ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ক্ষুদ্রতম কফিনগুলোই সবথেকে ভারী। অন্তত সাহেবরা সেটাই বিশ্বাস করেন বলে ধরে নেওয়া যায়। শিশুমৃত্যু, অতএব, সাহেবদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয়। শিশুমৃত্যু রোধ করা তাই পশ্চিমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত। ভারতের সামাজিক দর্শন অন্যরকম। অনেক সন্তানের জন্ম, অনেকের মৃত্যু এবং তার মধ্যে কয়েকটি সন্তানের বেঁচে থাকা… এই ছিল সনাতন পরম্পরা। সন্তানদের কীভাবে পালন করবেন, খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সংস্থান কেমন করে হবে, এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রায়শই উত্তর পাওয়া যায়, "জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।" অর্থাৎ শিশুর দায়িত্ব ভগবানের হাতে। এভাবে মানুষের ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলার চল এদেশে। মানুষের জন্ম আর মৃত্যুকে নিয়তির বিধান হিসাবে গণ্য করে এমনকি শিশুদের মৃত্যুও স্বল্প আয়াসে মেনে নিতে অভ্যস্ত আমরা। সেই কারণেই আমাদের সরকারগুলির মধ্যেও দেখা যায় শিশুদের মহামারির মতো মর্মান্তিক ঘটনাতেও অবিচলিত থাকার প্রবণতা। আমাদের রাজনীতিতেও বিশেষ ছাপ ফেলে না এসব।
মুজফফরপুরের সাম্প্রতিকতম মহামারী সমস্যাটিকে আবার প্রকট করে তুলেছে। এর আগে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের জমানায় অক্সিজেনের অভাবে অনেকগুলি শিশুর মৃত্যুর ফলে কয়েকদিন হইচই হল এবং তারপর আমরা সব ভুলে নতুন হুজুগে মেতে উঠলাম। সমস্যার স্থায়ী সমাধান বা পরিস্থিতির প্রকৃত উন্নতি হল না। কয়েকজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি অবশ্য সেই ঘটনা মনে রেখেছেন ভবিষ্যতে বিভিন্ন আলোচনায় বা সমধর্মী ঘটনা অন্য কোথাও ঘটলে ওই ঘটনার উল্লেখ করবেন বলে। এসব উল্লেখ সাধারণত পরবর্তী অন্য ঘটনাগুলির গুরুত্ব লঘু করার জন্য। ফলে এই মনে রাখা শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতিতে কোনো কাজে তো লাগেই না, বরং রাজনৈতিক আকচাআকচিতে মূল সমস্যা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুবিধা করে দেয়। যেহেতু দল নির্বিশেষে সরকারের মধ্যে সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যায় না, তাই তাঁরাও বিষয়টির অভিমুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সদর্থক কিছু করা থেকে বিরত থাকার সুযোগই খোঁজেন।
আরও পড়ুন, নেহরুবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন রণকৌশল মোদীর
মনে রাখা প্রয়োজন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিশুদের মধ্যে মহামারী প্রায়শই ঘটে থাকে, যা এক যন্ত্রণাদায়ক বাস্তব। বিহার উত্তর প্রদেশ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের এনকেফালাইটিস জনিত মহামারী প্রায় প্রতি বছরই হয়। দুর্ভাগ্য এই যে নিয়মিত ঘটা সত্ত্বেও আমরা এর প্রতিকারের বন্দোবস্ত করিনি। মুজফফরপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা এসবের মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু বৈজ্ঞানিক ও আর্থসামাজিক কারণে।
অন্যান্য এনকেফালাইটিসগুলির সঙ্গে মুজফফরপুরের তথাকথিত অ্যাকিউট এনকেফালাইটিস সিন্ড্রোমের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে, যা শুধু বৈজ্ঞানিক দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এনকেফালাইটিস মানে মস্তিষ্কের প্রদাহ। এনকেফালাইটিস বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, তা জীবাণু ঘটিত (মূলত ভাইরাসের কারণে) সংক্রামক রোগ। তা এক রোগী থেকে আরেক রোগীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মশা জাতীয় বিভিন্ন পতঙ্গ বা বাতাসের মাধ্যমেও এসব সংক্রমণ ছড়াতে পারে। আপাত সুস্থ মানুষও সেসব রোগের বাহক হতে পারেন। এসব জীবাণুর সংক্রমণ রোধ করে মহামারি আটকানোর কিছু পদ্ধতি আছে, যা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। তবু এসব রোগ প্রতিরোধ করা কিছুটা কঠিন এবং মহামারী রুখে দেওয়া গেলেও জীবাণুগুলিকে (অর্থাৎ রোগগুলিকে) নির্মূল করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়, কারণ জীবাণুরাও এই পৃথিবীতে বাঁচতে এসেছে এবং বাঁচার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে।
আরও পড়ুন, চিকিৎসক আন্দোলন: বিনায়ক সেনের কী বক্তব্য?
