মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন নিয়ে অচলাবস্থা অব্যাহত। আপাতত রাষ্ট্রপতি শাসনের কথা ঘোষণা হয়ে গেছে। তবে বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয় নি। অর্থাৎ একাধিক দল মিলেমিশে যদি ২৮৮-র মধ্যে ১৪৪-এর সীমা পার করতে পারে, সেক্ষেত্রে সরকার গঠনের দাবি জানানোর সুযোগ থাকছে। রাজ্যপালের বিষয়ে মূল যে সমালোচনা বিরোধীদের মুখে শোনা যাচ্ছে, তা হলো, বিভিন্ন দলকে দেওয়া সময়ের পরিমাণ বিভিন্ন। বিজেপি পেয়েছে দুদিন, শিবসেনা একদিন, এনসিপি তার থেকেও কম।
একথা খুব সত্যি যে সরকার গঠনের সময়সীমা কিছুটা বাড়ালে শিবসেনা, এনসিপি এবং কংগ্রেস আর একটু সময় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেত। তবে এটা বুঝতে হবে যে রাজ্যপালকে নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই শাসক দলের পছন্দের লোকেরাই সাধারণত রাজ্যপাল হন। বিজেপি এখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় আছে। ফলে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ভগত সিং কোশিয়ারি যে বিজেপির নিজের লোক হবেন, এতে অবাক হওয়ার কারণ নেই। অন্তর্জালে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখা যাবে যে আরএসএস এবং বিজেপির অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন তিনি। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে পারছে না, তখন অন্যান্য দলকে সরকার গঠনে সাহায্য করার দায় যে এই রাজ্যপালের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়, তা পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: গরুর কুঁজে সোনা, কুকুর খাও, কেন বলেন দিলীপ ঘোষ?
বিশেষ করে দল হিসেবে বিজেপি বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর। সুতরাং এই আলোচনা হতেই পারে যে সংবিধানের মধ্যে থেকেও তারা কি সংবিধানের মূল ধারা বা মূল ভাবকে অস্বীকার করছে ক্ষমতার জোরে? মহারাষ্ট্রের ঘটনা কি তারই আর একটা নিদর্শন? কিন্তু কিছুটা ভাবলে বোঝা যাবে যে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন নিয়ে যা চলছে, তার তুলনায় অনেক বেশি একনায়কতন্ত্রী অবস্থান কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে কাশ্মীরে ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলোপ করার ক্ষেত্রে।
এই মুহূর্তেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কাশ্মীরের পরিস্থিতি একেবারেই স্বাভাবিক হয় নি, এবং উপত্যকার মানুষেরা নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নন। যদিও বিজেপি সমর্থক বিশাল সংখ্যক জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত মানুষ কাশ্মীর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বেশ তৃপ্ত। আসলে সেখানে মুশকিল হলো, উপত্যকার মানুষের মত খুব একটা না নিয়েই তাঁদের রাজ্য সংক্রান্ত কিছু ধারা বিলোপ করা হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত বিরোধী মতের রাজনীতিকদের মেনে না নেওয়াই স্বাভাবিক।
মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কিন্তু জনমতের বিরোধী খুব কিছু কাজ রাজ্যপাল করছেন না। মহারাষ্ট্রের মানুষ এবারের বিধানসভা নির্বাচনে কাউকে জেতান নি। জোট করেও খুব সুবিধে হয় নি বিজেপি এবং শিবসেনার, বরং আগের বারের তুলনায় দু'দলের মোট ভোট শতাংশ এবং আসন সংখ্যা কমেছে। শহরাঞ্চলে কিছুটা সামলে নিতে পারলেও, গ্রামের দিকে বিজেপি-বিরোধী মতামত সুস্পষ্ট। সাম্প্রতিক লোকসভার তুলনায় খারাপ ফল করেছে এই জোট। অন্যদিকে এনসিপি বা কংগ্রেসও যে খুব বেশি জনসমর্থন পেয়েছে এমনটা নয়। ফলে শুরুর দিকে তাদের নেতানেত্রীরা বিরোধী আসনে বসার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটাই সঠিক।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা: আদালতের রায়, বাদুড় চুরি এবং হিজবিজবিজের হাসি
