মুখ্যমন্ত্রীর মমতাময়ী মন ও মননের পরিচয় পাওয়া গেল নতুন করে। বিধানসভা বা মন্ত্রিসভার কোনও বৈঠকে নয়, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের দুর্গাপূজা কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, মহানগরের তিন হাজার ও জেলার পঁচিশ হাজার পুজা-কমিটিকে সরকার মাথাপিছু দশ হাজার টাকা অনুদান দেবে। এ-জন্য সাকুল্যে খরচ হবে মাত্রই আঠাশ কোটি টাকা। মেলাখেলার রাজ্যেও এই ঘোষণা অভূতপূর্ব।
রাজ্যের হাঁড়ির হালের কথা মুখ্যমন্ত্রী সময়বিশেষে প্রায়শই মনে করিয়ে দেন। বামফ্রন্ট সরকারের নেওয়া বিশালাঙ্কের টাকার সুদ গুনতেই তাঁর পক্ষে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সে-কারণে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ্যভাতাও দিয়ে উঠতে পারছেন না। অভাবে স্বভাব নষ্টের মতো সংবেদনশীল মুখ্যমন্ত্রীকে সে-জন্য বাধ্যত দাবিদার কর্মচারীদের সারমেয় আখ্যাও দিতে হয়েছে। দুর্জনেরা বলে, কলেজশিক্ষকদের এককালীন অবসরপ্রাপ্য দেওয়া অসম্ভব বলেই তাঁদের চাকরির মেয়াদ আপাতত বাড়াতে হয়েছে তাঁকে। সম্প্রতি অর্বাচীন সাংবাদিকরা এমন তথ্যও ফাঁস করে দিয়েছেন যে, সামান্য তিন কোটি টাকার অভাবে মাঝেরহাট সেতুর সংস্কারকাজে হাত দেওয়াই হয়নি। অবশ্য, সংস্কার বলতে আগের মতোই সেতুর ভারবাহী জোড়াতালিই হত কি না, তা স্পষ্ট নয়।
আরও পড়ুন, গেরুয়া শিবিরকে রুখতেই কি দুর্গাপুজোয় ‘দান খয়রাত’?
সংসারে দুঃখকষ্ট দারিদ্র থাকবেই। তাই বলে সম্বাৎসরিক উৎসব হবে না, তা নয়। কবিও বলে গেছেন, ‘প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।’ এখানেই শেষ নয়। কবি আরও বলেছেন, ‘নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।’ আমরাও তো জানি, আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, তবু আনন্দ জাগে। মুখ্যমন্ত্রী সদন-নন্দন প্রাঙ্গণ থেকে পঁচিশে বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতী কবিপ্রণামের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলেও যথেষ্ট-সমারোহে রবীন্দ্র-নজরুল উৎসব হয়ে থাকে। তার প্রচারচিত্রে তিনিও থাকেন সবিশেষ-স্বরাট হয়ে। আমাদের এ-ও মনে থাকে, তিনি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, মেলাখেলা হবে না তো কঙ্কালমেলা হবে নাকি। ঠিকই, নেত্রী সেই কবিকথিত পূর্ণতাপ্রয়াসী। পূজাকমিটিগুলির অনুদানও নেত্রীর সেই মহামননের সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞান। এই সিদ্ধান্ত অনুধাবন করতে রবীন্দ্রচেতনা প্রয়োজন।
বিজেপি-র মতো দুর্দলের পক্ষে মহানুভব নেত্রীর এহেন উৎসবদর্শনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সে-কারণেই তারা বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছে। কিন্তু, কিছুদিন আগেই মেদিনীপুরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার ম্যারাপ ভেঙে যখন বিজেপি-কর্মীরা জখম হলেন, তখন মানুষ ফের মুখ্যমন্ত্রীর সহৃদয়তার পরিচয় পেয়ে ‘ধন্য-ধন্য’ করলেও, বিজেপি তখন মুখে কুলুপ এঁটেছিল। মুখ্যমন্ত্রী সে-বার নিজের ত্রাণ-তহবিল থেকে বিরোধী দলের কর্মীদের অনুদান দিয়েছিলেন। স্রেফ মানবিকতার কারণে তিনি তখনও মনে রাখেননি, ত্রাণ-তহবিলের অর্থ আসে সাধারণ মানুষের সপ্রাণ-দান থেকে। সেই দান তারা করে থাকে বন্যা-খরাদুর্গতদের জন্য। মুখ্যমন্ত্রী যে সে-সব জানেন না, তা নয়। কিন্তু, ওইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ অজুহাত তিনি কোনওদিনই গ্রাহ্য করেননি। এখানেই তিনি অগ্নিকন্যা, মহানেত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও চিরপ্রতিষ্ঠানবিরোধী। বিজেপি-র পক্ষে সম্ভব নয় ওই দর্শন অনুধাবন করা।
আমাদের মনে আছে, ২০১২ সালে যখন দক্ষিণ ২৪-পরগনার উস্তিতে বিষমদ খেয়ে ১৭২ জনের মৃত্যু হয়, তখনও মুখ্যমন্ত্রী সব নীতিনিয়ম তুচ্ছ করে মৃতদের পরিবার ও বিষগ্রস্তদের এমনই সপ্রাণ-অনুদান দিয়েছিলেন। তিনি তখন মনে রাখেননি এমনকী ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রাসঙ্গিকতাও। যে-দণ্ডবিধি বলে, চোলাইমদ বিক্রির মতো চোলাইমদ গলাধঃকরণও অপরাধবিশেষ। তখনও মানবিকতাই ছিল তাঁর আশু-অবলম্বন। আইনের চুলচেরা বিচার ছিল অর্থহীন। কেননা, তিনি জানতেন, চোলাইগ্রাহকরাও দেশের নাগরিক। দেশ গড়ার (পড়ুন রাজ্য) কাজে তারাও কম-কিছু নয়। কেননা, তাদেরও সুনিশ্চিত ভোটাধিকার আছে।
