Advertisment

বদলে যাওয়া সময়ে মিডিয়া, আজকের সমাজের আয়না

সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন গৌরী লঙ্কেশের মতো বহু আদর্শবাদী সাংবাদিক। রাষ্ট্র তাঁদের আশ্রয় দেয়নি। সমাজেও বলিদানের মূল্য পাননি তাঁরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
media in changing times

প্রতীকী ছবি

মিডিয়া! রিপোর্টার! জার্নালিজম! গ্ল্যামার! পাড়ার লোকজন, আত্মীয়স্বজন, চেনা মহলের সর্বত্র বাড়তি গুরুত্ব। সবাই কেমন একটা পরিচয় পেলেই 'সবজান্তা' সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। মোদ্দা কথা, কলার তুলে চলার মতো একটা পেশাই বটে। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

Advertisment

মিডিয়ার যত রং, তার পরতে পরতে তত রহস্য। সে যে কত গভীর, তা শুধু যাঁরা এই বৃত্তে পা রেখেছেন, তাঁরাই জানেন। আবার অনেকে হয়তো থেকেও জেনে উঠতে পারেন না। আজ এই প্রতিবেদন লিখতে বসে, নিজেকেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, সত্যি কতটা চিনেছি এই জগৎটাকে? মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম আসলে মহাভারতের সেই কুরুক্ষেত্র, যেখানে প্রতিটি পার্শ্ব চরিত্রও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই চরিত্ররাও কম রঙিন নয়। আর প্রেক্ষাপট? সেও তো বিচিত্র এক ক্যানভাস! সমাজ, রাজনীতি, বিনোদন, কী নেই সেখানে?

মনে পড়ছে একটি ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। শুরুতেই যখন বলি, এটা তথাকথিত কোনও 'মহৎ পেশা' নয়। আদ্যন্ত কর্পোরেট, অর্থাৎ বাণিজ্যিক। কাজ করার জন্য প্রতিভা, শিক্ষা, যোগ্যতা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু শুধুমাত্র যোগ্যতা বা ন্যায়-নীতি-বিচার দিয়ে এখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি বিচারের কোনও স্থান নেই এখানে। সবটাই আপেক্ষিক। বলা বাহুল্য, ছেলেমেয়েরা রীতিমতো হতাশ হয়। অপ্রিয় এই কাজটি না করে আমারও কোনও উপায় ছিল না। কেন না, তাদের এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই সাংবাদিকতা পেশায় পা রাখতে হবে। নয়তো প্রতি মুহূর্তে আঘাত পাবে। বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হবে। যেটা আমাদের প্রজন্মের অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে।

আরও পড়ুন: গুরু দত্ত, দিব্যা ভারতী, সুশান্ত সিং রাজপুত…ভুলে যায় সময়

এত কিছু বলার পরও তাদের একথা বলতে পারিনি, কলম এখানে তলোয়ারের চেয়ে ধারালো নয়। বরং ক্ষমতাশালী তলোয়ারবাজরা স্বার্থে ঘা লাগলেই কলম দুরমুশ করে দেয় নির্মম ভাবে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও ক্যামেরা যা দেখে আর যা দেখায়, তার মাঝখানে অনেকগুলি স্তর থাকে। সমঝোতা করতে হয় প্রতি মুহূর্তে। সত্যি জেনেও অনেক সময়েই তাকে প্রকাশ করা যায় না। এছাড়াও টিকে থাকার জন্য জানতে হয় যোগবিয়োগের অঙ্ক, ভাবাবেগ বর্জনের অভ্যাস, এবং যথাসময়ে যথা দেবতার পায়ে ফুল-বেলপাতা দেওয়ার চাতুর্য।

আসলে মিডিয়া তো সমাজেরই আয়না। আজকের সমাজ যে পথে ধাবিত, মিডিয়া তার উল্টো পথে চলবে, সে তো সম্ভব নয়। যুগের পরিবর্তন একেবারে হুড়মুড়িয়ে বদলে দিয়েছে মিডিয়ার চালচিত্র। আমাদের চোখের সামনেই দেখলাম প্রিন্ট থেকে টেলিভিশন, সেখান থেকে ওয়েব মাধ্যম। প্রযুক্তির কল্যাণে অর্থাৎ ইন্টারনেট আসায়, দুনিয়াও এসে গেল হাতের মুঠোয়। মুক্ত অর্থনীতি, পণ্য সংস্কৃতি এবং দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি মিডিয়াকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করবে, সেটাও তো স্বাভাবিক। করলও। সেই প্রভাবের তালে তালেই সখ্যতা গড়ে উঠলো অন্ধকার দুনিয়ার সঙ্গেও। মোদ্দা কথা, একদা যে আদর্শের ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যম জন্ম নিয়েছিল মানব সমাজে, তার বোলচাল এখন কতিপয় এমন মানুষের হাতে, যাদের সঙ্গে আর যাই হোক, আদর্শের কোনও সম্পর্ক নেই।

