Advertisment

ঋতু, নারী ও আমরা

রাজনৈতিক বামপন্থীরাও পুলিশের জামায় আলতার দাগ দেখলে ঋতুস্রাব নিয়ে দু'চারটি বিদ্রূপ ছুঁড়ে দেন প্রতিবাদ স্বরূপ। মাসিকের রক্ত লেগে কাপড় বিষাক্ত হয় না, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ক্লেদ মেখে আমাদের মন অসুস্থ হয়ে পড়ে নিঃসন্দেহে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Menstruation

ফাইল ছবি

ঋতুস্রাব আদতে একটি সুস্থ শারীরবৃত্তীয় ঘটনা, যা প্রজননক্ষম নারীর শরীরে মোটামুটি প্রতি মাসে চার-পাঁচদিন ঘটে থাকে। এ বড়ই চিকিৎসকসুলভ রসকষহীন বক্তব্য হল। ঋতুস্রাব তো আসলে এর চেয়ে অনেক বড় একটা বিষয়। ঋতুস্রাব ঋতুমতী নারীর একটা সমস্যা… শারীরিক এবং মানসিক। ঋতুমতী নারীটিকে বাদ দিলে বাকি সকলের চোখে (এমনকি অন্য নারীর চোখেও) বেশ একটা ঘেন্নার ব্যাপার। ঋতুস্রাব প্রাচীন মানুষের বিস্ময়, তন্ত্রমন্ত্রের রহস্য, ফার্টিলিটি কাল্টগুলির জন্য পূজ্য অথচ ভয়ের এক বিদঘুটে সমস্যা। ঋতুস্রাব একটি সামাজিক ট্যাবু। ঋতুস্রাব পুরুষালি ঠাট্টার অনুপম খোরাক। ঋতুস্রাব নারীর শিক্ষা ও বিকাশের পথে অন্যতম বাধা। ঋতুস্রাব একটি ঘোর রাজনৈতিক বিষয়। ঋতু নারীর শরীরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক করে তোলে। যে মহিলার রক্তপাত হচ্ছে, তিনি ছাড়া আর সকলে ঠিক করে দেন ঋতুমতী মহিলাটি সেই কদিন নিজের শরীর আর সময় নিয়ে কী করবেন।

Advertisment

পরবর্তী এতগুলো (অর্থহীন অথচ গুরুত্বপূর্ণ) কথা আছে বলেই বারবার প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যটিতে ফিরে যাবার প্রয়োজন অনুভূত হয়। ওই একটিমাত্র প্রাকৃতিক সত্য, বাকি সব সামাজিক নির্মাণ। অল্প বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর নির্ভর করে যখন আমরা নিজেদের মতো করে কোনোকিছুকে বুঝে ফেলার চেষ্টা করি, তখন প্রায়শ ভুল বুঝি। যদি কিছু ক্ষমতাবান মানুষের স্বার্থ সেই ভুল বোঝার দ্বারা সুরক্ষিত হয়, তবে সেই ভুলটিকে সযত্নে রক্ষা করা হয় সামাজিকভাবে। ঋতুস্রাব এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ঋতুর বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক নিয়ে বহু সহস্র পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা বর্তমান লেখকের নেই। এখানে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর অবস্থান থেকে ঋতু সংক্রান্ত কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং এই বিষয়টিকে ঘিরে বহুল প্রচলিত মিথগুলির কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা হবে।