গোলমাল বাঁধল দুই দক্ষিণপন্থী দল বিজেপি আর শিবসেনার জোট ভেঙে যাওয়ায়। বিধানসভা নির্বাচনের ফলের ভিত্তিতে বিরক্তির একটা বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও তাদের সমর্থন করেছেন মারাঠি জনগণ। ফলে তারাই সরকার গড়বে, এমনটাই স্বাভাবিক। এবার শিবসেনা কম আসন পেয়েও মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদ আধাআধি চাইছে। সেই নিয়মেও বিজেপি প্রথম আড়াই বছরের জন্যে সরকার গড়তেই পারত। তার মধ্যে জল গড়াত অনেকটা, এবং শেষমেশ অর্ধেক সময় কেটে যাওয়ার পর ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতেও পারত। ফলে সত্যি-মিথ্যের তর্কে না গিয়ে শিবসেনাকে শেষ আড়াই বছরের আশ্বাস দিয়ে সরকার গড়তে আপাতত কোনও অসুবিধেই ছিল না। রাজনীতিতে সব সময় সবাই সত্যি কথা বলে উদ্ধার করে দিচ্ছেন এমনটা নয়।
অর্থাৎ বিভিন্ন গোলমালে বিজেপি-শিবসেনার সরকার গঠন করার মতো সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজটাই এক্ষেত্রে ঘটে নি। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বিষয়টিই যখন না ঘটে, তখন কম সম্ভাবনাময় বিষয়গুলি কেন ঘটল না, সেকথা বলে অন্যদের দোষ দেওয়ার কোনও মানে হয় না। সেই হিসেবে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল, কিংবা কংগ্রেস বা এনসিপিকে সরাসরি দায়ী কর যায় না।
এবার বিজেপি সরকার গড়তে না চাইলে আসনের হিসেবে আর একটি সমাধানই আসে। তা হল শিবসেনা, এনসিপি এবং কংগ্রেস একসঙ্গে সরকার গঠন করা। সেখানে সবচেয়ে বড় অসুবিধে কংগ্রেসের। নরম হিন্দুত্বের রাস্তা অনেক সময়েই নিয়ে থাকে কংগ্রেস, তবে সরাসরি অতি দক্ষিণপন্থী শিবসেনাকে সমর্থন করা তাদের পক্ষে শক্ত। এনসিপি যদি সরকার গড়ত এবং শিবসেনা আর কংগ্রেস যদি বাইরে থেকে সমর্থন দিত, সেটাই কংগ্রেসের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাতে যে শিবসেনা রাজি হবে না, তা এখন বোঝাই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা মামলা: একতার রায়
আর এইসময় সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জয়ী বিধায়করা। নিজের দলে থেকে বা দল বদলে কোনোভাবে যদি তাঁরা সরকারে আসতে পারেন, তবেই তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে সুবিধে। বিরোধী দলে থাকলেও অন্তত বিধায়কের সুযোগ সুবিধেটুকু তাঁরা পাবেন। কিন্তু একবার বিধানসভা ভেঙে গেলেই মুশকিল। তখন আবার নতুন করে লড়াইয়ে নেমে বিধায়ক হতে হবে। সেই অঙ্কে কিন্তু বিজেপির সামনে যথেষ্ট সুযোগ থাকছে। শিবসেনা, কংগ্রেস বা এনসিপি ছাড়াও অন্যান্য ছোট দল কিংবা নির্দলদের মধ্যেও জনা কুড়ি বিধায়ক আছেন, যাঁরা সুযোগমতো বিজেপিকে সমর্থন করে দেবেন। অন্যান্য দলের সরকার গড়তে যত দেরি হবে, ততই শক্ত হবে বিজেপির হাত। মহারাষ্ট্রে সরকার গড়ার শুরুর দিকে বিজেপিকে তেতো ওষুধ গিলতে হলেও, শেষ হাসি তারা এখনও হাসতেই পারে।
বিরোধীরা মিলিজুলি সরকার গড়লেও সেটা বেশিদিন টিকে থাকা শক্ত। তবে কংগ্রেস-এনসিপির সবচেয়ে ভালো চাল হতে পারে ফের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। বিজেপি আর শিবসেনার পক্ষে একসঙ্গে জোট করে লড়াই করা বেশ মুশকিল হবে সামনের কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন হলে। সেক্ষেত্রে কিন্তু পুনর্বার নির্বাচনে বিরোধী জোটের আসন বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে। সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্রে নির্বাচন হওয়ার আগের এবং পরের পরিস্থিতি খুব বদলায় নি, কারণ সব পথই খোলা রয়ে গেছে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)