সংসদে ফের বোমা ফাটালেন মহুয়া মৈত্র। তৃণমুল কংগ্রেসের এমপি। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। প্রথমবার সোচ্চার হয়েছিলেন মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নিয়ে। এবার বললেন ‘আধার কার্ড’ নিয়ে। এবং তুলোধোনা করলেন সরকারের সিদ্ধান্তকে। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে কিছুদিন আগেই রায় দিয়েছিলেন প্রত্যেকটি জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রে ‘আধার কার্ড’ বাধ্যতামূলক নয়, এইবার সেই রায়ের সম্পূর্ণ উলটোদিকে হেঁটে কেন্দ্রের দ্বিতীয় মোদী সরকার চাইছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আধারকে বাধ্যতামূলক করতে। যুক্তি সেই পুরোনো—আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মজবুত করা। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-র কথা মনে পড়ে যেতে পারে কারও কারও। সেখানে যক্ষপুরীর শ্রমিকদের প্রত্যেকের আইডেন্টিফিকেশন মার্ক ছিল এক একটি সংখ্যা, যেমন ৪৭-খ, ৬৯-ঙ ইত্যাদি। অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ যেখানে নিজেদের সত্তা হারিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত দাস-এ রূপান্তরিত হয়। সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া কয়েকটি সংখ্যা মাত্র তারা। তার চেয়ে বেশি কিস্যু নয়। জর্জ অরওয়েলের সেই বিখ্যাত উপন্যাস মনে পড়ছে? ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’—যেখানে অতিকায় দানবিক রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার শেষতম টুঁটি টিপে ধরেছে। মানুষ হয়ে উঠেছে ‘খেলনামানুষ’। রাষ্ট্রের হাতের পুতুল মাত্র।
আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি
কোনও আগুনখোর বামপন্থী নেতা বা নেত্রী নন। আধারের বিরুদ্ধে এই তীব্র প্রতিবাদ করলেন একজন বাঙালি নারী। যিনি একটি তথাকথিত ‘দক্ষিণপন্থী’ আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। যাঁর পূর্ববর্তী সংসদ-বক্তৃতাটির মতোই এটিও রাতারাতি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মার্কিন মুলুকে পড়াশুনো-করা, বিদেশি ব্যাংকের উঁচু পদের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া এই বাঙালি মেয়েটির তুখোড় বক্তব্যের সামনে ধুয়ে গেল সংসদ। আর গোটা দেশ পেল আর একজন মহিলা রাজনীতিক-আইকনকে। যিনি খুব সহজেই সচেতন দেশবাসীর মনোযোগ আর আকর্ষণ আদায় করে নিয়েছেন এক মুহূর্তেই। সরকার ‘আধার বিল ২০১৯’ লোকসভায় পাশ করিয়ে নিতে চেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কিন্তু মহুয়ার তোলা প্রশ্নগুলো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে সরকারকে। উদ্দীপিত করেছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে।
মূলত তিনটি সমস্যার দিকে আলোকপাত করেছেন মহুয়া। ‘আধার’ যে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও তথ্য-নিরাপত্তার পক্ষে ভয়ানক তা বোঝাতে গিয়ে মহুয়া বলেন—প্রথমত, আধার ভারতীয় নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করছে। যে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা ভারতীয় সংবিধান ঘোষণা করেছে, আধার সেই অধিকারেরই পরিপন্থী। ব্যাংক অথবা টেলিকম সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমরা বাধ্য হচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত বায়োমেট্রিক তথ্য কয়েকটা প্রাইভেট সংস্থাকে দিতে। যদিও সরকারের দাবি পুরো তথ্য আদানপ্রদানের সিস্টেম অকেজো হয়ে গেলেও সরকারি ব্যবস্থায় সেই রক্ষাকবচ থাকছে যার সাহায্যে লুপ্ত তথ্য পুনরুদ্ধার করা যাবে, কিন্তু মহুয়া পরিষ্কার বলেছেন সরকারের এই দাবি অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত। এটা ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ‘আধার বিল’-এর ৫ নং ধারা নিয়ে মহুয়ার অভিমত, আমাদের দেশে কোনও সর্বজ্নগ্রাহ্য ও সর্বমান্য তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত রক্ষাকবচ নেই । কোনও সুরক্ষা-ব্যবস্থা ছাড়া কীভাবে সরকার এরকম কোনও সর্বনাশা নির্দেশ দিতে পারে, যার সাহায্যে যেকোনও মানুষের নিজস্ব তথ্য অনায়াসেই প্রাইভেট সংস্থার হাতে চলে যেতে পারে? এ তো ঘোড়ার আগে জুড়িগাড়িকে আটকে দেওয়া। যতক্ষণ না সরকার তথ্যের অধিকার সুরক্ষিত করছেন ততোক্ষণ এই আইন পাশ হতে দেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন, বাঙালিকে কি তৃণমূল বা বিজেপি হতেই হবে?
আধার নিয়ে এই বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। সেই কার্গিল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন ‘আধার’-জাতীয় একটি ব্যক্তি-আইডেন্টিটি কার্ডের ভাবনা প্রথম আসে এবং তৎকালীন বিজেপি সরকার ও পরবর্তী ইউপিএ সরকার উভয়েই এই বিষয়টিকে নিয়ে অগ্রবর্তী হন, তখনই বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র আপত্তি দানা বাঁধতে থাকে। ২০০৯ সালে যোজনা কমিশনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা UIDAI, ইনফোসিসের কর্ণধার নন্দন নিলেকানি হন এই সংস্থার চেয়ারম্যান। ২০১৭-২০১৮র মধ্যে আরও অন্তত বেশ কয়েকটি সরকারি প্রকল্পকে আধারের সঙ্গে যুক্ত করা হয় যেমন, সোশ্যাল অ্যাসিস্টান্স প্রোগ্রাম, ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন স্কিম, এলপিজি সাবসিডিজ, জন ধন যোজনা—এই সমস্ত সরকারি প্রকল্পে আধার বাধ্যতামূলক হয়। দেশের ৯১.৭% মানুষ ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পের আওতায় আসে অর্থাৎ আধার নথিভুক্ত করে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে আধারের সঙ্গে প্যানকার্ডের সংযুক্তিকরণের নির্দেশের সাথে সাথেই ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতম আমানতও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে চলে যায়। এমনকি মিড-ডে মিল খেতে গেলেও আধার সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। যে কৃষকেরা ‘নরেগা’ প্রকল্পে কাজ করেন তাদের মজুরি প্রাপ্তির জন্যও এই কার্ড বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্চর্য হল ইউপিএ জমানায় বিজেপি আধার সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আর ক্ষমতায় এসে তারাই এই বিল আনছে এবং আগ্রাসী পদ্ধতিতে একে প্রয়োগ করতে চাইছে। প্রাইভেট এজেন্সির কাছে এইভাবে ব্যক্তিগত তথ্য চলে গেলে তা একসময় জাতীয় নিরাপত্তা আর সার্বভৌমত্বের পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড থাকা সত্ত্বেও এই আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করার পিছনে ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বলবৎ করা এবং ক্রমে ভারতকে একটি সর্বাত্মক পুলিশ-রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না। ‘আধার বিল ২০১৯’ সরাসরি ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ আইনের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রীয় স্ববিরোধিতার নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা অন্য একটি দিক থেকেও রয়েছে। এবং সেটি আরও বিপজ্জনক। আধার কার্ডের তথ্য যে অনায়াসেই হাতিয়ে নেওয়া যায়, তার প্রমাণ সম্প্রতি তিনটি সংস্থা, ‘সুবিধা ইনফোসার্ভ’, ‘অ্যাক্সিস ব্যাংক লিমিটেড’ এবং ‘ই-মধুরা’ ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের জেরে সাইবার ক্রাইমের দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয়েছে এবং এ থেকেই প্রমাণিত হয় সরকার যে তথ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তা আদতে গালগল্প ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
আরও পড়ুন, এক দেশ এক নেতা এক আদর্শ এক ধর্ম এক শ্লোগান: এই কি ভবিতব্য?
সবচেয়ে বড়ো কথা, আধার কার্ডের ক্লোন বানানো অত্যন্ত সহজ। প্রথমত একটি স্থানে নির্দিষ্ট কিছু দিন বসবাস করলেই আধার কার্ড পাওয়া যায়। অতি সম্প্রতি দেখা গেছে, দিল্লির মোট জনসংখ্যা যেখানে ১৭.৭ মিলিয়ন, সেখানে জনগণের হাতে আধার কার্ডের সংখ্যা ১৯.২ মিলিয়ন। অর্থাৎ অনায়াসেই আধার কার্ড জাল হচ্ছে এবং সেটা অসাধু উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে, নিশ্চিত। আধার একটি সুনির্দিষ্ট ধরনের ফোটো-আইডেনটিটি কার্ড। অথচ এই কার্ডের সবচেয়ে বড়ো বিপদ বা দুর্বলতা হল একে অনায়াসেই কপি করা যায়। এর অথেনটিকেশন পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত নয়। এটিকে ফিজিক্যাল আইডি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না, যেহেতু এতে কোনও মাইক্রোচিপ বা হলোগ্রাম থাকে না। এর সমতুল্য ই-আধার কার্ড অনায়াসেই বানিয়ে নেওয়া যায়। আধারের ক্ষেত্রে মূল কার্ড এবং প্রিন্ট-কার্ডের মধ্যে কোনও ফারাক থাকে না। ফটোশপের মাধ্যমে এটি অনায়াসেই পুনরুৎপাদন করা যায়। সুতরাং এর আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু বলেই মনে হচ্ছে। কোনও কোনও সমাজবিজ্ঞানী যেমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভোটার কার্ডের সঙ্গে যুক্ত করে ভোটদানের ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক করা হলে ইভিএম অনায়াসেই হ্যাক করা যাবে। নাগরিকের ভোটদানের গোপনীয়তা সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারও আর রক্ষিত হবে না। ফলত, কোনও একটি শাসকদল এই কার্ডটিকে অনায়াসেই ভোটে জেতার হাতিয়ার বানিয়ে ফেলতে পারে, ভোটদান প্রক্রিয়াকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
আধার-বিতর্কের মধ্য দিয়ে আসলে গণতন্ত্রের কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নকেই আরও একবার তুলে ধরলেন মহুয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিন ছিলেন গোটা ভারতে মোদী-বিরোধিতার অন্যতম মুখ। কিন্তু মহুয়ার মতো চোস্ত ইংরেজি-বলা, অসম্ভব ক্ষুরধার পার্লামেন্টারিয়ান তিনি নন। মহুয়া আসলে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন উদীয়মান ভারতের নব্যশিক্ষিত এলিট সম্প্রদায়ের কাছেও। একইসঙ্গে সাধারণ জনতার কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন তাঁর চূড়ান্ত দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে ‘আমি তোমাদেরই লোক’-গোছের একটি ইমেজকে মান্য করে তুলতে পারার মধ্য দিয়ে। পরপর দুটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আজকের ভারত আসলে সেই নতুন সময়ের উপযোগী নেত্রীকেই খুঁজে পেল।
(অর্ণব সাহা শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক)