এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য থেকে ১৮ টি আসন লাভ করার পর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আরও অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়ে আসরে নেমেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন আজও যথেষ্ট দুর্বল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত নেত্রীর বিরুদ্ধে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন, তাও স্পষ্ট নয়। সত্যি কথা বলতে, কোনও একজন ব্যক্তির ছবি, যাকে বলা হয় পোস্টার বয় বা পোস্টার ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিজেপিতে নেই। হতে পারে ভোটের মুখে ঝোলার মধ্যে থেকে কোনো এক নতুন চরিত্রকে আচম্বিতে বের করে আনবেন মোদী-অমিত শাহ। সে তো ভবিষ্যতের জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু আজ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের কাহিনীর মর্মকথা কী?
পশ্চিমবঙ্গে মমতা সরকারের আট বছর অতিবাহিত হওয়ার পর লোকসভা নির্বাচনের সময় বোঝা গেল যে শুধু হিন্দু বনাম মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন নয়, গোটা রাজ্যে জেলায় জেলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া তৈরী হয়েছে। আর এমনই এক পরিস্থিতিতে বিজেপি মুকুল রায়কে তৃণমূল থেকে নিয়ে এসে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চেয়েছিল। ইংরাজিতে একটা কথা আছে, 'দ্য টেস্ট অফ দ্য পুডিং ইজ ইন ইটস্ ইটিং'। মুকুল রায় সফল হয়েছেন, এ কথা তো মানতেই হবে। তা আপনি মুকুল রায়কে পছন্দ করুন আর নাই করুন।
এই প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে আজকের ২১ জুুলাই একটা ঐতিহাসিক দিন। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সিপিএমের বিদায় এবং মমতার আগমনের নেপথ্যে এই ২১ জুুলাইয়ের পটভূমি ভোলার নয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির উত্থানের পর আজকের এই ২১ জুুলাই আরও প্রাসঙ্গিক, আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: অন্য পক্ষ: বিজেপিতে কি জায়গা ফাঁকা আছে?
দিল্লিতে, অর্থাৎ কলকাতার সমাবেশ থেকে দেড় হাজার কিমি দূরে, বসে বিজেপির শীর্ষ নেতারা দেখতে চান, মমতা আজ কী বলেন। কত মানুষ এ সমাবেশে আসেন। ধরুন ২০১৯-এর লোকসভায় বিজেপি যদি একটি আসনও জিততে না পারত, তাহলে আজ মমতার ২১ জুুলাইয়ের মঞ্চ থেকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে পথনির্দেশ ঘোষণা হতো, বিজেপি ১৮ টি আসন জেতার পর মমতার রণকৌশল একই রকম হতে পারে না। এ লেখা যখন লিখছি তখনও মমতার বক্তৃতা শুরু হয় নি, তবে মানুষের ভিড়ের যদি হিসেব করা হয়, সেই ভিড় কিন্তু তৃণমূলের জন্য মৃতসঞ্জীবনীসুধা।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, শ্রাবণ মাসে এ হলো মমতার বাৎসরিক সার্কাস। দিলীপবাবু দিলীপবাবুর কাজ করবেন, বিজেপি আরও আক্রমণাত্মক হবে, তবে দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্ব একথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ২০১৯-এ বিজেপির ভোট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও মমতার ভোট কিন্তু কমে নি। তাই বিজেপি কর্মীদের বারবার শীর্ষ নেতৃত্ব বলার চেষ্টা করছেন, দয়া করে ভাববেন না যে খেলা শেষ হয়ে গেছে। বিজেপি ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে জিতেই গেছে।
তাছাড়া এখন বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের মধ্যেই এক নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সেটি হলো এই যে, মুকুল রায় তৃণমূল ভেঙে নানা জেলার নেতাদের বিজেপিতে সামিল করাচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? অনেক সময় কলকাতাকে এড়িয়ে মুকুল রায় রাজ্যের তৃণমূল নেতাদের দিল্লির সদর কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিইয়েছেন, সেটা কি উচিত কাজ হয়েছে? এই বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। আরএসএস নেতৃত্বের বক্তব্য, এভাবে 'বেনো জল' ঢোকানো অনুচিত হচ্ছে। বিজেপি একটা সর্বভারতীয় দল। মতাদর্শের ভিত্তিতে দল চলে। এভাবে যাঁরা আজ বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে এঁদের নিয়ে তো দলের বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
