেসকে সমর্থন করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী প্রতিভা পাটিল এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শিবসেনা সমর্থন করে, বিজেপি বা এনডিএর প্রার্থীকে সমর্থন না করে। কাজেই শিবসেনার কংগ্রেসকে সমর্থন করার অতীত রেকর্ড আছে। কংগ্রেস কিন্তু কখনো শিবসেনাকে সমর্থন করেছে, এমনটা মনে পড়ে না। তাছাড়া, কংগ্রেস শিবসেনার মত মহারাষ্ট্র-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক দল নয়, জাতীয় দল। আজ যতই দুর্বল হয়ে যাক না কেন, কংগ্রেসকে একটা জাতীয় মতাদর্শ মেনে চলতেই হয়।

নেহেরু-গান্ধীর কংগ্রেসের পক্ষে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপস করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। শিবসেনা বিগত নির্বাচনে রাহুল গান্ধী সম্পর্কে যা যা মন্তব্য করেছে, তাকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি না। শিবসেনার দৈনিক মুখপত্র 'সামনা', এবং উদ্ধব ঠাকরে নিজেও মন্তব্য করেছেন, রাহুল গান্ধীকে লাথি মেরে ভারতের রাজনীতি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এই মন্তব্যের পরও শিবসেনা কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়তেই পারে। রাজনীতিতে কোনো পূর্ণচ্ছেদ হয় না। সে তো 'সামনা' পত্রিকায় নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কেও গত পাঁচ বছরে কী কী ছাপা হয়েছে, তাও আমাদের সকলেরই মনে আছে।

রাজনীতিতে ভোটের সময় যেসব কথা বলা হয়, ভোটের পর তা মনে না রাখাই দস্তুর। হিন্দিতে একটা লোককথা জনপ্রিয়। রচনাটি হল, হাতির দুরকমের দাঁত থাকে। একটা দাঁত খাওয়ার জন্য, আর অন্যটি দেখানোর জন্য। তা রাজনৈতিক নেতাদেরও দুই প্রকার দাঁত থাকে। তাই শিবসেনা রাহুল সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছে, ভোটের পর বিজেপির মোকাবিলায় সেসব কথা যদি দুপক্ষই ভুলে যায়, তবে তা অস্বাভাবিক কোনও কান্ড নয়।

বিজেপি কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির পিডিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছে, আবার তা ভেঙেও গেছে। কংগ্রেসকে খতম করার জন্য বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে সমর্থন করেছে বিজেপি এবং কমিউনিস্টরা, একই সঙ্গে। বাজপেয়ী এবং জ্যোতি বসুর যৌথভাবে জনসভায় উপস্থিতির ছবি আজ ঐতিহাসিক।

কিন্তু একথাও মানতে হবে যে এইসব জোট কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী হয়নি। জোট রাজনীতিতে জনপ্রিয় একটি কথা হলো ‘ন্যাচারাল অ্যালাই’। এনডিএতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ মুসলমান ভোট। এই মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক মমতার কোর ভোটব্যাঙ্ক। কাজেই মমতা এনডিএতে থাকলেও তা স্বাভাবিক মিত্রতা নয়। বিজেপি আর শিবসেনা কিন্তু স্বাভাবিক জোট। বীর সাভারকর থেকে রাম মন্দির হিন্দুত্বের কোর ইস্যু হলো দুই দলের প্রধান উপজীব্য।

কিন্তু এখন বিজেপি দেশে এনডিএর বদলে নিজেদের একদলীয় আধিপত্য কায়েম করেছে। সর্বভারতীয় শাসকদল হয়ে সর্বত্র বিস্তৃত হতে চাইছে। পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব, ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতে যেখানে বিজেপির দাপট নেই, সেই সাংগঠনিক নন-বেস এরিয়াতেও বিজেপিকে নিয়ে যেতে তৎপর মোদী এবং অমিত শাহ। এই ইচ্ছার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। শুধু এই প্রয়াসে শিবসেনার আঞ্চলিক সমস্যা হচ্ছে। শুধু শিবসেনা কেন, পাঞ্জাবে অকালি দল বা বিহারে নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এরও সমস্যা হচ্ছে। তাই ভোটে আসন কম পাওয়া নিয়েও সমস্যা হয়েছে। কেন্দ্রে যথেষ্ট মন্ত্রী না থাকা বা নির্ধারক শক্তির ভূমিকা জাতীয় ও রাজ্য স্তরে কমতে থাকা, এসব শরিক সমস্যা তো হচ্ছেই। মনে করুন, পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম রাজত্বে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, বা সিপিআই-এরও সমস্যা হয়েছিল। বামফ্রন্টে সিপিএমএর দাদাগিরির মতই আজ এনডিএতে বিজেপির প্রভুত্ব।

এই আধিপত্যকামীতার 'অ্যান্টি থিসিস' হয়ে উত্থিত পাল্টা সরকার গড়ার প্রয়াস। এনসিপি-কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে ৫৬ টি আসনের শিবসেনা সরকার গড়তে চাইছে। এখন এই জোটের সমস্যা একটাই - কে যে ইঞ্জিন আর কারা বোগি বা ওয়াগন, সেটাই বোঝা দুষ্কর। তাই শিবসেনা কংগ্রেসে-এনসিপির সমর্থন নিয়ে এখন সরকার গড়তে পারে, কিন্তু সেই সরকার স্থায়ী হবে কি?

bjp CONGRESS shiv sena
Advertisment