দেশে এ-বিষয়ে মমতার একমাত্র কিঞ্চিৎ-তুলনা চলতে পারে তামিলনাড়ুর ঐতিহাসিক মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী নেত্রী জয়রাম জয়ললিতার। ভোটের আগে তিনিও নানা উপঢৌকনের ডোল নিয়ে নিমজ্জিত হতেন জনসাগরে। জনতাও বরাবর উদ্বেল হত আম্মার সহৃদয়তায়। অবশ্য, রাজ্যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুতুভেল করুণানিধিও জয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে আসরে নামতেন। তবে, কখনও বিশেষ পেরে উঠতেন না। কেননা, আম্মার কেবল চটিজুতোর সংখ্যাই ছিল আটশো। তাঁরা দু-জনেই আজ ইতিহাস।
বিজেপি বা দুর্জনদের পক্ষে নেত্রীর এই মহানুভবতা অনুভব করা অসম্ভব। কারণ, ক্ষমতায় আসার বছর না-ঘুরতেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার আদালতের রায় নিয়েই বুক ঠুকে হজযাত্রার অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের অংশীদার ছিলেন প্রখ্যাত বিচারপতি আফতাব আলমও। সরকার নিজস্ব এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানভাড়া, বিমানবন্দর-খরচ ও হজশুল্ক বাবদ বছরে সাতশো কোটি টাকা খরচ করত হজযাত্রীদের জন্য। সেই অনুদান বন্ধ করায় বিজেপি-র বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নতুন করে উঠেছিল। বিজেপি-র সেই অভিযোগে কিছু আসে-যায়নি। কেননা, ঘোষিতভাবেই তারা দেশকে সরাসরি হিন্দু-মুসলমানে, বিজেপি-অবিজেপিতে বিভাজিত করতে সক্রিয়। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্তে হিন্দু-দেবদেবীর মতো হিন্দুত্ববাদীরাও প্রীত হয়েছে। বিশেষত, একজন মুসলমান-বিচারপতির রায়ে সাধারণভাবে সংখ্যালঘুদের আপত্তিও অগ্রাহ্য করা গিয়েছিল। সর্বোপরি, মোদী বা ভাগবতের এমন জবাবদিহিরও কোনও দায় ছিল না যে, দেশের কুবেরপ্রায় দেবস্থানগুলিকে গেরুয়াবাদী সরকার সাতশো কোটি টাকার বেশি কর বা শুল্কছাড় দেয় কি না। কেননা, রামরাজত্বে সেই প্রশ্নই অস্বাভাবিক।
কিন্তু, মমতা যে কেবল দুর্গাপূজায় অনুদান দিয়ে সংখ্যাগুরুতোষণ করলেন, তা মোটেই নয়। তিনি কেবল চতুর্থী থেকে পুজোসূচনা করেন না, ইদের নমাজেই কেবল নতমস্তক হন না, বহুকাল আগেই তিনি ইমামভাতার সূচনা করেছেন। মুসলিম-জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর বদান্যতা ওই-একটি সিদ্ধান্তেই প্রতীয়মান। কেননা, সাচার-কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ যা-ই বলুক, তিনি নিশ্চিত জানেন, ইমামদের ভাতা-দেওয়া মানেই সার্বিক জনগোষ্ঠীর অগ্রসরতা। এই প্রসারিত-মন বিজেপি বা সিপিয়েমের নেই।
ক্ষেত্রবিশেষে ধনাঢ্য-পূজাকমিটিগুলির উপর শুল্ক চাপানোর মতো স্বৈরাচারী পদক্ষেপ মুখ্যমন্ত্রী নীতিগতভাবেই করতে পারেন না। আগে তিনি রাজ্যের ক্লাবগুলিকেও বিপুল অনুদান দিয়েছেন। তিনি কখনও দেখতে যাননি, সেই অর্থে ক্লাবগুলি বিয়েবাড়ি বানাচ্ছে, না সঙ্ঘে-সঙ্ঘে এক-একজন স্বপ্না বর্মন তৈরি হচ্ছে। এই কাজটি অবশ্য শুরু করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অসীম দাশগুপ্ত। অমর্ত্য সেনের ছাত্র নিশ্চয়ই ভাবেননি, ক্লাবগুলি এক-একটি ‘প্রতীচি ট্রাস্ট’ তৈরি হবে। তিনিও চেয়েছিলেন, ক্লাবগুলি যাতে ভোটের আখড়া তৈরি হয়। তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হয়নি বলেই যে মমতারও হবে না, তা নয়। কেননা, তিনি জানেন, অনুদানে বিশ্বাস হারানো পাপ। তবে, মুশকিল একটিই। এরপর পুজোর বাজারে ‘দুষ্টু’ বিজেপি-ও নামবে টাকার থলি নিয়ে। তারা টাকার কুমির। সকলেই জানি, অর্থ কখনও প্রত্যাখ্যাত হয় না, তার কোনও রাজনৈতিক রং নেই। নেপোয় মারবে দই। সব মিলে এবারের শারদোৎসব যে সোনায়-সোহাগা হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
(মতামত ব্যক্তিগত)