তবে, এসবের বাইরেও কিছু কথা আছে । সীমিত পরিধিতে, নানা ধরণের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেও কিছুটা দায়বদ্ধতা নিশ্চয়ই পালন করা যায়। কেউ কেউ করছেনও। আজকের প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও করছেন। অন্যদিকে, এ এমন এক পেশা যেখানে উত্তরণের কোনও শেষ নেই। পর্যাপ্ত লেখাপড়া না করে এই পেশায় এলে হালে পানি পাওয়া শক্ত। আর এই লেখাপড়া বা তথ্যসমৃদ্ধি, যেটাই বলি, সেও এক চলমান প্রক্রিয়া। সিলেবাস মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশ করার মন নিয়ে আর যাই হোক, সাংবাদিকতা হয় না। এখানে রোজ পরীক্ষা, রোজ উৎরে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জটাই মিডিয়ার ম্যাজিক। এই ম্যাজিকে ফিদা হয়েই তরুণ প্রজন্ম ঝাঁপ দেয় এমন এক গভীর সমুদ্রে, যেখানে জল মাপতে মাপতে কখন যে মাথায় রুপোলি রেখারা খেলা করতে শুরু করে, টের পাওয়া যায় না।

পেশাদারিত্বের প্রশ্নে একটা কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। আর্থসামাজিক কারণেই একদিন মিডিয়াকে কর্পোরেট বাণিজ্যের খাতায় নাম লেখাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর মারাত্মক ভাবে পড়ে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে খোলনলচে বদলাতে হয় সংবাদমাধ্যমকেও। যত দিন যায়, একদিকে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা, ব্যবসায়িক শ্রীবৃদ্ধি ও বহু মানুষের যুক্ত হওয়া। তারই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত অগণিত সাংবাদিক, অসাংবাদিক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের ভরণপোষণ। শুধু তাই নয়। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত অজস্র অনুসারী শিল্প, তাদের মালিক ও কর্মচারী, সকলেই তো জড়িয়ে থাকেন জীবিকার প্রয়োজনে।

আরও পড়ুন: একবছর স্কুলে না গেলে ক্ষতি কী? লাভই বা কী?

বিপণন সংস্কৃতি যেমন সমাজের সর্বত্র, মিডিয়াও তার বাইরে নয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ব্যাকরণ তাকেও শিখতে হয়েছে। চলতে হচ্ছে সমঝোতা ও সামঞ্জস্য রাখার পথে। অভিযোগের তির তাক করাই আছে মিডিয়ার দিকে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই, আর সব পেশার মতোই এখানেও রয়েছেন অগণিত সাধারণ মানুষ। প্রতিষ্ঠান থাকলে, তবেই তাঁরাও মাস গেলে বেতনের প্যাকেটটা নিয়ে বাড়ি যাবেন। এখানে প্রতিষ্ঠান কী করে টিকে থাকবে, সেই বিজ্ঞানটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। কর্তৃপক্ষের সব সিদ্ধান্ত সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিনা, তা নিয়ে বিতর্কও চলতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কতটা জরুরি, তা এ দেশের একদা প্রথম সারির দৈনিক 'যুগান্তর'-এর তালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইতিহাসই বলে দেয়।

দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে আর কিছু না হোক, এটা শিখেছি, কেমন করে প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূলে বইয়ে দিতে হয়। মানে উচ্চাশা নয়, নিছক টিকে থাকার জন্য যতটুকু অনুকূল বাতাস লাগে। সেও এক কঠিন লড়াই, যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন। পাশে বসা মানুষটি যে কখন অচেনা শিকারীতে পরিণত হবে, কেউ জানে না। কখন যে অন্যের লাভক্ষতির চক্করে আপনি খরচের খাতায় চলে যাবেন, কেউ জানে না। হয়তো নিরন্তর নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই এই রাজনীতির জন্ম। নেপোটিজম বা লবিবাজির সূত্রপাতও এখান থেকেই।

তবে, এসবই অন্দরকথা। মিডিয়ার অন্দর চেনা আর বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মিডিয়ার লেনদেন বোঝা, দুটো মিলে এক বৃহৎ জ্ঞানভান্ডারের খেলা। এখানে ন্যূনতম স্খলনের জন্য মারাত্মক মাশুল গুনতে হতে পারে। গুনছেনও। প্রতিষ্ঠিত তারকা সাংবাদিকদের নানা স্ক্যামে জড়িয়ে পড়ার খবর আজ সকলেরই জানা। তাঁরা কিন্তু যথেষ্ট গুণী মানুষ সবদিক বিচারেই। কিন্তু,ওই সামান্য হিসেবের ভুল! আসলে সব পেশাতেই বোধহয় হাজারো গোঁজামিলের পর দিনের শেষে সেই আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই হয়। দেখতে হয় নিজেকে।

