Advertisment

১৫ অগাস্ট: বঙ্গবন্ধু হত্যাদিবসের স্মৃতি

হ্যাঁ, বিবিসির বুলেটিনে প্রচারিত হচ্ছে, "শেখ মুজিবুর রহমান কিলড্।" নিজের কানকেই বিশ্বাস হয় না। চোখে জল নামে। একজন পুলিশ জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি বাংলাদেশের? এই হোস্টেলেই থাকেন?'

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mujibur rahman assassination Bangladesh dhaka kolkata 15 august 1975

"বঙ্গবন্ধুর কথা, 'হতে পারে না, ইম্পসেবল্।' মানুষকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কখনও বিশ্বাস হারাননি। না হারিয়ে সবংশে নির্মূল।"

তখনও অন্ধকার। ভোর চারটেও বাজেনি। দরজায় করাঘাত। জোরে। ঘুমোতে গিয়েছি বারোটার পর। রুমমেট অলোক চট্টোপাধ্যায়ও। কড়া নাড়ায় দু'জনেই জেগে উঠলুম। দু'জনেরই মেজাজ তিরিক্ষে। অলোক খিস্তিও করলেন। দরজা খুলতেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হোস্টেলের দারোয়ান পাঁড়েজি হিন্দি-বাংলা যা বললেন, মর্মার্থ, "শেখ মুজিব কতল হো গিয়া।" অলোক চট্টোপাধ্যায় আরো কাঁচা খিস্তি ঝেড়ে, "সারারাত দিশি মদ গিলে নাটক করতে এসেছ? শেখ মুজিবকে কোতল করবে কে"? পাঁড়েজির উত্তর, "রেডিওতে বলেছে। থানার পুলিশরা বলাবলি করছে (মেইন হোস্টেল সংলগ্ন যাদবপুর ফাঁড়িও)।" ছুটে গেলুম থানায়। হ্যাঁ, বিবিসির বুলেটিনে প্রচারিত হচ্ছে, "শেখ মুজিবুর রহমান কিলড্।" নিজের কানকেই বিশ্বাস হয় না। চোখে জল নামে। একজন পুলিশ জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি বাংলাদেশের? এই হোস্টেলেই থাকেন?' থাকা মানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

Advertisment

publive-image ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ছবি- দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আর্কাইভ।

হত্যার সময়ক্ষণ বুলেটিনে উল্লেখ নেই। হতে পারে রাত্রি বারোটার পরে। অর্থাৎ, তারিখ হিসেবে ১৫ আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবস। এই দিন বেছে নেওয়ার কারণ হয়তো, ভারত স্বাধীনতা দিবস নিয়ে মশগুল থাকবে, বড় রকম ঝুট ঝামেলা করবে না। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা চলছে। রুমে ফিরতেই চোখ মুখ দেখে অলোকের প্রশ্নঃ 'সত্যি?' বললুম, 'বিবিসি বলছে'। ঘুম হলো না। ছটফট করছি। মাথা ঘুরছে। গোটা শহর নিস্তব্ধ। সকালেও লোক জন পথে নেই। ছুটির দিন। সাতটার পর কিছু মানুষ ব্যাগ হাতে বাজারমুখী। যোধপুর পার্ক বা যাদবপুর বাজারে। হোস্টেলের সামনেই ছোট্ট খুপরির মতো চায়ের স্টল। স্টলে ছোট রেডিও। আকাশবাণীর ব্রেকিং নিউজ। লোকের জটলা। খবর শুনছেন। বলাবলি করছেন, বিষয় মুজিব হত্যা। বেলা যত বাড়ছে, পথের মোড়ে ভিড়, জটলা। প্রত্যেকের মুখে এক কথা, 'কে মারলো মুজিবকে? কারা মারলো? পাকিস্তান মেরেছে?' আকাশবাণী কিংবা বিবিসির খবরে বিস্তারিত কিছু নেই। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বেতার যা প্রচারিত করছে তারই পুনরাবৃত্তি। বিদেশি সাংবাদিকরাও (ঢাকাস্থ) কোনও সংবাদ দিতে পারছেন না। নিশ্চয়ই কড়াকড়ি সেন্সর। তখন তো আজকের দিনের মতো এত প্রযুক্তি ছিল না।

যোধপুর পার্কে থাকেন অন্নদাশঙ্কর রায়। মেইন হোস্টেল থেকে তাঁর বাড়ি আধা কিলোমিটারও নয়। ন'টার আগেই গেলুম অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে। দেখি, অনেকটাই উদ্ভ্রান্ত। পায়চারি করছেন। মুখে রা নেই। লক্ষ্য করি, তাঁর চোখে জল। হাতের ইশারায় বসতে বললেন। লীলা রায়, অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী, 'বিকেলে এসো।'

অন্নদাশঙ্কর রায় ব্রিটিশ যুগের আইসিএস। ডাকসাইটে আমলা। ধীরস্থির। বহুমান্য লেখক। বুদ্ধিজীবী। স্পষ্টবক্তা। ভয়ডরহীন। আইসিএস জীবনে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গের নানা জেলায়। পূর্ববঙ্গকে হাড়েমজ্জায় জানতেন। ভালোবাসতেন। তাঁর একটি গ্রন্থের নামঃ 'আমার ভালোবাসার দেশ'। এই দেশ পূর্ববঙ্গ। আজকের বাংলাদেশ। ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ১৯৭১-এ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন 'বঙ্গবন্ধু' নামেই কবিতা লেখেন।

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান

দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয়, হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান
(বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১)

হোস্টেলে না ফিরে গেলুম বন্ধু শাহ মোহাম্মদ তৌজীহফ ওরফে মানিকের হোস্টেলে। ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বাড়ি রাজশাহী। পড়ছেন স্কলারশিপ নিয়ে (এখন লন্ডনে বাস। একটি বিখ্যাত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। দু'জনে গেলুম আনন্দবাজার, দ্য স্টেটসম্যান-এ। বাড়তি খবরের আশায়। কোনও বাড়তি খবর নেই। ঢাকার রেডিওর খবরই সম্বল। গেলুম ডেপুটি হাইকমিশনে (কলকাতাস্থ)। তালা বন্ধ। পিয়ন, দরোয়ানও নেই। কারোর খোঁজ পাওয়া গেল না। পার্কসার্কাসের মোড়ে মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা করছি, দেখি, দূতাবাসের একজন ফাস্ট সেক্রেটারি হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন। দৌড়ে কাছে যাই। জিজ্ঞেস করি, বিশদ জানার জন্য। তিনি মৌনী। কথা না বলে উল্টো হাঁটলেন। হতে পারে, ভয়ে দিশেহারা। কিংবা বঙ্গবন্ধু হত্যায় দিকশূন্যহীন।

publive-image সই করছেন বঙ্গবন্ধু।

বিকেলে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে হাজির। লেখার টেবিলে তখন। উঠে এলেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখছি। অন্নদাশঙ্কর কোনও লেখার শিরোনাম ঠিক না করে লিখেন না। লেখার শিরোনামেই প্রকাশিত মূল কথা। হোক তা প্রবন্ধ। গল্প। লেখার শিরোনাম দিয়েছেন 'কাঁদো, প্রিয় দেশ' (এই নামে বইও আছে)। লেখাটি 'দেশ' সাপ্তাহিকে পাঠিয়েছিলেন। ছাপা হবে, কম্পোজ হয়েছে, প্রুফ দেখাও। দিল্লি থেকে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি, অন্নদাশঙ্কর রায়কে (তখন ইমার্জেন্সি। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বাহিনী কলকাতার পত্রপত্রিকার সেন্সরে খড়্গহস্ত। সিদ্ধার্থশঙ্করই লেখাটি ইন্দিরাকে পাঠিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্করকে ইন্দিরার নিষেধাজ্ঞা, লেখা অপ্রকাশের।

হোস্টেলের সামনে সুবিমল দত্তর বাড়ি (সুবিমল দত্ত বাংলাদেশে হাই কমিশনার ছিলেন)। বারান্দায় বসে আছেন। অন্নদাশঙ্করের বাড়ি থেকে ফেরার পথে দেখলুম। সুবিমলবাবুর সঙ্গে পরিচয় ছিল। গেলুম। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বললেন, "আমাদের 'র' তাঁকে বলেছেন, আমিও একবার (দিল্লি থেকে গিয়ে) বলেছি, সাবধান করেছি, 'বিপদ ঘনতর।' বঙ্গবন্ধুর কথা, 'হতে পারে না, ইম্পসেবল্।' মানুষকে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কখনও বিশ্বাস হারাননি। না হারিয়ে সবংশে নির্মূল।"

(লেখক জার্মানি নিবাসী সাহিত্যিক-সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত।)

Bangladesh 15 August
Advertisment