Advertisment

নেহরুবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন রণকৌশল মোদীর

মনে রাখতে হবে, চাইলেই আজও মোদী সব কিছু সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পারেন না। যেমন, তিনি রেলের আংশিক বেসরকারিকরণ করলেও এয়ার ইন্ডিয়ার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করতে পারছেন কোথায়?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

নরেন্দ্র মোদীর সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়ে গেছে | হওয়ার পর এবার বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আরও দৃঢ়ভাবে সরকার এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব দর্শন, কর্মপদ্ধতি এবং লক্ষ্য পূরণের চেষ্টায় অতি সক্রিয়। ১৯৪৭ সালের পর গোটা দেশ জুড়ে জওহরলাল নেহরুর জনপ্রিয়তা ছিল। কীভাবে নেহরু 'চাচা' নেহরু হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর জন্মদিন ১৮ নভেম্বর কীভাবে শিশু দিবস হয়ে গেল, এমনকি পণ্ডিত নেহরু কীভাবে কতখানি কাশ্মীরী পণ্ডিত, এসব নিয়ে বিতর্ক যাই হোক, তিনি জনমানসে পণ্ডিত নেহরু।

Advertisment

বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে নেহরু নিজে কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন আটবার - ১৯২৯, ১৯৩০, ১৯৩৬, ১৯৫১, ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৮৫ সালে। পরবর্তী ২১ বছরে কংগ্রেস দলে ২২ জন সভাপতি হন। গড়ে এক বছরে একজন। এমনকি গান্ধীজীও এক বছরের স্বল্পমেয়াদি টার্মের জন্য সভাপতি হন। প্রথম সভাপতি হন রাসবিহারী ঘোষ। ১৯০৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য সভাপতি হয়েছিলেন।

এত কথা কেন বললাম? বলতে চাইছি, আজ ২০১৯ সালে কংগ্রেসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, এক প্রবল পরিবারবাদের দাপট। কাজেই একদিকে নেহরু-গান্ধী পরিবারবাদ, আর অন্যদিকে নেহরুর পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবযুক্ত এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী মডেল। এটাই ছিল নেহরুবাদ।

অটল বিহারী বাজেপেয়ী বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি এককভাবে বিজেপি সরকারের মুখিয়া ছিলেন না। তিনি ছিলেন জোট সরকারের প্রধান। তাছাড়া বাজপেয়ীর রাজনৈতিক দর্শনও কিন্তু নেহরুর কাউন্টার ন্যারেটিভ। বাজপেয়ী নিজস্ব আলেখ্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন নি। বরং অনেকেই মনে করেন, বাজেপেয়ী নিজেও নেহরু-বিরোধী ছিলেন না। উল্টে বহু ক্ষেত্রে বাজপেয়ী সম্পর্কে ধারনা ছিল, তিনি যতটা আরএসএস, তার চেয়ে বেশি নেহরুবাদী।

মোদী কিন্তু তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে দিয়ে নেহরুবাদের অনুকরণ নয়, বরং হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র সংস্কৃতিকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন দেশে ও বিদেশে। ১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দিয়েছিল যে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হোক ভারত। কিন্তু নেহেরু নাকি বলেন, ভারতের বদলে এটি চিনেরই হওয়া উচিত। এই ঘটনাটি নিয়ে আজ বিতর্ক শুরু হয়েছে নতুন করে। তবে একথা সত্য, চিন-ভারত সম্পর্কের আজকের পরিস্থিতিটাই হয়ত তৈরি হতো না যদি সেদিন ভারত রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হত। মার্কিন প্রস্তাব ছিল কি ছিল না তা নিয়ে আজ কংগ্রেস-বিজেপি বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু একথা তো মানতেই হবে, রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীরে গন ভোটের প্রস্তাবও তো নেহরুই দিয়েছিলেন। নেহরুর ধর্ম নিরপেক্ষতা এতটাই, যে মুসলিমদের পার্সোনাল ল বহাল রাখেন, কিন্তু অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন করতে রাজি হন নি। শিখ ও বৌদ্ধদের জন্য হিন্দু কোড বিল প্রয়োগ হত।

