Advertisment

সংখ্যাগুরুবাদের এই সময়ে দাঁড়িয়ে গান্ধীর কাছ থেকে আমরা কী শিখি?

সংখ্যাগুরু জ্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, সবচেয়ে অরক্ষিতদের পাশে দাঁড়াতে সাহসের প্রয়োজন। গান্ধী জনতার ক্ষোভের তোয়াক্কা করেননি, তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি কাজে লাগিয়েছিলেন মুসলিমদের রক্ষা করতে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Gandhi, Gandhi Death

অলংকরণ- সি আর শশীকুমার

(মহাত্মা গান্ধীর ১৫০ তম জন্মদিন উপলক্ষে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মুদ্রিত সংস্করণে When Gandhi took on the mob’ শিরোনামে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর)

Advertisment

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবন অতীব ভালভাবে নথিবদ্ধ রয়েছে, সৌজন্যে তাঁর নিজের আত্মজীবনী ও তাঁর নিজের প্রকাশনা সংস্থা হরিজন ও ইয়ং ইন্ডিয়ায় তাঁর প্রচুর লেখালিখি। কিন্তু তাঁর ১৫০ তম জন্মদিনে আমরা দেখতে চাইব অন্যদের উপর তাঁর প্রভাব।

স্বাধীন ভারত, যা গান্ধী বেশিদিন দেখে যেতে পারেননি, সেখানে গান্ধী কতটা অর্থবহ? আজকের ভারতীয়দের কেমন ভাবে দেখা উচিত গান্ধীকে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আজকের এই সংখ্যাগুরুবাদের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা গান্ধীর কাছ থেকে কী শিখি?

জীবনের শেষ কয়েকটা মাসে দেশভাগের যে ভয়াবহতা, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে গান্ধী শেষ সত্যাগ্রহ করেছিলেন। এই সত্যাগ্রহ চৌরিচৌরার মতই দেখিয়েছিল গান্ধী নিজের নীতির পক্ষে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়েও দাঁড়ানোর ব্যাপারে কতটা দায়বদ্ধ ছিলেন।

১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি গান্ধী সত্যাগ্রহ শুরু করেন। দেশের প্রায় সর্বত্র যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এবারের অনশন ছিল সেই সাপেক্ষে। বিশেষ করে দিল্লির মুসলিমদের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব ছিল প্রচুর। ততদিনে গান্ধী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ও রুগ্ন। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন, যতদিন না সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের মন থেকে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ বোধ করবেন ততদিন তিনি সত্যাগ্রহ চালাবেন।

সত্যাগ্রহ ভঙ্গের জন্য গান্ধী সাতটি শর্ত দিয়েছিলেন। এর সবকটিই ছিল দিল্লির মুসলিমদের নিরাপত্তা ও তাঁদের সম্পত্তি রক্ষার্থে। তাঁর এই কর্মকাণ্ডের জেরে শিখ ও হিন্দুরা দিল্লির মুসলিমদের সুরক্ষার শপথ নিয়েছিলেন।

সংখ্যাগুরু জ্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, সবচেয়ে অরক্ষিতদের পাশে দাঁড়াতে সাহসের প্রয়োজন। গান্ধী জনতার ক্ষোভের তোয়াক্কা করেননি, তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি কাজে লাগিয়েছিলেন মুসলিমদের রক্ষা করতে। সম্ভবত তিনিই আজকের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা, যাঁরা বর্তমান সংখ্যাগুরুবাদের সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়ে মুসলিমদের থেকে দূরত্ব রচনা করতে চান।

তবে এর মানে এই নয় যে গান্ধীর জীবন সমালোচনামূলকভাবে পাঠ করা যাবে না, বা তাঁর রাজনীতি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। এ ব্যাপারে বাবাসাহেব আম্বেদকরের গান্ধীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভুললে চলবে না।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারির অনশন ছিল সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যাগুরুর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেবার, ১৯৩২ সালের পুণার অনশন ছিল দলিত শ্রেণির জন্য ভিন্ন ভোট ব্যবস্থা প্রতিরোধে। গান্ধী মুসলিম ও শিখদের জন্য পৃথক ভোটব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও দলিত শ্রেণির জন্য পৃথক ভোট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি একে হিন্দুত্বের অন্তর্বতী অস্পৃশ্যতা হিসেবে দেখেছিলেন। আম্বেদকরের কাছে তাঁর সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের টিকে থাকার জন্যই অপরিহার্য ছিল।

ঐতিহাসিক অন্যায়ের মুখোমুখি হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের নিপীড়ক শ্রেণির বাইরে নিজস্ব নেতৃত্ব উঠে আসা প্রয়োজন ছিল। গান্ধী দুর্বলতম, সে সময়ের সবচেয়ে কম প্রতিনিদিত্বকারী অংশের ক্ষমতায় আসার বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। গান্ধীর এই ধারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যুপরবর্তী ভারতে আরও শক্তিশালী হয়েছে।

স্বাধীন নেতৃত্ব ও মুক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক দেখার অনিচ্ছার ফল হল দলিত ও মুসলিমদের টোকেন প্রার্থীরা বড়দলের টিকিটে জেতার স্বপ্ন দেখেন আজ।

গান্ধীর অনুপস্থিতির অর্থ তাঁর নিকটতমদের কাছে কী অর্থ নিয়ে আসে> ১৯৫০ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গান্ধীবাদী কেজি মাশরুওয়ালাকে চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের মধ্যে প্রতিমা রেখে আসার অপরাধমূলক কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলেন তাঁরা। জওহরলাল নেহরু স্বীকার করে নিয়েছিলেন দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বা তাঁদের আটকানো হয়নি।

চিঠির শেষে নেহরু স্বীকার করে নেন, "আজ বহু কংগ্রেসিরা সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে। আমি জানি না এ দেশের পরিবেশ ভাল করার জন্য আর কী কী করা যায়। শুধু শুভবুদ্ধির বার্তা দিলে ক্ষিপ্ত মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। বাপু হয়ত তাই করতেন, কিন্তু সেরকম কিছুর পক্ষে আমরা বড্ড ছোট।"

নেহরু বুঝেছিলেন সংখ্যাগুরুরা আবেগ যখন তুঙ্গে থাকে তখন কতটুকু করা যেতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জানতে জনতার সঙ্গে একা হাতে লড়াই করবার মত ক্ষমতা গান্ধীর ছিল, ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তিও।

শেষ পর্যন্ত আমরা যেন ভুলে না যাই গান্ধীকে কে এবং কেন হত্যা করেছিল। ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে গান্ধীর অবস্থান স্বাধীন ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী নাথুরাম গডসের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। গান্ধী হত্যায় সাভারকরের ভূমিকা জীবনলাল কাপুর কমিশনে নথিবদ্ধ রয়েছে।

মুসলিমদের প্রতি ঘৃণাই গান্ধী হত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। এখন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দলের সাংসদ গান্ধী হত্যাকারীকে দেশভক্ত বলে আখ্যা দেন। গান্ধীর স্মৃতি আমাদের জীবন্ত রাখতেই হবে, প্রতিমা হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে, যিনি ভারত ও সমস্ত ভারতীয়দের জন্য বেঁচে ছিলেন এবং মারাও গিয়েছিলেন।

(রচনাকার আইমিম সংগঠনের সভাপতি ও সাংসদ)

Mahatma Gandhi
Advertisment