Advertisment

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের

মানবের ছাত্র ছিলুম পাঁচ বছর। বি.এ, এম.এ. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্যে। বি.এ. পর্বের তৃতীয় বর্ষে একটি সাবজেক্ট ছিল বাংলায়, তিরিশ দশকের পাঁচ কবির বাংলা কবিতা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দুই দশক, তিন দশক শত শত ছাত্র পড়িয়েছেন, শিক্ষিত করেছেন, গুরু হিসেবে মান্য, অথচ অবসরের পরে ছাত্র-ছাত্রী পারতপক্ষে ধারেকাছে ঘেঁষতে নারাজ।

মন্ত্রী-আমলা ক্ষমতাহীন হলে কেউ পোছে না। এমনকি পিয়ন, আর্দালিও নয়। সালাম, নমস্কার থেকেও বঞ্চিত। শিক্ষকের বেলায় আলাদা। তিনি গুরুজন। কিন্তু তাঁরও দুঃখ। দুই দশক, তিন দশক শত শত ছাত্র পড়িয়েছেন, শিক্ষিত করেছেন, গুরু হিসেবে মান্য, অথচ অবসরের পরে ছাত্র-ছাত্রী পারতপক্ষে ধারেকাছে ঘেঁষতে নারাজ। খোঁজখবর নিতেও অনীহা। শিক্ষক যদি অকৃতদার হন, ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত। আশেপাশে কেউ নেই নিজের, নিজেকেই কথা বলতে হয়। শ্রোতাও পাওয়া দুষ্কর। শিক্ষককে ঘিরে একদা ছাত্র-ছাত্রীর সম্মিলন। নানা আবদার। শিক্ষক তার স্নেহ উজাড় করেন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা। শিক্ষক যখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে একা, মাঝে মাঝে হয়তো নিঃসঙ্গতায় অতীতের ছাত্র-ছাত্রীর কলরব শুনতে পান। কানে বাজে। আসলে ভ্রম। একজন শিক্ষক, প্রতিটি ক্লাসে, দিনের পর দিন, ৪৫/৫০ মিনিট বিরতিহীন কথা বলেন, এই অভ্যেস নিঃশেষ অবসর গ্রহণে।

Advertisment

-এরকমই বলেছিলেন একবার অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্লাসে নয়, তাঁর ফ্ল্যাটে। একা থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে বহুকাল বিচ্ছেদ। কন্যা নিয়ে স্ত্রীর বাস, আস্তানা কানাডা। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়িয়েছেন তিন দশকের বেশি। অধ্যাপক হিসেবে বহুল খ্যাতিমান এমন নয়। ছাত্র-ছাত্রী তাঁকে পছন্দ করতেন, সমীহ করতেন ঠিকই, কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে। কারণও ছিল। কাট কাট কথা বলতেন। চাঁচাছোলা কথা। অবশ্য আঙুলে গোণা কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী যাঁরা তাঁর পছন্দ, নিকটতম, আস্তানায় গিয়ে আড্ডা দিতেন। নিছকই আড্ডা। পড়ালেখা কিংবা জ্ঞানগম্যির কথা নয়, আলোচনা নয়।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগেরই ছাত্র। প্রথম ব্যাচের। বুদ্ধদেব বসুর হাতে গড়া তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ। প্রথম ব্যাচে পাঁচ জন ছাত্র। পাঁচজনের চারজনই পরে এই বিভাগের শিক্ষক। প্রত্যেক ছাত্রই বহুমানিত, নামী। লেখক। প্রাবন্ধিক। খ্যাতি বিস্তর। যেমন নবনীতা দেবসেন। তিনিও প্রথম ব্যাচের। এবং একমাত্র ছাত্রী।

যাদবপুরে ভর্তির আগে মানবেন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন, শেষ করেননি, বুদ্ধদেব বসুর টানে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে ছাত্রত্ব। টান বোধ হয় স্থায়ী হয়নি।

প্রথম ব্যাচের পাঁচজনের তিনজনই ডক্টরেট, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানব নন। যাদবপুরের পরে টরেন্টো, পোল্যান্ডের ভাসভি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গবেষণা। বিষয়, ভারতীয় সাহিত্যে তুলনামূলক নন্দনতত্ত্ব। ডক্টর উপাধিধারী নন অথচ ওঁর কাছে ডক্টরেট করেছেন ছাত্র-ছাত্রী। বেঁটে খাটো মানুষ। রসিকতা করতেন, "আমার চেয়েও লম্বায় কম দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় (অসাধারণ গাল্পিক, গদ্যকার, কমিউনিস্ট, একদা 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদক)"। 'বেঁটে বামুন হলে কী হবে, দেশি-বিদেশি সাহিত্যে ঈর্ষণীয় পাণ্ডিত্য। মানবের মতো এত বই আমরা পড়িনি', কবি-সাংবাদিক-অনুবাদক সমীর দাশগুপ্তের ভাষ্য। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও স্বীকার করতেন। বলা হয়, সুনীলের মতো পাঠক সমকালীন সাহিত্যিকদের মধ্যে খুব কম।

মানবেন্দ্র যাদবপুরেই নয় শুধু, কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছেন, ভারতীয় সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে। আমাদের আফসোস, সাহিত্যের প্রবন্ধ, তথা সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন সামান্য। প্রশ্ন করলে উত্তর, "অনেকেই আছেন, লিখছেন। লিখবেন।"

মানবের ছাত্র ছিলুম পাঁচ বছর। বি.এ, এম.এ. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্যে। বি.এ. পর্বের তৃতীয় বর্ষে একটি সাবজেক্ট ছিল বাংলায়, তিরিশ দশকের পাঁচ কবির বাংলা কবিতা। মানবের ক্লাস। যারা ইংরেজি বেছে নিয়েছিলেন (ছাত্র-ছাত্রী), বাংলা কবিতা পাঠে অনীহা। জীবনানন্দের 'সমারূঢ়' পড়িয়ে, গুঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ শেষ করে বললেন, "এই কবিতা অধ্যাপক সুকুমার সেনকে নিয়ে লেখা জীবনানন্দের মুখে শুনেছি।"

মানবেন্দ্র ছোটদের জন্য বই-ই অনুবাদ করেননি কেবল, নিজেও লিখেছেন। পুরস্কৃত। অনুবাদের জন্যেও। বিশেষত বিদেশি সাহিত্য, কবিতা অনুবাদে। একাধিক পুরস্কার। বলতেন, "তাঁদের প্রাপ্য, অনুবাদ করেছি যাঁদের।" ইংরেজি সাহিত্য বেশি করেননি। বেছে নিয়েছেন ল্যাটিন আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে প্রথম অনুবাদ করেছেন বাংলায়। আরো অনেককে। অনুবাদ তাঁর হাতে মূল ও মৌলিক সাহিত্য, পরিচ্ছন্ন, শৈল্পিক। তাঁর মতো অনুবাদক দুর্লভ। সিদ্ধ। অনুবাদক হিসেবেই খ্যাতি, ভুলে যাই, মূলত কবি তিনি। চার-পাঁচটি কাব্যের রচয়িতা। ভিন্নমাত্রার কবি। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অধ্যাপক (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে) বলতেন, "মানব দলছুট কবি। আমাদের থেকে আলাদা। যথার্থ কবি।"

জন্ম ২৫ এপ্রিল ১৯৩৮, সিলেটে। 'মরার আগে জন্মভিটে দেখব', পূরণ হয়নি। চলে গেলেন ৩ অগাস্ট ২০২০ সালে। করোনা ভাইরাসে। অনেকেরই অজানা, পাগলা ছিলেন ক্রিকেটে। ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে ঢাউস বই লিখেছেন। ওঁর অনুজ সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্রিকেটার। একদা ক্যাপ্টেন, পশ্চিমবঙ্গ ক্রিকেটে।

মানবেন্দ্রর বহু বই (কবিতা-অনুবাদ) ঢাকাতেও প্রকাশিত। বহুল পঠিত। অধ্যাপক হলেও বলতুম 'মানব দা'। ক্লাসের বাইরে। প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তাই। যোগাযোগ ছিল সর্বদাই, ফোনে। মৃত্যুর এক মাস আগেও ফোনে বললেন, "করোনায় সাবধানে থেকো।" তিনি থাকেননি।

Advertisment