মুকুল রায়ের যুক্তি ছিল ভিন্ন। তিনি বারবার বলেছেন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা যখন ভালো নয়, যখন আন্দোলন নেই, নেতৃত্বেরও সংকট, তখন এই যে তৃণমূল ভেঙে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, সে তো ভালোই। এতে এই প্রমাণ হচ্ছে যে তৃণমূল ছেড়ে 'তৃণমূল' স্তর থেকেই নেতারা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে। কেন দিচ্ছেন? কারণ একটাই। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর যে বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা প্রবল, তা সকলেই বুঝতে পেরে গেছেন। দেওয়াল লিখন খুবই স্পষ্ট। আর তাই মুকুল যেটা করছেন তাতে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গোটা দেশ জুড়ে বিজেপির পক্ষ থেকে এক ধরণের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তাই এই দল ভাঙার প্রক্রিয়াটা চালিয়ে যাওয়াই ভালো।
বীরভূমের মুসলিম নেতা মইনুল ইসলামকে বিজেপিতে নিয়ে আসা নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়ে ওঠে। আরএসএস মুখপাত্র স্বস্তিকায় বেশ কিছু সম্পাদকীয়তে সমালোচনা করা হয়। সেইসব সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে এধরণের 'এন্ট্রি'র ফলে বিজেপিতে বেনো জল ঢুকছে। একদা সিপিএম-এর 'মাফিয়া-লুম্পেন' কিছু সমাজবিরোধীও অতীতে ভোটের আগে তৃণমূলে চলে আসে। আবার আজ সেইসব সমাজবিরোধীদের একাংশ বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিজেপির এক নেতা বলছিলেন, আরএসএস এমন এক সংগঠন, যেখানে শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদন ছাড়া স্বস্তিকার মতো পত্রিকায় কোনো রাজনৈতিক 'লাইন' নেওয়া যেতে পারে না। অনেকের মনে হয়, মইনুল নিজে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেন। তাঁকে নিয়ে বিজেপির সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। এখন এই মইনুলকে বিজেপিতে রাখা হবে নাকি তাড়িয়ে দেওয়া হবে, তাই নিয়েই চলছে লড়াই।
আরও পড়ুন: বাঙালিকে কি তৃণমূল বা বিজেপি হতেই হবে?
কিন্তু এও তো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি। বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডলের মোকাবিলা করতে গেলে মুকুল রায়ের এই কৌশল তো প্রয়োজন। এই টানাপোড়েনের মধ্যে খোদ মুকুল রায়কেই এই প্রশ্নটা করেছিলাম। তিনি বললেন, "আমরাও বেনো জল নিয়ে সতর্ক। সে ফিল্টারের কাজ আমরা করব। কিন্তু এই যে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসার ঢল নেমেছে, এই প্রবণতাটাও তো গুরুত্বপূর্ণ।"
কিন্তু হালিশহরে বিজেপিতে চলে যাওয়া কিছু কর্মীকে আবার তৃণমূলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই উল্টোরথের প্রক্রিয়াতে বিপদ হয়ে গেল মুকুল রায়ের। সত্যি কি তাই? দিলীপ ঘোষ নাকি আবার মুকুল রায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছেন। বিতর্ক যাই হোক, একথা স্পষ্ট, এই ভাঙনের ফলে উৎকণ্ঠা বাড়ছে তৃণমূলের।
আসলে বেলায় বেলায় তৃণমূল সংগঠনের মধ্যেই যে ইনটার্নাল হেমোরজ শুরু হয়ে গেছে, তা কি ২১ জুুলাই রোধ করতে পারবে? মুকুল রায়ের কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতির কি মোকাবিলা করতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? প্রশান্ত কিশোর এখন তৃণমূলের উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয়। সম্ভবত সেজন্যই এই প্রথম ২১ জুুলাইয়ের সভার প্রচার অভিযান চালানো হয়েছে স্রেফ মমতার ছবিকে সামনে রেখে। দিল্লিতে জাতীয় স্তরে বিজেপি যেমন শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদীর অবয়বকে সামনে রেখেই যুদ্ধে নামে, ২০২১-এর ভোটযুদ্ধে বাংলায় শুধু মমতার মুখ থাকবে মানুষের সামনে।