মুজফফরপুরের ঘটনা এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের। এই তথাকথিত এনকেফালাইটিস কোনো জীবাণু ঘটিত রোগ নয়। মূলত রক্তে শর্করার অভাবজনিত এক অবস্থা, যার ফলে শিশুদের মস্তিষ্ক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। শরীরের কিছু অঙ্গ ফ্যাট বা প্রোটিন থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি টেনে নিতে পারলেও মস্তিষ্কের বেঁচে থাকা নির্ভর করে নিয়মিত গ্লুকোজ (সবচেয়ে ছোট একপ্রকার শর্করা) সরবরাহের ওপর। যদি আমরা অনেকক্ষণ না খাই, তাহলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমতে থাকে। তখন প্রধানত যকৃৎ (লিভার) ও কিছু মাত্রাত বৃক্ক (কিডনি) স্নেহপদার্থ (ফ্যাট) ও আমিষ (প্রোটিন) থেকে গ্লুকোজ তৈরি করে রক্তে সরবরাহ করে। নতুন করে গ্লুকোজ তৈরি করার এই পদ্ধতির নাম "গ্লুকোনিওজেনেসিস"।
লিচু ফলটির মধ্যে একটি রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা এই গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে মাঝপথে বন্ধ করে দেয়। ফলে গ্লুকোজ তৈরি হতে পারে না এবং মস্তিষ্কের কোষগুলি গ্লুকোজের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু যৌগ রক্তে জমা হয়, যা মস্তিষ্কের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই দুরকম ক্ষতির ফলে মস্তিষ্ক বিকল হয়, খিঁচুনি হতে থাকে এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল হয়। বিহার, উত্তর প্রদেশের লিচু উৎপাদক এলাকায় এই রোগের শিশুদের মৃত্যু হয় বহুবছর ধরে গ্রীষ্মের দিকে।
আরও পড়ুন, মাতৃভাষাচর্চা ও ভিন্ন ভাষার চাপ
লিচু খেলেই কিন্তু এমন রোগ হয় না। লিচু আমরা সবাই খাই, আমাদের বাচ্চারাও খায়। কারো খিঁচুনি হয় না লিচু খেয়ে। কারণ আমাদের বাচ্চারা বাবামায়ের নজরে থেকে পরিমিত লিচু খায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে অন্য খাবার খায়। দোষটা আসলে লিচুর নয়, দোষ অপুষ্টির, অনাহারের। লিচু তো শুধুমাত্র গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে রোধ করতে পারে। শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি না হলে এই প্রক্রিয়াটির প্রয়োজনই হয় না। অর্থাৎ শিশুর শরীর অপুষ্ট হলে, সে খিদের পেটে প্রচুর পরিমাণে লিচু খেয়ে ফেললে এবং তারপর অনেকটা সময় অনাহারে থাকলে তবেই এই রোগ হতে পারে। লিচু বাগানের শ্রমিকদের শিশুরা অপুষ্ট। তারা পথে পড়ে থাকা লিচুগুলো কুড়িয়ে নিজেরা খায় এবং বন্ধুদের খাওয়ায়। এভাবে বাচ্চাদের খিদে মিটছে দেখে বাবামায়েরাও নিশ্চিত থাকেন। ভোর ছটা থেকে লিচু বাগানের কাজ শুরু হয়। এই শিশুরা রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, না খেয়েই। বাবামায়েরা আর তাদের রাতে খেতে দেবার গরজ দেখান না। ফলে শেষ রাতের দিকে বাচ্চাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা রীতিমতো কমে যায় এবং গ্লুকোনিওজেনেসিস জরুরি হয়ে পড়ে। দিনের বেলা খালি পেটে প্রচুর লিচু খেয়ে ফেলায় তা আর সম্ভব হয় না। ফলে ভোরের দিকে খিঁচুনি শুরু হয় এবং তখনই গ্লুকোজ না পেলে দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় শিশুরা।
এবার এর সামাজিক রাজনৈতিক গুরুত্বগুলো স্পষ্ট করে দেখা যাক।
১) 'অ্যাকিউট এনকেফালাইটিস সিন্ড্রোম' নামে খ্যাত এই রোগটি আদতে অপুষ্টিজনিত। অপুষ্টি দারিদ্র্য ও অবহেলার ফসল।