প্রতি মাসে সাধারণত একজন নারীর শরীরে  কোনো একটি ডিম্বাশয় থেকে একটি করে ডিম্বাণু নির্গত হয়। ডিম্বাণুগুলি জন্ম থেকে অর্ধ-প্রস্তুত অবস্থায় ডিম্বাশয়গুলির মধ্যে সঞ্চিত থাকে। প্রতি মাসে কয়েকটি ডিম্বাণু ও তাদের ধারক 'ফলিকল' বড় হতে, তথা প্রস্তুত হতে শুরু করে। এদের মধ্যে মাত্র একটিই সাধারণত পূর্ণতা পেয়ে নির্গত হয়, যাকে'ওভিউলেশন' বলা হয়। যদি ওভিউলেশনের পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে শুক্রাণুর দ্বারা ডিম্বাণুটি নিষিক্ত হয়, তাহলে ভ্রূণের প্রথম কোষ বা 'জাইগোট' তৈরি হয়। গর্ভাশয় বা ইউটেরাসের দেওয়ালে যাতে ভ্রূণটি আশ্র‍্যয় নিতে পারে, তার জন্য ডিম্বাণুর প্রস্তুতির পাশাপাশি গর্ভাশয়েরও প্রস্তুতি চলতে থাকে ঋতুচক্রের প্রথম দুই সপ্তাহ ধরে। গর্ভাশয়ের দেওয়ালের আবরক ঝিল্লি (এন্ডোমেট্রিয়াম) এই সময়ের মধ্যে অনেকটা মোটা এবং রক্তবাহী নালিকায় ভরপুর হয়ে ওঠে। উভয়ের এই প্রস্তুতির পদ্ধতি অতি জটিল। মস্তিষ্কস্থিত হাইপোথ্যালামাস নিঃসৃত গোনাডোট্রোপিন রিলিজিং হরমোন, পিটুইটারির ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন এবং ল্যুটিনাইজিং হরমোন, ডিম্বাশয় থেকে নির্গত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন এক অতি নিখুঁত নৃত্যপর ছন্দে পরস্পরের সঙ্গে তাল রেখে ওঠানামা করে ব্যাপারটিকে বাস্তব করে তোলে। কবে কোন হরমোন কতটা বেরোবে, তার গাণিতিক হিসেব আছে, যা মনোগ্রাহী হলেও আমাদের আলোচ্য নয়।

যদি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় এবং গর্ভধারণ হয়, তাহলে ভ্রূণ থেকে হিউম্যান কোরিয়নিক গোনাডোট্রপিন (এইচসিজি) নামক হরমোন ক্ষরিত হয়, যাত প্রভাবে মায়ের হরমোনগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যাতে গর্ভাশয়ের এন্ডোমেট্রিয়াম আরও পুষ্ট হয়ে ওঠে, 'প্লাসেন্টা' তৈরি হতে পারে এবং গর্ভ সুষ্ঠুভাবে বজায় থাকে। ভ্রূণ সৃষ্টি না হলে হরমোনের পরিবর্তন হয় বিপরীত অভিমুখে এবং তার ফলে কিছুদিন বাদে রক্তপ্রবাহের সঙ্গে গর্ভাশয়ের পরিপুষ্ট এন্ডোমেট্রিয়ামের বেশিরভাগ অংশ খসে পড়ে, অনেকটা শীতকালে পর্ণমোচী বৃক্ষের পাতা খসার মতো। তারপরেই শুরু হয়ে যায় পরের মাসের প্রস্তুতি। সাধারণত কমবেশি ২৮ দিনে একটি চক্র সমাপ্ত হয়, কিন্তু একুশ থেকে পঁয়ত্রিশ দিন (ক্ষেত্রবিশেষে চল্লিশ দিন) পর্যন্ত সময়ের ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। এর মধ্যে ওভিউলেশনের পরের চোদ্দ দিন মোটামুটি সকলের ক্ষেত্রেই এক, চক্রের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য তৈরি হয় পূর্ববর্তী ঋতুস্রাব থেকে ওভিউলেশন পর্যন্ত সময়টি আলাদা আলাদা হবার ফলে।