১৯৪৭ থেকে '৬৪, এই দীর্ঘ সময়ে শ্রীনগর থেকে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের যে খেদানো হয়, পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু উদ্বাস্তু চলে আসেন, তাঁদের সকলের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেও নেহরু অতিসক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি বলে অভিযোগ।

১৯৬২ সালে চিন আক্রমণের পর নেহরু অবশ্য অসুস্থ হয়ে পড়েন, ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। আজ এত বছর পর 'ম্যাজিশিয়ান' প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া এবং ৩৫ বি-কেও প্রশাসনিক নির্দেশে প্রত্যাহার করানো মোদী সরকারের লক্ষ্য। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ রাজ্যে ভোটার তালিকার ডিলিমিটেশানের চেষ্টা এক নতুন উদ্যোগ।

মনে রাখতে হবে, চাইলেই আজও মোদী সব কিছু সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পারেন না। তিনি রেলের আংশিক বেসরকারিকরণ করলেও এয়ার ইন্ডিয়ার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ করতে পারছেন কোথায়? গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে অনেকটাই কমিয়ে দিতে সক্ষম হন, কিন্তু গোটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঠিক সেভাবে কঠোর সংস্কার নীতিতে যেতে কি তিনি সক্ষম হয়েছেন?

সংসদেও সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা আছে। লোকসভায় স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় কিন্তু মোদীর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যালঘু। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এত তাড়াতাড়ি হওয়া সম্ভব নয়। খুব ভাল ফল করলেও। নভেম্বর মাসে ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, এমনকি দিল্লি ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভোটে ভাল ফল করলেও আসন সংখ্যা যা আছে, তাতে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন রাজ্যসভায় সম্ভব নয়। অতএব অপেক্ষা করতেই হবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তাই ব্যাপক ভাল ফল করে ক্ষমতায় আসা বিজেপির লক্ষ্য। এই কাজে সফল হলে পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে বর্দ্ধিত বিধায়কদের সংখ্যার বিচারে রাজ্যসভায় দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সহজতর হতে পারে। তবে এই পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে অনেকগুলো 'যদি' আছে।

ধীরগতিতে এই অভিমুখে এগোনোর জন্য মোদী মন্ত্রিসভাকেও নিজের মতো করে গঠন করেছেন। একদিকে জয়শঙ্করের মত কূটনীতিককে বিদেশমন্ত্রী করে চিন, আমেরিকা ও পাকিস্তান সামলানো, আর অন্যদিকে তাঁর শিষ্য কট্টরবাদী বলে পরিচিত অমিত শাহকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা, এসবই মোদীর বিশেষ রণকৌশল।

এবার মোদী আমলাতন্ত্রের উপর নিজের নির্ভরশীলতাও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের ত্রিমূর্তি - প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নৃপেন মিশ্র, অতিরিক্ত প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিকে মিশ্র এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অমিত দোভালকে ক্যাবিনেট মর্যাদা দেওয়াও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

নির্মলা সীতারামনকে অর্থমন্ত্রী করে এবার বাজেট পেশ, সেও হবে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বাজেটেও কিছু চমক থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি মোদী ঘনিষ্ঠ অফিসার ও মন্ত্রীদের কাছে বলেছেন, এবার ভোটে যেমন সরকারি প্রকল্পের বাস্তব রূপায়ণে সাধারন মানুষদের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার পাশাপাশি জাত-পাত ভিত্তিক রাজনীতি অনেকটা খতম হলেও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। তাই গ্রামে টয়লেট বা মেয়েদের ইজ্জত ঘর, গ্যাসের কানেকশন, গৃহ নির্মাণ ও কৃষি ঋণের সুবিধা, এসব মানুষের উপর ভালো প্রভাব ফেলে।

আগামী পাঁচ বছরের মোদীর কৌশল, এই জনপরিষেবাকে আরও বেশি মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পরিবহন, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্যে আরও কাজ করা। মোদী কিন্তু ধীরে ধীরে ধনী ও দরিদ্র ভেদাভেদের প্রেক্ষিতে ভারতের আম গরীবের 'মসিহা' হয়ে উঠতে চাইছেন।

PM Narendra Modi jammu and kashmir narendra modi
Advertisment