২) এই রোগটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের চূড়ান্ত উদাহরণ। দরিদ্র শ্রমিক বস্তিগুলির অবহেলিত বাচ্চাদের মধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব। আশপাশের শহরগুলোতে সচ্ছল পরিবারগুলোর মধ্যে এই রোগ দেখা যায় না, কারণ তাদের শিশুরা অপুষ্টি অনাহারে জর্জরিত নয়।
৩) রোগটি প্রথমাবস্থায় প্রতিরোধযোগ্য। তাড়াতাড়ি শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে, সেখানে চট করে রক্তের গ্লুকোজ মাপার ব্যবস্থা থাকলে এবং তাড়াতাড়ি গ্লুকোজ ইনজেকশন দেওয়া গেলে মৃত্যু আটকানো সম্ভব। দেরী করলে চিকিৎসকের কিছু করার থাকে না। অর্থাৎ সহজে চিকিৎসাযোগ্য একটি রোগকে স্রেফ সচেতনতা ও প্রস্তুতির অভাবে মহামারি হয়ে উঠতে দেওয়া হচ্ছে বারবার।
৪) রোগটি প্রতিরোধযোগ্য সম্পূর্ণভাবে। শুধুমাত্র পুষ্টির যোগান থাকলে এবং বাচ্চাগুলোকে রাতের খাবার দিলে এতবড় মহামারী ঠেকাতে কোনো ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না। এই সামান্য জিনিসগুলো আমরা আমাদের দেশের শিশুদের দিতে পারিনি বলেই আমরা এমন সর্বনাশের মুখোমুখি।
আরও পড়ুন, জুন: মানবাধিকারের পক্ষে ভয়াবহ এক মাস
যদিও ভারতের রাজনীতিতে যাবতীয় উন্নয়নের চেয়ে ধর্ম ও জাতপাতকে বড় ইস্যু করে রাখা হয়েছে, তবু মাঝেমাঝে উন্নয়নের স্লোগান দিতে হয়। তখন শুধুমাত্র জাতীয় আয়ের কথা আলোচিত হয় এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কিছু খতিয়ান পেশ করা হয়। অথচ কোনো দেশের ভালো থাকা মাপার যে সূচকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তার মধ্যে শিশুমৃত্যু, গড় আয়ু ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো নিয়ে আমরা আলোচনাই করি না।
এরকম দুঃখজনক ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমরা দোষী খোঁজার সহজ খেলায় মেতে উঠি এবং আমাদের প্রশাসকেরা কিছু নাটকীয় পদক্ষেপ নেন। যেমন এবার বিহার সরকার পাটনা মেডিকেল কলেজের এক শিশু চিকিৎসককে মহামারী এলাকার হাসপাতালে বদলি করলেন এবং মাত্র সাড়ে তিনদিনের মধ্যে তিনি সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করতে না পারায় তাঁকে সাসপেন্ড করা হল। একমাত্র উদ্দেশ্য জনগণকে এই ধারণা দেওয়া যে সরকার ব্যাপারটি নিয়ে খুব কড়া, যা এক ভাঁওতা মাত্র। এর আগে উত্তরপ্রদেশে একইভাবে ডক্টর কাফিল খানকে শাস্তি দিয়ে জনরোষকে চাপা দেবার চেষ্টা হয়েছিল। এই দুই চিকিৎসকের কারো ব্যক্তিগত নিষ্কলুষ চরিত্র নিয়ে কোনো দাবিদাওয়া নেই আমার তরফে। বক্তব্য একটাই, এভাবে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা যতদিন থাকবে, নিজেদের ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতা যতদিন থাকবে, ততদিন সমস্যাগুলোও একইরকম থাকবে।
আরও পড়ুন, বিরোধীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব
মুজফফরপুর দেখিয়ে দিল যে আমরা আসলে আমাদের শিশুদের খেতে দিই না। স্রেফ খেতে দিই না। তাই তারা মরে। বছরের পর বছর মরে এবং আমরা তোয়াক্কা করি না, মৃত্যু মিছিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই না। একজন বড় শিল্পপতি যখন স্ত্রীর জন্মদিনে বিলাসবহুল জাহাজ উপহার দিচ্ছেন, আমি-আপনি যখন ক্যান্ডেল লাইট ডিনার সারছি, তখন অগুনতি শিশু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরা আর জাগবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ ঘুমিয়ে পড়ছে ক্রমশ।