এবার কিছু জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যাক। প্রথম প্রশ্ন, ঋতুস্রাবের রক্ত কি খুবই নোংরা? তা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কি খুবই প্রবল? ঋতুমতী মেয়েদের অপরিচ্ছন্ন, অপবিত্র ভাবার বা ভাতের হাঁড়ি ছুঁতে না দেবার কি কোনো কারণ আছে? পবিত্রতা সম্বন্ধে কোনো বৈজ্ঞানিক বক্তব্য নেই, কিন্তু পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে স্পষ্ট কথা বলা যায়। যদি কোনো মেয়ের জরায়ুতে বা যৌনাঙ্গে গুরুতর জীবাণুঘটিত রোগ না থাকে, তবে ঋতুস্রাবের রক্ত এবং তার সঙ্গে মিশ্রিত গর্ভাশয়ের এন্ডোমেট্রিয়ামের টুকরোগুলো সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন। তা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রতিদিন আমরা সকলে যে মলমূত্রাদি ত্যাগ করি, তার তুলনায় ঋতুস্রাবকে প্রায় হৃষিকেশের গঙ্গাজলের মতো শুদ্ধ বলা চলে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, এরকম নোংরা প্রবাহের জন্য অত দামী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করার প্রয়োজন কী? ছেঁড়া নোংরা ন্যাকড়াই কি এর উপযুক্ত নয়? উত্তর শুরু হবে আগের উত্তরটি থেকে। প্রবাহটি নোংরা নয়। নোংরা ন্যাকড়া থেকে মেয়েদের বিক্ষত গর্ভাশয়ে তথা মূত্রনালীতে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। তাই পরিচ্ছন্ন স্যানিটারি ন্যাপকিনই ব্যবহার করা উচিত। আর্থিক কারণে কাপড় ব্যবহার করতে চাইলে পরিষ্কার কাপড় ভালো করে কেচে শুকিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এক মাসে একজন মেয়ের যতটা ন্যাপকিন লাগে, তার দাম এক প্যাকেট সিগারেটের চেয়ে কম। ন্যাপকিন স্বাস্থ্যকর, সিগারেট স্বাস্থ্য ধ্বংসকারী।

কাপড়ে ঋতুর রক্তের দাগ লেগে যাওয়া কি খুবই লজ্জার ব্যাপার? ন্যাপকিন না লাগানো অব্দি ধরে রাখে না কেন মেয়েরা? উত্তর হল এই যে মলমূত্রাদি আটকে রাখা যায়, তাই আমরা বাথরুমে যাবার সুযোগ পাই। ঋতুস্রাব আটকে রাখা যায় না। যখন রক্তপ্রবাহ শুরু হবে, তখন তা বেরোবেই। যাঁদের ঋতুচক্র একেবারে নির্দিষ্ট হিসেব মেনে চলে, সেইসব মহিলারা দিন আন্দাজ করে আগাম ন্যাপকিন ব্যবহার শুরু করতে পারেন, কিন্তু যাঁদের চক্রগুলি সামান্যও অনিয়মিত, তাঁদের পক্ষে কাপড়ে রক্ত লাগা এড়ানো খুবই কঠিন। এর সঙ্গে যুক্ত নিদারুণ মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য মেয়েদের ঋতুর দিন আন্দাজ করার প্রশিক্ষণ দেবার চেয়ে অনেক বেশি কাজের হল সমাজের চোখের চিকিৎসা করা। কারো মাথায় ব্যাণ্ডেজ় বাঁধা আর তাতে রক্ত লেগে আছে দেখলে আমরা তো ছিছি করি না। ঋতুস্রাবও একরকম রক্তপাতের ঘটনা। বরং মাথা ফাটার জন্য আহত ব্যক্তি নিজে দায়ী হতে পারেন, ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক সুস্থ ব্যাপার।

ঋতুকালীন রক্তপাতকে অনিষিক্ত ডিম্বাণুটির জন্য গর্ভাশয়ের ক্রন্দন বলেছেন অনেকে। এ কথা কতটা যুক্তিযুক্ত? আসলে এরকম বক্তব্যের পিছনের যুক্তি হল প্রজননকে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যা প্রাচীন সমাজে অর্থনৈতিক কারণে মানুষের ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। এর ফলে নারীর শরীরকে শুধুমাত্র একটি সন্তান ধারণের যন্ত্র ভাবার অভ্যেস রপ্ত করেছি আমরা। আমাদের কাব্যিক অতিশয়োক্তিগুলোতেও তারই প্রভাব। প্রতিটি অনিষিক্ত ডিম্বাণুকে তাই অজাত সন্তান বলে মনে হয়। বাস্তবে একজন নারীর ডিম্বাশয় দুটিতে যতগুলো ডিম্বাণু থাকে, সেই পরিমাণ সন্তান ধারণ এক জীবনে সম্ভব নয়। একজন মহিলা যদি প্রতিটি সন্তানের জন্মের পরেই ক্রমাগত গর্ভবতী হতে থাকেন এবং সফলভাবে একের পর এক সন্তানের জন্ম দিতে থাকেন এবং রক্তাল্পতায় মরে না যান, তাহলেও সমগ্র প্রজননক্ষম বয়সে তিনি বড়জোর কুড়ি-পঁচিশবার গর্ভবতী হতে পারবেন। বাকি ডিম্বাণু নষ্টই হবে। এবার এই নষ্ট সন্তানের যুক্তিটি পুরুষের ওপর প্রয়োগ করলে দেখা যাবে প্রতিবার সঙ্গম বা স্বমেহনে কোটি কোটি শুক্রাণু নষ্ট হয়। প্রত্যেক শুক্রাণুকে সম্ভাব্য সন্তান ভাবলে রেতঃপাতকে শুক্রাশয়ের আর্তনাদ বলা উচিত।

ঋতুকালীন ছুটির জন্য কিছু মহিলা দাবি জানান কেন? রক্তপাত জনিত ক্লান্তি ও অস্বস্তি ছাড়াও অনেক মহিলার এই সময়ে মারাত্মক পেটে ব্যথা হয়, যাকে ডিসমেনরিয়া বলে। কর্মস্থলে এবং যাতায়াতের রাস্তায় পরিচ্ছন্ন টয়লেটও অপ্রতুল। প্রতি মাসে চারদিন ছুটি নেবার ভালো-মন্দ দিক নিয়ে নারী আন্দোলনের নেত্রীরাও দ্বিধাবিভক্ত, তাই সেই বিষয়ে আমার কোনো রায় নেই, কিন্তু এটুকু বোঝা প্রয়োজন  যে ঋতু চলাকালে মহিলারা যথেষ্ট কষ্ট করে কাজ করেন।

প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমস) নিয়ে বহু চুটকি পুরুষালি আড্ডায় প্রচলিত। অপরপক্ষে একসময় নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা এর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে মরিয়া ছিলেন। ব্যাপারটা আসলে কী? পিএমএস একটি বাস্তব শারীরিক ও মানসিক অবস্থা। এটি ঠাট্টার যোগ্য নয় আবার অস্বীকার করার বিষয়ও নয়, কারণ ভুক্তভোগী মহিলাদের পক্ষে অবস্থাটি অতি ক্লেশদায়ক। হরমোন ও স্নায়ুসন্ধির নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা পরিবর্তনের ফলে প্রতি চক্রে ঋতুস্রাবের আগের এক বা দুই সপ্তাহ শরীর-মনে নানারকম কষ্ট হতে থাকে। মন খারাপ, কাজ করতে অসুবিধা, অনিদ্রা থেকে শুরু করে স্তনে ব্যথা, জ্বরজ্বর ভাব ইত্যাদি অনেককিছু হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অবসাদ অতি তীব্র হতে পারে। তখন তাকে 'প্রিমেন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজর্ডার' (পিএমডিডি) বলা হয়। অসুখটির চিকিৎসা সম্ভব এবং পরিণত বয়সে ঋতু বন্ধ হবার পর সেরে যায়।

মেয়েদের এই স্বাভাবিক শারীরিক ঘটনা এবং তার সঙ্গে জড়িত অসুখবিসুখ নিয়ে সুস্থ আলোচনা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যত আলোচনা হয় তার অধিকাংশই নারীবিদ্বেষী। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন জরুরি। বহিরঙ্গে পরিবর্তনপন্থী হলেও আমরা অনেকেই অন্তরে লালন করে চলি সংকীর্ণতাকে। শুধু যে গোঁড়া ধর্মবাদী দক্ষিণপন্থীরা ঋতুমতী মহিলাদের মন্দির আর হেঁসেলের বাইরে রাখেন, তা নয়, রাজনৈতিক বামপন্থীরাও পুলিশের জামায় আলতার দাগ দেখলে ঋতুস্রাব নিয়ে দু'চারটি বিদ্রূপ ছুঁড়ে দেন প্রতিবাদ স্বরূপ। মাসিকের রক্ত লেগে কাপড় বিষাক্ত হয় না, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ক্লেদ মেখে আমাদের মন অসুস্থ হয়ে পড়ে নিঃসন্দেহে। সেই মন বৈজ্ঞানিক সত্যকেও দেখতে পায় না। এর চিকিৎসা প্রয়োজন।

                              

Jon O Swasthyo
Advertisment