আমাদের চারপাশে ঘটমান যা কিছু, তার মধ্যে কয়েকটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিছু চিরস্থায়ী। বলা বাহুল্য, সমাজের ক্ষেত্রে এই চিরস্থায়ী ঘটনাগুলির প্রভাব অনেক বেশি গভীর, বিস্তৃত, ও শক্তিশালী। অন্ধ কুসংস্কার এমনই এক নেতিবাচক বিষয়। আমাদের অতি দুর্ভাগ্য, প্রযুক্তির চূড়ান্ত উন্নতির মাঝে দাঁড়িয়েও এই বিষয়ে কিছুই করে উঠতে পারিনি আমরা। চরম অক্ষমতা প্রতি পদক্ষেপে আমাদের বোধ, চেতনা ও মননকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছে।
এই একটা ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর মিলেমিশে একাকার। আজও আমাদের অসহায় চোখের সামনে ঘটে যায় এক-একটি নারকীয় ঘটনা, যেখানে কুসংস্কারের বলি সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতা। আইন-প্রশাসন, শিক্ষা-সচেতনতা, কোনও কিছুই দমন করতে পারছে না এই ভুল বিশ্বাস, কুচিন্তা, চর্চা ও প্রক্রিয়া। একদল স্বার্থান্বেষী ও কুচক্রীর হাতের পুতুল হয়ে, দিনের পর দিন অন্ধ কুসংস্কারের শিকার হয়ে চলেছেন মানুষ।
মালদার গাজোলে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই অসহায় শিশুর মৃত্যু আরও একবার এই ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। এখানে কোনও যুক্তিতেই ব্যাখ্যা মেলে না শিশুদের পরিবারের আচরণের। খুবই সাধারণ এক প্রেক্ষিত। খেলার মাঠ থেকে ফিরে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে এলাকার চারটি শিশু। স্বাভাবিক নিয়মে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াটাই এক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু না, তা না করে ওঝা ডাকেন অভিভাবকরা। তার পরের ঘটনা সংবাদসূত্রে সকলেরই জানা। ঘন্টা দুয়েক ধরে ঝাড়ফুঁকের ফলে একটা সময় সহ্য করতে না পেরে নেতিয়ে পড়ে শিশুগুলি। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই দুজনের মৃত্যু হয়। মালদা হাসপাতালে ভর্তি বাকি দুই শিশুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
আরও পড়ুন: প্রিয় বিরাট, মনে রাখুন, আগ্রাসন মানে অসভ্যতা নয়
এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী কে? নিঃসন্দেহে প্রথমেই বলতে হয়, অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন শিশুদুটির অভিভাবকের কথা। তারপর আশপাশের মানুষ। আচ্ছন্ন তো তাঁরাও। আর সেই ওঝা, যে চিকিৎসার নামে এই ভণ্ডামি, বুজরুকি চালিয়ে যাচ্ছে, সে তো সমাজ ও আইনের চোখে সম্পূর্ণভাবেই একজন অপরাধী। কথা হলো, এই অপরাধের দায়ভাগ শিশুদের বাবা-মাও এড়াতে পারেন না। তাঁদের প্রশ্ৰয়েই এই জাতীয় অসাধু প্রক্রিয়াগুলি চলছে আজকের যুগেও। অবাক লাগে ভাবতে, গাজোল কিন্তু এমন কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল নয়। তা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে সচেতনতার এহেন অভাব। এই শিশুদের জীবনের বিনিময়ে সেই সচেতনতা কি আসবে? তারই পাশাপাশি এই ওঝার প্রতি কতটা কঠোর হয় প্রশাসন, সেটাও দেখার।
গত বছরের আরও একটি শিউরে ওঠা খবর। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। পাঁচজন মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে এমনভাবে মারে গ্রামবাসী যে তাঁদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা তো মারাই যান। বাকিরাও মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হন। গ্রামে কিছুদিন ধরে সবার জ্বর, সর্দিকাশি হচ্ছিল। এর কারণ হিসেবেই এক জানগুরুর বিধান, ওই মহিলারা ডাইনি এবং তাঁদের দ্বারাই অসুস্থ হচ্ছেন গ্রামবাসী। জানগুরুর বিধান ও নিদানে লোকজন ওই মহিলাদের ধরে এনে মারধর শুরু করে। পরে পুলিশ এসে বৃদ্ধাকে মৃত অবস্থায় পায়। বাকিরাও ততক্ষণে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে দেয়।