পৃথিবীর গভীর অসুখ আজ। নাহ, কোভিড-১৯ এর কারণ নয়। এই ভাইরাস অসুখের একটা রূপ মাত্র। পৃথিবীকে এই অসুখ মানুষেরই দেওয়া। সমাজের পাপ মাতা ধরিত্রী বহন করছেন। সংবাদমাধ্যমও এর অঙ্গ। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। একদিকে রাষ্ট্র বা প্রভাবশালী কিছু গোষ্ঠী সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক অপরাধের আখড়া হয়ে উঠছে বহু সংবাদমাধ্যম। তারা এক্ষেত্রে কোথাও লোভী, কোথাও অসহায়। আদতে যেদিন থেকে স্বার্থান্বেষী, প্রভাবশালী শ্রেণী সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে শুরু করেছে, সেদিনই ভেঙে পড়েছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ! ক্ষুদ্র স্বার্থ, স্বজনপোষণ, অনৈতিক আদানপ্রদান সংবাদমাধ্যমের গৌরব ক্ষুন্ন করেছে প্রবল ভাবে।

আজ রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি থেকে আইন-প্রশাসন, সর্বত্র ডামাডোল। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাই বা এর বাইরে গিয়ে কী করে ইতিবাচক হবে? সাংবিধানিক প্রধানরা যদি সুকৌশলে সংবিধানকে আত্মস্বার্থে প্রয়োগ করে, তবে সংবাদমাধ্যম তো তারই প্রতিলিপি বহন করবে ! সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন গৌরী লঙ্কেশের মতো বহু আদর্শবাদী সাংবাদিক। রাষ্ট্র তাঁদের আশ্রয় দেয়নি। সমাজেও বলিদানের মূল্য পাননি তাঁরা। সমাজ প্রগতিশীল ভাবনার পরিপন্থী হয়েছে।

নব্য প্রজন্মের সাংবাদিকরা তাই হিসেবি ও সাবধানী। তারা টিকে থাকার নতুন মন্ত্র শিখে নিয়েছে। তারাই বা কী করবে? একে তো অন্দরের রাজনীতি, অন্যদিকে মালিকের হাতের খাঁড়া নেমে আসতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। সব মিলিয়ে, এই অসুস্থ সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতাও আজ টিকে আছে জোড়াতালির ফর্মুলায়। এই ফর্মুলায় আর যাই হোক, বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার নতুন কোনও পরিভাষা লেখার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না।

সবশেষে পাঠক বা দর্শকের কথা। সংবাদমাধ্যমের বিবর্তনে তাঁদের ভূমিকাটা কিছু কম নয়। তাঁদের হাতেই রিমোট। তাই তাঁরা যদি অনবরত সংবাদমাধ্যমের দিকেই আঙ্গুলটা তোলেন, একটা আঙ্গুল তাঁদের দিকেও থাকবে। তাঁরা সমাজকে ধারণ করেন। পয়সা দিয়ে খবরের কাগজ কেনেন বা টেলিভিশন দেখেন। কথায় আছে, ক্রেতা হলো লক্ষ্মী। তো সেই বিশাল সংখ্যক লক্ষ্মীকে শীর্ষে বসিয়েই মিডিয়ার পলিসি অনেকটা ঠিক করা হয় এখন। করতেই হয়। তাঁরা চেয়েছেন বলেই পেজ থ্রি'র ছবি প্রথম পাতায় আসে। তাঁদের ইচ্ছেতেই রং-ঢং, চলন-বলন বদলেছে সংবাদমাধ্যমের। তাঁরা মুখ ফেরালে ব্যবসা লাটে।

অতএব প্রিয় গ্রাহক, 'মিডিয়া এখন খুব সস্তা হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ খবরকে পাত্তা না দিয়ে রঙচঙে বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে', এ জাতীয় অভিযোগের আসলে কোনও মানে নেই। আপনারা যেটা দেখতে চান, পড়তে চান, মিডিয়া সেটাই আপনার সামনে হাজির করে। আগে এসব সার্ভে করে বের করতে হতো মিডিয়ার পক্ষ থেকে। ওয়েব মিডিয়া চলে আসার পর তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে এই সার্ভেটা হয়ে যায়।

অর্থাৎ দায়িত্ব আপনাদেরও। ভবিষ্যতে সংবাদমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে, সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ না গুরুত্বহীন হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে আপনাদের শিক্ষা, বোধ, চেতনা, মনন ও সামাজিক সচেতনতার ভিত্তিতে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment