ধোনিকে ধোনির মতো থাকতে দিন। ধোনি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছেন।
লেখার শুরুতে ধার করতেই হল জনপ্রিয় গানের লাইন, সামান্য ওলটপালট করে। যা চলছে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে, এ ছাড়া উপায়ই বা কী আর? সেই বিশ্বকাপের পর থেকেই ধোনির ক্রিকেটীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশজুড়ে চালু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা-চর্চা, এবং থামার কোন লক্ষণ নেই। বরং বেড়েই চলেছে দিনকে-দিন। কাগজে-টেলিভিশনে-সোশ্যাল মিডিয়ায় বা নিছকই রকের আড্ডায় নানা ভাষা নানা মত নানা অনুমান।
⁃ আরে খোলসা করে বলবে তো যে আর ইন্ডিয়ার হয়ে খেলবে কিনা। রিটায়ার করবি তো কর, আর খেলবি তো খ্যাল। এ তো পুরো খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না কেস! ধোনি বলে কথা, কেউ সেভাবে কিছু বলতেও পারছে না। আর সেটার পুরো অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছে এমএসডি। ধোঁয়াশা রেখে দিচ্ছে ইচ্ছে করে।
- আসলে জল মাপছে, স্রেফ জল মাপছে। এ ধোনি তো আর সে ধোনি নয়। দেখাই তো গেল ওয়ার্ল্ড কাপে। তারপরও খেলে গেলে সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে বুঝে টুক করে একটা ব্রেক নিয়ে নিল। জল মাপার জন্য। জানে, পন্থ বা স্যামসনরা ফেল করলেই 'ধোনি ধোনি' আওয়াজ উঠবেই। উঠছেও তো। পাবলিক সেন্টিমেন্টটা নিজের দিকে আরও ঢলে পড়ার অপেক্ষায় আছে শুধু। সাধে কী আর রিটায়ার করছে না!
- আরে ছাড় তো ওসব পন্থ-স্যামসন! এমএসডি হল এমএসডি! দেখলি না ঝাড়খণ্ডের রনজি প্র্যাকটিসে ব্যাট হাতে নেমে পড়ল। নিজেকে তৈরি রাখছে। আইপিএল-এ দেখে নিস..একাই মাত করে দেবে..সিএসকে-কে জেতাবে। আর তারপর কারোর চোদ্দ পুরুষের ক্ষমতা হবে না টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে ধোনিকে বাদ দিয়ে টিম করার। ধোনি ইজ ধোনি। এখনও বিকল্প নেই। রিটায়ার করবে কোন দুঃখে? ব্রেক নিয়েছে, বেশ করেছে! কার তাতে কী!
- কর্মফল,কর্মফল! সৌরভকে টিম থেকে বাদ দেওয়ার সময় যে এই ধোনিই কলকাঠি নেড়েছিল, সে তো আর জানতে বাকি নেই কারও। আর এখন? 'দাদা’ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়েই কেমন চুক্তি থেকে ছেঁটে ফেলল ধোনিকে। এবার দ্যাখ কেমন লাগে! বুঝিয়ে তো দেওয়া হলো, 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব'-র নাটক আর বেশিদিন চলবে না। সে তোমার নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি হলেও না।
ধোনি-বৃত্তান্তের ঘটনা-পরম্পরা ঠিক কী, সবার জানা। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ম্যাচ ফিনিশ করে আসতে পারেননি এমএসডি। এবং সেই জুলাই মাস থেকে ক্রিকেট থেকে নিজেকে এ যাবৎ সরিয়ে রেখেছেন স্বেচ্ছায়। সবচেয়ে জরুরি, এটা করেছেন বোর্ডকে জানিয়েই। নিজের অবসরের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু খোলসা করেননি এ পর্যন্ত। গত ছ'মাসে কখনও সময় কাটিয়েছেন কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর সাম্মানিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে, কখনও তাঁকে খোশমেজাজে দেখা গিয়েছে গল্ফ কোর্সে, কখনও নিমেষে ভাইরাল হয়েছে মেয়ে জিভার সঙ্গে তাঁর মিঠে খুনসুটির ছবি। আসন্ন আইপিএল-এ চেন্নাই সুপার কিংসের নেতৃত্ব দেবেন প্রতিবারের মতোই। তারপর কী হবে, জল্পনাই আপাতত।
বোর্ড কী বলছে, টিম ম্যানেজমেন্ট কী ভাবছে, সেটাও অজানা নয়। কোচ শাস্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, ধোনির মাপের ক্রিকেটার নিজেই ঠিক করবেন নিজের ভবিষ্যৎ। আইপিএল-এর পারফর্ম্যান্স যে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের দরজা খুলে দিতেই পারে এমএসডি-র জন্য, সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন স্পষ্ট। বোর্ড? সৌরভও বলেছেন রাখঢাকহীন, কবে খেলা ছাড়বেন সেটা ধোনিই ঠিক করবেন। একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারের এটা প্রাপ্য।
তবু জলঘোলা হচ্ছে ধোনির নাম সম্প্রতি প্রকাশিত বোর্ডের বার্ষিক চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের তালিকায় না থাকায়। বলা হচ্ছে, সৌরভ নাকি 'বদলা' নিলেন! অথচ সোজাসাপটা কথাটা হলো, শেষ ছয় মাস সক্রিয় ক্রিকেটের মধ্যে না থাকা কোনও ক্রিকেটারকে বোর্ড বার্ষিক চুক্তির আওতায় রাখতে পারে না। পারে না, কারণ নিয়ম নেই। এতে ধোনিকে বার্তা দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন নেই অসম্মানের। নিয়মটা মানা হয়েছে শুধু। এবং এক্ষেত্রেও, সৌজন্যের খাতিরে ধোনিকে জানিয়েই।
তবু বিতর্ক চলছে-চলবে। মোদ্দা বিষয়টা হলো, ধোনিকে ধোনির মতো থাকতে দেওয়া হবে না। হ্যাঁ, মানছি, খ্যাতির বিড়ম্বনা সেলিব্রিটি-জীবনেরই অঙ্গ। মানছি, কেউ যদি সেলিব্রিটি হন, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে সম্মান জানাতে আমজনতার তীব্র অনীহা। মানছি, সেলিব্রিটির জীবনের প্রতিটি নড়াচড়াকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে কাটাছেঁড়া না করলে আমাদের সকালের চা, সন্ধের হুইস্কি আর রাতের ইসবগুল হজম হয় না। কিন্তু শুধু তো আর আমি-আপনি-রাম-শ্যাম-যদু-মধু নয়, খোদ সানি গাভাসকারের মতো মহাতারকারাও তো বাদ যাচ্ছেন না। ধোনি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে সানি কটাক্ষের সুরে বলেছেন, "১০ জুলাই থেকে একজন ক্রিকেটার দেশের হয়ে খেলছে না, অ্যাভেলেবল নয়। কেন নয়, সেটার উত্তর ধোনিকেই দিতে হবে। অবসর-সংক্ৰান্ত প্রশ্নের উত্তর ওই অ্যাভেলেবল না থাকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।"
আশ্চর্য লাগে দেখেশুনে। একটা সহজ ব্যাপারকে কীভাবে অকারণে জটিল করে তোলা যায়, অবাক লাগে ভেবে। একজন ক্রিকেটার, যিনি জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি, যিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে দেশকে দুটো বিশ্বকাপ দিয়েছেন, তিনি স্রেফ কয়েক মাসের বিশ্রাম চেয়েছেন সক্রিয় ক্রিকেট থেকে। যদি মনে করেন, আর খেলবেন না, নিশ্চয়ই জানাবেন যথাসময়ে। যদি মনে করেন, আরও খেলবেন, পারফরম্যান্স করে নির্বাচিত হতে হবে। এতে সমস্যা কোথায় ভাই? কোনও লুকোছাপা তো নেই। তাহলে এত কথা কিসের? এম এসডি-র কাছে অনেক ঋণ ভারতীয় ক্রিকেটের। নিজের মতো করে কয়েকটা মাস ক্রিকেটবিহীন কাটানোর স্বাধীনতাও কি মহেন্দ্র সিং ধোনির প্রাপ্য নয়?
যে কোন পেশাতেই সঠিক সময়ে থামতে জানাটা একটা শৈলী। অধিকাংশেরই যা আয়ত্তে থাকে না। ভারতীয় ক্রিকেটেই ধরুন। কেরিয়ারের শেষ দিকে খেলা কপিলদেবকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কপিল তবু খেলা ছাড়েননি। লাজলজ্জা শিকেয় তুলে রেখে হ্যাডলির ৪৩৪ উইকেটের বিশ্বরেকর্ড ভাঙা অবধি খেলে গিয়েছেন। বেঞ্চে ম্যাচের পর ম্যাচ বসে থেকেছেন জাভাগাল শ্রীনাথ। শচীন যে শচীন, 'রেকর্ডের জন্য খেলে যাচ্ছে'-র বদনাম শেষ বেলায় তাঁকেও শুনতে হয়েছিল।
উদাহরণ আরও দেওয়া যায় বিস্তর। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বলতে গাভাসকার। যিনি ফর্মের তুঙ্গে থাকতে থাকতেই ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছিলেন। এবং বলেছিলেন, "এমন সময়েই চলে যাওয়া ভাল, যখন লোকে জানতে চাইবে, কেন যাচ্ছেন? সেই সময় অবধি অপেক্ষা করা উচিত নয়, যখন লোকে বলবে, এখনও কেন যাচ্ছেন না?"
মহেন্দ্র সিং ধোনির অতীতের ট্র্যাক রেকর্ড বলছে, তিনিও বিলক্ষণ জানেন, কোথায় গিয়ে থামতে হবে। টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন একেবারে আচমকাই। কোনও পূর্বাভাস ছিল না। কাকপক্ষীও টের পায়নি। যখন ওয়ান-ডে ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন, সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলেছিল। এত বড় একটা সিদ্ধান্তের আঁচই পায়নি কেউ। ঢাকঢোল পিটিয়ে টিমমেটদের কাঁধে উঠে গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে অবসর নিতেই পারতেন। নেননি। নেননি বলেই মহেন্দ্র সিং ধোনি আলাদা। ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার সুযোগ দেবেন কাউকে, সে বান্দাই নন। অবসরের ঘোষনা যখনই আসুক, আসবে সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েই, গ্যারান্টি। ততদিন ধোনিকে ধোনির মতো থাকতে দেওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?
এই সেদিনও বলেছেন, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওই রান আউটটা এখনও দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। এখনও ভাবেন, সেদিন ক্রিজে ডাইভ দিলে হয়তো উইকেটটা বাঁচানো যেত, হয়তো ম্যাচটা 'ফিনিশ’ করে আসতেন, দেশের হয়ে যেমন করেছেন অসংখ্যবার।
নিজের কেরিয়ার নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবনা নিশ্চয়ই আছে এমএসডি-র, নিজের সামনে অবধারিত লক্ষ্য রেখেছেন কোনও। কী সেই চাঁদমারি, ধোনিই জানেন। তবে ভাবতে ভালো লাগে, আইপিএল-এ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেন, হেসেখেলে ঢুকলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে এবং 'পুরনো' ধোনির দাপটে বিশ্বজয় করল কোহলির টিম ইন্ডিয়া। অবসরের সর্বোত্তম মঞ্চ আর কী-ই বা হতে পারে?
হয়তো এসবের কিছুই হলো না। দেশের হয়ে আর বাইশ গজে দেখাই গেল না ধোনিকে। ছেড়েই দিলেন হয়তো হঠাৎ করে। তাতেই বা কী এসে গেল? ধোনি তো ধোনিই থাকবেন, ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালীন ‘হল অফ ফেম’-এ যাঁর চিরকালীন আসন বরাদ্দ থাকবে ফার্স্ট রো-তে।
ধোনিকে ধোনির মতো থাকতে দিন। তিনি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছেন। যেটা ছিল না-ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক।
সব পেলে নষ্ট ক্রিকেট।