এই যে গ্রামের সালিশি সভা, যেখানে জানগুরু বা ওঝা ডেকে বিধান নেওয়ার প্রচলন, এটা কিন্তু রীতিমতো দেশের আইনব্যবস্থাকে ছুড়ে দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ। বলা বাহুল্য, প্রশাসনকে প্রায়ই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষেও সমান কার্যকর ভূমিকা নেওয়া সম্ভব হয় না। যে কোনও ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এদেশের সমাজের পক্ষে ক্রমশ এক অভিশপ্ত অধ্যায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কুসংস্কার বিরোধের ক্ষেত্রে বা এই সংক্রান্ত অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও সেই ভোটের রাজনীতি প্রায়ই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও রয়েছে কায়েমী স্বার্থের একটি ভয়াবহ দিক। যে কোনও কাউকে সম্পত্তি বা অন্য কিছুর লোভে বা নিছক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে প্রথমে টার্গেট করো। তারপর তাঁকে 'ডাইনি' সাজিয়ে প্রহার ও হত্যা। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ও কায়েমী স্বার্থ মিলে গিয়ে চিত্রনাট্য রচনায় বাড়তি সুবিধা করে দেয়। আর এই নোংরা খেলায় প্রাণ যায় অসহায়, নিরীহ মানুষের।
আরও পড়ুন: মৃত্যু উপত্যকায় চিকিৎসক
একটু খেয়াল রাখলে দেখা যাবে, ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারার ঘটনা প্রায় রোজই খবরে থাকে। এতটাই নিয়মিত ঘটে যে, কিছুদিন আগেও এই জাতীয় খবরে যতটা প্রতিক্রিয়া দেখা যেত সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন স্তরে, এখন আর সেটাও দেখা যায় না। অর্থাৎ, বিষয়টাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। ভাবুন পাঠক, আমরা, এই একুশ শতকের মানুষ, মঙ্গলে যান পাঠিয়ে দুহাত তুলে নাচছি। সেই আমরাই একজন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা বা একাধিক মানুষ মিলে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আর এটাই হলো সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। অপরাধমূলক কাজকর্মে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। বলা বাহুল্য, আমাদের সামাজিক উন্নয়ন এবং উত্তরণ, দুটোই এই সব ঘটনায় কোথাও যেন চূড়ান্ত এক প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়।
একেবারে অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। গুজরাতের ভূজ। সেখানকার একটি আবাসিক কলেজে মেয়েদের পোশাক খুলে ঋতুস্রাবের পরীক্ষা দিতে হয়। কলেজের নিয়ম অনুযায়ী, এই অবস্থায় ছাত্রীরা হোস্টেলে অন্যদের সঙ্গে খেতে বসতে পারবে না। তো, সেই নিয়ম তারা মানছে কিনা, সেটা দেখতেই এই পরীক্ষা। কুসংস্কারজনিত আচরণ বর্বরতার কোন চরম সীমা ছাড়িয়েছে, এ কান্ডটি তার এক উৎকৃষ্ট প্রমান। সারা দেশ লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। সারা দেশের মানুষ নিন্দায় মুখর হয়েছেন। অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন এই বাবদে আপাতত পুলিশ হেফাজতে। কথা হলো, এমন অসুস্থ, অযৌক্তিক নিয়মের প্রবক্তা কারা? একা অধ্যক্ষ বা তাঁর সহকর্মীরা তো নন। এর সঙ্গে কলেজের পরিচালন সমিতিও আছে। তারাও কি শাস্তি পাবে? নাকি সেখানেও সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকে বসে থাকবে?
কুসংস্কারের একেবারে সুনির্দিষ্ট দুটি দিক আছে। যেটা আলোচনাসূত্রে অনেকটাই খোলসা হয়ে এলেও এবার তাকে যথাযথ বিশ্লেষণে হাজির করব। এক, সামাজিক অন্ধতা। তা দূর করার দায় আমাদের সকলের। মানুষকে সচেতন করা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শিকড় উৎপাটনের কাজটা সবাই মিলেই করতে হবে। বেশ কিছু সমাজসেবী সংগঠন এ ব্যাপারে নিরন্তর নানা গঠনমূলক কাজ করে চলেছে। তাদের সমর্থন তো করতেই হবে। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টাটাও চালিয়ে যাওয়া দরকার। এটা হলো কাজের একটা দিক।
অন্যদিকে এই গুরু, ওঝা ইত্যাদির কুচক্রটাও ভেঙে ফেলা আশু প্রয়োজন। এই গুরু প্রসঙ্গেই মনে পড়ল সদগুরুর কথা। আসল নাম জগ্গি বাসুদেব। ইনি একজন আধ্যাত্মিক গুরু। অধ্যাত্মবাদের আঁতুড়ঘর ভারতবর্ষের মানুষ গত কয়েক দশকে অধ্যাত্মবাদকে অজস্র স্বঘোষিত গুরুর অসামাজিক কার্যকলাপে বহুবার ধর্ষিত হতে দেখেছেন। অধ্যাত্মবাদ দূর, এরা মানবতার চরম শত্রু। মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এরা কোটি টাকার সম্পত্তি বানায়। আইন ও প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে।
আরও পড়ুন: পোলবা আরও একবার বুঝিয়ে দিল, সব পেশা সমান নয়
তা সে যাই হোক, সদগুরুর 'মাতৃদুগ্ধ' প্রসঙ্গে নয়া থিওরির একটি ভিডিও প্রবলভাবে ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওতে সদগুরুর বক্তব্য, যমজ সন্তানের একটি ছেলে ও অপরটি মেয়ে হলে মায়ের দুটি স্তন থেকে সেই হিসেবেই দু'প্রকার দুধ নির্গত হয়। একবার ভেবে দেখবেন পাঠক। এ তো শুধু অন্ধ অজ্ঞানতাকে ডেকে আনা নয়। মিথ্যাচার, কুসংস্কার এবং প্রবল নোংরামি।
এইসব মানসিকভাবে অসুস্থ অপরাধীরা আধ্যাত্মিক গুরু হয়ে সমাজের ওপর বসে থাকলে এ সমাজ কোনও দিন কুসংস্কারমুক্ত হবে না। অর্থাৎ সমাজকে এদের প্রভাবমুক্ত করাটাও সার্বিকভাবে প্রয়োজন। একাজে প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদেরও সমান সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। প্রসঙ্গত, যাঁরা এই অযৌক্তিক, অবিজ্ঞানসম্মত ভিডিওটিকে পাইকারি হারে ভাইরাল করলেন, সমাজের সেই মানুষগুলিকেও চিহ্নিত করা জরুরি। এঁরাই এক সময় গণেশের দুধ খাওয়ার খবর মিডিয়ায় ছড়িয়েছিলেন। আজ এঁরাই মাতৃদুগ্ধের ভিডিও ভাইরাল করেন। ডাইনি প্রথা, সাপে কামড়ালে ওঝা, ভূতপ্রেত, কালা যাদুর মাহাত্ম্য প্রচার এঁদেরই উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।
যুগের বদলে এই মুখগুলি বদলায় না। আক্ষেপ ও চিন্তার বিষয়, সংখ্যায় ক্রমশ বাড়ছেন এঁরা। গ্রাম-শহর নিবিশেষে সর্বস্তরে এঁদের আটকানোটাও আজ সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুসংস্কার এমন এক প্রথা, যার শিকড় ছড়ানো সমাজের অনেকটা গভীরে। উন্নত প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে তার প্রচার নয়, উৎপাটনের কাজটি করতে হবে ব্যাপক হারে।