ইয়েস, #মি টু।
হারভে উইনস্টাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর দলে দলে মেয়েরা তাদের যৌন হেনস্থার কথা সামনে আনছে। এই তথাকথিত উইনস্টাইন এফেক্ট ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়। অভিনয়, ক্রীড়া, সাহিত্য, রাজনীতিজগতের অনেক পুরুষের নামেই অভিযোগ জানাচ্ছে নারীরা। অনেকক্ষেত্রেই ঘটনাগুলি পুরনো। অনেকদিন চেপে রেখে মেয়েরা আজ হঠাৎ মুখ খোলবার সাহস পেয়েছে। কারণ এই মুখ খোলাটা সহজ নয়।
আমি লেখালিখি করে থাকি। কিন্তু অধুনা আমার আরেকটি পরিচয় আমি সমাজকর্মী। এই কাজ করতে গিয়েও আমি যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি। পুরুষের চোরাগোপ্তা স্ট্র্যাটেজিক হাতে আমার সম্ভ্রম আহত হয়েছে। সে কথা বলতেও পারিনি, আমার কাজের পরিধি ছোট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। হ্যাঁ, তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ মানুষ, আমার প্রিয় মানুষও বটে। তিনি এক বিখ্যাত আইনজীবী। তাঁর অবাঞ্ছিত স্পর্শ একাধিকবার আমাকে আহত করেছে। কিন্তু সে কথা বললে আমার মানুষের জন্য কাজ করা ব্যাহত হবে। তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাধর। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুললে আমার মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারার সুযোগই বন্ধ হয়ে যাবে।
দু হাজার এগারো নাগাদ তাঁর অফিস থেকে তিনি আমায় একটি ক্লাবে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমাকে মাদক পানীয় খাইয়েছিলেন। আমার নেশা হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাঁর গাড়ির ভিতরেই তিনি আমাকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেন এটুকুই আমার মনে আছে। ঠিক কী হয়েছিল আমার মনে নেই তবে বাড়ি ফিরেছিলাম একটা তীব্র বিরক্তি ও অপমানবোধ নিয়ে। কদিন আগেও তিনি হঠাৎ খেয়াল না থাকার ভাব করে আমার স্তন স্পর্শ করেছিলেন। তখনও আমি কিছু বলিনি। কেননা, আগেই বলেছি তিনি ক্ষমতাধর। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে তিনি আমাকে কাজ করতে দেবেন না। এই কাজ আমার পয়সা রোজগারের কাজ নয়, তাহলে হয়তো তাঁর নাম জানিয়ে চাকরিটা ছেড়েই দিতাম। কিন্তু আমি মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর কাজ করি। তাঁর একটি মানবাধিকার সংগঠন আছে। তারা আমাকে কাজের সুযোগ দেয়। সেই সংগঠনের সাহায্য আমার নিজের নয়, নিপীড়িত মানুষের প্রয়োজনেই জরুরি।
এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে অন্য অনেক মহিলারও ক্ষোভ আছে। তারাও তাঁর হাতে যৌন হেনস্থার শিকার। আমরা সেই নিয়ে আলোচনাও করেছি। আমার এক বান্ধবী বাড়িতে কোনও কারণে একা ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায়। এই ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আগ্রহ তো নয়, সিদ্ধান্ত। আমার বান্ধবী ব্যাপার বুঝে পাড়ার কয়েকজনকে বাড়িতে ডেকে নেন। ভদ্রলোক পরে ফোনে তাঁকে জানান, অন্যর উপস্থিতি তাঁকে হতাশ করেছে, তিনি ভেবেছিলেন, একাকী বান্ধবীকে তিনি ‘আদর’ করবেন।
আমার একটা অপরাধবোধ আছে। এই ক্ষমতাবান পুরুষটির ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে আমি সরাসরি কথা বলিনি, কিন্তু আরেকটি জায়গায় প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনিও খেয়াল না করার ভান করে আমাকে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করেছিলেন। একটি গাড়িতে করে একটি গ্রাম থেকে আমরা ফিরছিলাম। সেখানে আমাদের নেতা ছিলেন এক ভদ্রমহিলা। এই লোকটি আমাকে স্পর্শ করার পর আমি খানিকক্ষণ সময় নিয়েছিলাম আড়ষ্টতা ভাঙার জন্য। তারপর সরাসরি তাঁর নাম ধরে ডেকে বলেছিলাম, ... এই য়ে তুমি আমাকে টাচ করলে এটা অনিচ্ছাকৃত না ইচ্ছাকৃত?তখন আদালত রায় দিয়ে দিয়েছে কোনও মহিলাকে অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ যৌন হেনস্থা নয়। গাড়িতে সবাই চুপ। প্রায় পিনপতন নিস্তব্ধতা। আমি আবার বললাম- যদি অনিচ্ছাকৃত হয়, ঠিক আছে। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলে ভালো হবে না। আমাদের নেত্রী বলে উঠলেন, ---আরে নানা, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলার অভ্যেস আছে। আমি বললাম--- দিদি, উনি যে আমার মাথায় হাত দেননি তা আপনি ভালোই বুঝেছেন। এরপর সারাটা পথ গাড়িতে আর কেউ কথা বলেনি। আমিই চুপ ছিলাম। কিন্তু চুপ করার দিন আর নেই। উই মাস্ট রেজ আওয়ার ভয়েস।
দলবদ্ধ হলে জোর বাড়ে। একজন দুজন করে মুখ খুলতে খুলতে আজ এই সকল যৌন হেনস্থার কথা নারীরা একসঙ্গে সোচ্চারে বলতে শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও ভাবে এই হেনস্থার শিকার। কিন্তু এঁরা বেশিরভাগই নামজাদা মহিলা, স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত। কিন্তু তারও বাইরে পড়ে রয়েছে সিংহভাগ নারী। এঁদের নাম কেউ জানে না। কিন্তু এঁদের পরিচয় তো একই। নারী। সে ভালনারেবল। আর পুরুষরাও সবাই নামজাদা নয়। বাসে ট্রামে যারা নারীদেহে চোরাগোপ্তা যৌন আক্রমণ চালায়, তারাও কেবলমাত্র পুরুষ। নির্যাতনকারী পুরুষ ও নির্যাতিতা নারী, এটাই মানবসমাজের চিরকালীন পরিচয়। তার বাইরে যাঁরা আছেন, সভ্য পুরুষ ও সুরক্ষিত নারী, শতাংশের নিরিখে তাঁরা সম্ভবত কমই।
আমি এই হেনস্থার শিকার ছোটবেলা থেকে। এ হয়ত নতুন কোনও গল্প নয়। আমার মাসতুতো দাদার হাতে আমার প্রথম শ্লীলতাহানি। মা-কেও বলতে পারিনি। পরে বড় হয়ে মা-কে যখন বলেছিলাম, মা ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমাকে তখনই বলিসনি কেন? আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, মা গো, তোমার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা তুমি দিদাকে বলতে পেরেছিলে? আসলে বলা যায় না। কী এক ভয় কাজ করে। লজ্জা, অস্বস্তি, আড়ষ্টতা। একটা পাপবোধও। যেন অন্যায়টা আমিই করেছি। অনেকক্ষেত্রে দোষী পুরুষটি শাস্তির, এমনকি মৃত্যুর ভয় দেখায়। আমার ইসকুল থেকে ফেরার পথ ছিল একটা ছোট গলি। লোক চলাচল কম। গায়ে এসে পড়ত পুরুষের লালসার থাবা। সাইকেল-আরোহীর পিছনে ছুটে কী করব! বাড়ি এসে মা-কে কাঁদতে কাঁদতে বলতাম। মা বলতেন, কাঁদিস না, ওরা আমার গায়েও হাত দেয়।
আমি, আমার মা, বিখ্যাত নারী নই, ওই পুরুষেরাও নয়। আমাদের কথা কে বলবে? প্রতিটি নারীর এই অভিজ্ঞতা আছে। হ্যাশট্যাগ মি টু ক-জনের কথা আর বলবে? বলতে পারে?
ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ে এক প্রাইভেট টিউটরের কাছে কেমিস্ট্রি পড়তে যেতাম। টিউটোরিয়াল বলতে একটা ছোট ভাড়ার ঘর। আমরা তিনজন ছেলেমেয়ে। একদিন কী হল, আমি গিয়ে দেখলাম আর দুজন আসেনি। একাই বইখাতা খুলে বসলাম। কিন্তু দেখলাম স্যারের পড়ানোর দিকে মন নেই। তিনি আমার সঙ্গে একটা সিনেমার গল্প করতে শুরু করলেন। একটা নির্জন দ্বীপে দুটি যুবক-যুবতী থাকে। জাহাজডুবির পর ওরা ওখানে ভেসে এসেছে। অনেকদিন আছে তো, তাই ওদের জামা কাপড় পুরনো হয়ে ছিঁড়ে গেছে। স্যার বলছেন, --- ওদের গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই, বুঝেছ তো? দুজনেই উলঙ্গ। বুঝলে?
আমি বুঝলাম, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। এই ঘর থেকে পালাতে হবে। মাথার দু পাশ চিপে ধরে বললাম --- আমার মাথা ব্যথা করছে। বাড়ি যাব। স্যার বললেন, দেখি কোথায় ব্যথা করছে বলো? আমি টিপে দিচ্ছি। আমি ঝটকা মেরে তাঁর উদ্যত হাত সরিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে ছুট। কাউকে কিছু বলিনি। বলতে পারিনি ওই স্যারের কাছে আর পড়তে যাব না। গেছি, উৎকণ্ঠায় কাঁটা হয়ে থেকেছি। তবে ভাগ্য ভালো, সেদিনের মতো একা আর ওঁর কাছে যেতে হয়নি। বন্ধুরা থাকত।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, প্রকৃতপক্ষে একটি পিতৃতান্ত্রিক অসুখ। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে, কাজে দক্ষতা দেখাচ্ছে, এটা পুরুষের গোপন ঈর্ষা। এই ঈর্ষা থেকেই তারা ভাবে, এবং প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, নারী শুধুমাত্র যৌন ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধারণার গোড়ায় আঘাত করা দরকার। এর জন্য কর্তৃপক্ষকে আগুনের হাত থেকে সুরক্ষার মতো, নারী কর্মচারীদের পুরুষের হাত থেকে সুরক্ষার দিকেও নজর রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সুস্থ আবহাওয়া সভ্যতার অগ্রগতির একটি অতীব আকাঙ্ক্ষিত শর্ত।
এই সকল বিকৃতকাম পুরুষ, জনসমক্ষে তাদের মুখোশ খুলে দেওয়াটা জরুরি। কিন্তু এদের শাস্তি কী হবে! বহু পুরনো ঘটনার কথা মেয়েরা আজ মুখ ফুটে বলছে। সব ক্ষেত্রে আইনি বিচার সম্ভব নয়। তবে মানুষ তাদের বিচার করবে। মানুষ বলতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সভ্য মানুষ। এই প্রতিবাদের ঝড় সমাজকে হয়তো বা একটু বদলাবে। নারীরা আরও একটু সাহসী, সচেতন ও সাবধানী হবে। কামার্ত ও ধূর্ত পুরুষের লোভী হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে। এই প্রতিবাদ পুরুষকেও সাবধান করবে। নারীরা সবসময়ে মুখ খুলতে পারে না বলে তারা যে সুযোগ নেয়, উইনস্টাইন এফেক্টের ফলস্বরূপ তারাও দুবার ভাববে। নারীকে প্রতিরোধে সক্ষম হতে হবে। শুধু শারীরিক শক্তির কথা বলছি না। বলছি মানসিক শক্তির কথা। যে মানসিক শক্তি যৌন হেনস্থায় উদ্যত পুরুষের অণ্ডকোষে হাঁটু দিয়ে আঘাত করতে শেখায়। চিৎকার করতে শেখায়। ঘটনার পর চুপ না করে থেকে মুখ খুলতে শেখায়।
মেয়েরা হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে। তবে এখানেও একটা মিথ্যের সম্ভাবনা থেকে যায়। কোনও মেয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কোনও পুরুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপদস্থ ও বিপদগ্রস্ত করে তুলতে পারে। এরকম ঘটনার উদাহরণ আছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে এক মহিলা ইন্টার্ন যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিল। পরে সে তার জবানবন্দি দিতেই অস্বীকার করে। সেই প্রাক্তন বিচারপতি বেকসুর মুক্তি পান। এখানেই ভয়। এই ব্যাপ্ত উইনস্টাইন এফেক্ট মহিলাদের হাতে পুরুষকে ‘ফাঁসানো’-র অস্ত্র তুলে দেবে না তো? এখানে নারীদের সৎ থাকতে হবে। তবেই প্রায় প্রতিটি নারীর জীবনে যৌন হেনস্থার কাহিনি সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিচারের দাবি জানাতে পারবে।
শেষ করব একটি কথা দিয়ে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনকে যেমন অনেকে, মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে, অশ্লীল মনে করেন, মেয়েদের যৌন হেনস্থার কথা শুনে তাঁরা ওই মেয়েটিকেই ছি ছি করেন। যেন তার সঙ্গে যা ঘটেছে সেটা নয়, মেয়েটি যে সে কথাটি সর্বসমক্ষে বলছে, এটাই লজ্জার। আমি লেখক। লেখালিখির জগতের কথাই বলি। তসলিমা নাসরিন যখন তাঁর লেখায় শ্লীলতাহানির কথা লেখেন, তিনিই ধিক্কৃত হন। যৌন হেনস্থা ভাষাতেও হতে পারে। যে নোংরা ভাষা তাঁকে শুনতে হয়েছিল, সে কথাটি লেখার জন্যই তাঁকে পাঠক ভর্ৎসনা করেছিল। যেন তাঁর সঙ্গে যা হয়েছে, তার চাইতে বড় অন্যায় সে কথার বিবরণ। বিশেষত পুরুষ পাঠকেদের কাছ থেকেই এই বিরূপ সমালোচনা শুনেছি। তর্ক করেছি। বোধহয় বোঝাতে পারিনি। তাঁদের বক্তব্য এতে সাহিত্য অবমানিত হয়েছে। আর নারীর অবমাননার খবর কে রাখবে?
হে মানুষ, হে পুরুষ, নারীর অবমাননার খবর রাখো, নারীর অবমাননার হিসেব রাখো। আজ না হোক কাল সে-হিসেব নারীরা কড়ায় ক্রান্তিতে মিটিয়ে দেবে। প্রক্রিয়া সবে শুরু হয়েছে।
(বিশিষ্ট কবি ও সমাজকর্মী মন্দাক্রান্তা সেনের এ লেখায় প্রকাশিত অভিজ্ঞতা ও মতামত একান্তভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত)