শান্তির নোবেল পুরস্কার পেলেন ইরাকের পঁচিশ-বছরের জঙ্গিধর্ষিতা জনজাতি-তরুণী নাদিয়া মুরাদ বাসি তাহা।এক ধর্ষিতার সুবাদেই প্রথম নোবেলপ্রাপ্তি ইরাকের। দীর্ঘদিন ধরে আইসিস-জঙ্গিদের লাগাতার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন নাদিয়া। ইয়েজাদি-সম্প্রদায়ের মেয়ে নাদিয়াকে ইসলামি জঙ্গিরা (আইসিস) ধর্ষণ করেছে ইসলামি ভাবাদর্শের দোহাই দিয়েই। সিরিয়ায় আইসিস, আফগানিস্তানে তালিবান ও আফ্রিকায় বোকোহারাম জঙ্গিরা দীর্ঘকাল ধরে একইভাবে নারীনিগ্রহ করেছে ওই ইসলামের নামেই। জঙ্গিগোষ্ঠীর সেই তথাকথিত ধর্মীয় ভাবাদর্শটি হল, কাফের-নারীপুরুষদের ধর্ষণ ও গণহত্যার জিহাদি-অধিকার। আফগানিস্তানে সেই নির্যাতন চলেছে শিয়া-সুন্নির বিভেদে। এই প্রেক্ষিতে নাদিয়াকে পুরস্কৃত করে নোবেল ফাউন্ডেশন কমিটি ধর্ষণের মতো ভয়াবহ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু, পাশাপাশি ঘটেছে আরও-একটি কলঙ্কের ঘটনা। সুইডিশ অকাদেমির সদস্য, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান লিজিয়ঁ অফ অনার-এর প্রাপক, সুইডেনের বিশিষ্ট কবি ক্যাটারিনা ফ্রসটেনসনের স্বামী, অকাদেমি-ঘনিষ্ঠ ৭২-বছরের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক জঁ ক্লোদ আরনোর বিরুদ্ধে যৌনকেলেঙ্কারীর অভিযোগ ওঠায় আকাদেমি এই বছরের সাহিত্যপুরস্কার স্থগিত রেখেছে। দুটি বিষয় যে পারস্পরিক ও কার্যকারণসমন্বিত, এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ থেকেই যায়। মনে হতে পারে, সংস্থাঘনিষ্ঠর যৌনকেলেঙ্কারি আড়াল করতে বা সে-বিষয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করতেই নোবেল কমিটি ধর্ষিতা নাদিয়াকে নির্বাচন করেছে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, ধর্ষিতাকে পুরস্কৃত করে কমিটির কলঙ্কমুক্তির পদক্ষেপ করেছে তারা।
আরও পড়ুন, যুদ্ধকালীন যৌন হিংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন মুকওয়েজ ও নাদিয়া
অকাদেমির প্রভাবশালী সদস্যের স্বামী আরনো স্বভাবতই সংস্থার অন্যান্য সদস্যদেরও ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে, আরনো ও ক্যাটারিনা স্টকহোমে ‘ফোরাম’ নামে একটি বিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চালান। সেই প্রতিষ্ঠান সুইডিশ অকাদেমি থেকে প্রভূত আর্থিক সহায়তা পায়। গত-বছরের নভেম্বরে সুইডেনের নামী সংবাদপত্র ‘ডাগেনস নাইহেটের’ জানায়, আরনো কয়েক বছর ধরে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেক মেয়েকে নানাভাবে যৌননিগ্রহ করেছেন। সেইসব মেয়েদের সাংস্কৃতিক জগতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের বাধ্য করেছেন শয্যাগত হতে। সেইসব সহবাস হয়েছে স্টকহোম ও প্যারিসে অকাদেমির ভবনেই। সেইসব মেয়েদের মধ্যে আছেন শিল্পী অ্যানা-কারিন বাইলুন্ড, ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েলা হাকান্সসন, এমনকি সুইডেনের যুবরানি ভিক্টোরিয়াও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আরনো অভিযোগকারিণীদের সঙ্গে সঙ্গম করেছেন, বা তাঁদের অঙ্গস্পর্শ করেছেন। ১৯৯৬ সালে যৌননিগ্রহের পরে অ্যানা-কারিন সুইডিশ অকাদেমির কাছে অভিযোগ করেও কোনও ফল পাননি। ২০০৭ সালে গ্যাব্রিয়েলাও নিগ্রহের অভিযোগ তুলেছিলেন। সম্প্রতি ‘#মি-টু’ আন্দোলনের জেরে আঠারো মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে নিগ্রহ ও ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অকাদেমি সাহিত্যের নোবেল স্থগিত করে নিজেদের মুখরক্ষা করতে চেয়েছে। কেননা, অকাদেমিই কেবল সাহিত্যশাখার পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত। অন্যান্য শাখার দায়প্রাপ্ত নোবেল ফাউন্ডেশনের স্বতন্ত্র সমিতি। পুলিশও এতদিনে তদন্তে নামে। আরনো যথারীতি আইনজীবীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগই ভিত্তিহীন। প্রতিটি সহবাসই হয়েছে সম্মতির ভিত্তিতে। যদিও, স্বামীর অপরাধে ক্যাটারিনাকেও ইস্তফা দিতে হয়েছে অকাদেমি থেকে।
কেবল যৌননিগ্রহের অভিযোগই নয়। আরনোর বিরুদ্ধে অকাদেমির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও নথিপত্র ফাঁস করার অভিযোগও উঠেছে। এই কাজে তাঁর দোসর ছিলেন অকাদেমির স্থায়ী-সচিব সারা দানিউস। সারা-ই আকাদেমির পক্ষে আরনো-দম্পতির সংস্কৃতিসংস্থার সঙ্গে সংযোগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। কেবল মেয়েদের শরীরে প্রভাব খাটানোই নয়, সারার সাহায্যেই আরনো যথাযোগ্য স্থানে আকাদেমির নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আগেভাগেই ফাঁস করে দিয়েছেন। পুরস্কারতালিকায় থাকা গ্রন্থগুলির প্রকাশকদের সঙ্গে আরনোর আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। বহুদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নোবেল পুরস্কারের স্বচ্ছতা অস্তমিত। এতদিনে সেই অভিযোগের পর্দাফাঁস হয়ে গেল আরনোর দৌলতে। যৌননিগ্রহের সঙ্গে ওই বৃদ্ধ আরও যে-সাংঘাতিক কুকীর্তিটি করলেন তা হল, পৃথিবীর নোবেলভূষিত সাহিত্যিকদের ভাবমূর্তিতে কালিমালেপন। এখন সকলেই পুরস্কৃত লেখকদের সন্দেহভাজন হিসাবে দেখার সুযোগ পাবে।
তবু, নাদিয়ার পুরস্কারপ্রাপ্তি এক অভাবিত ঘটনা। ২০১৪ সালে আইসিস-জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাকে গণহত্যার সঙ্গে দলধর্ষণ ও মানবপাচারও চালিয়েছিল সমান তালে। তখন নাদিয়ার বয়স একুশ-বছর। ইরাকের উত্তরাঞ্চলের সিনজার-প্রদেশের কোজো গ্রাম থেকে জঙ্গিরা তাঁকে অপহরণ করে তিনমাস জঙ্গি-অধিকৃত মসুলের বন্দিশিবিরে রেখে লাগাতার ধর্ষণ করেছে। সেবার একদিনেই ৬০০ গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। সেই শবস্তূপের মধ্যে ছিলেন নাদিয়ার ছয়-ভাই ও মা। গ্রামের ৬৭০০ বালিকা ও তরুণীকে জঙ্গিরা সেদিন তুলে নিয়ে যায় যৌনদাসী করার উদ্দেশ্যে। বন্দিশিবিরে একটি কুঠুরিতে রাখা হয় নাদিয়াকে। সকলের মতো উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হত তাঁকেও। পালাবার চেষ্টা করলেই জুটত বেদম বেত্রাঘাত, সিগারেটের ছেঁকা ও দলধর্ষণ। জঙ্গিরা উপর্যুপরি দলধর্ষণের পরে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়েছে বন্দুকের নলও। নাদিয়া আর্তনাদ করেছেন। সেই আর্তনাদে উল্লসিত হয়েছে জঙ্গিরা। কাঠুয়া বা উন্নাওয়ে যেমন ‘ঘৃণ্য’ দলিত-মেয়েদের ধর্ষণে অরুচি নেই উচ্চবর্ণীয় বিধায়ক ও পুরোহিতের, আইসিস-জঙ্গিদেরও তেমনই নিম্নবর্গীয় ইয়েজাদি-মেয়েদের উপর যৌনহিংসা চরিতার্থ করায় কোনও অনীহা নেই।
অবশেষে ঘটনাচক্রে একদিন দরজা খোলা পেয়ে বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাদিয়া। নাদিয়াকে ফেরাননি সেই অপরিচিতরা। তাঁরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে গোপনে জঙ্গি-অধ্যুষিত এলাকার বাইরে দুহকের শরণার্থীশিবিরে পাঠিয়ে দেন নাদিয়াকে। সেখানে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলজিয়মের সংবাদপত্র ‘লা লিবরে বেলজিক’-এর এক সাংবাদিক রোয়াঙ্গার শিবিরে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরে নাদিয়া ও অজস্র বন্দিনির কথা জেনে যায় দুনিয়া। নাদিয়া-সহ ১০০০ শিশু ও কন্যাকে দেশে আশ্রয় দেয় জার্মানি। ২০১৫ সালে নাদিয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘে নির্যাতিত মেয়েদের কথা জানানোর সুযোগ পান। ইরাকে ধর্ষণ ও মানবপাচারের ভয়াবহ ঘটনাগুলি জেনে হতবাক হয় পৃথিবী। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শুভেচ্ছাদূতের দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৭ সালে বের হয় নাদিয়ার আত্মজীবনী ‘দি লাস্ট গার্ল’ (মাই স্টোরি অফ ক্যাপটিভিটি অ্যান্ড মাই ফাইট এগেইনস্ট ইসলামিক স্টেট)। বইটির ভূমিকা লিখেছেন লেবানীয়-ব্রিটিশ আইনজীবী আমাল ক্লুনে।
তখন থেকেই নাদিয়া হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব। দাঁড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের লাঞ্ছিত মেয়েদের পাশে। তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জনমত সংগঠিত করেছেন। সুবিখ্যাত ‘#মি-টু’ আন্দোলনের আগেই নাদিয়া নিজের ধর্ষিতা-পরিচয়ে সংগঠিত করেছেন ‘আওয়ার পিপলস ফাইট’ আন্দোলন। নোবেল ফাউন্ডেশন কোনও গূঢ় কারণে নাদিয়াকে পুরস্কৃত করে থাকলেও, পৃথিবীর ধর্ষিতা মেয়েরা এই সম্মানে নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাসী হবে। পাকিস্তানের তালিবানবিরোধী মানবাধিকারের মুখ মালালা ইউসুফজাইয়ের পরে নাদিয়াই শান্তি-নোবেলের সর্বকনিষ্ঠ প্রাপক। আমাদের কৈলাশ সত্যার্থীর যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। কেননা, একদিন তিনিও দেশের ধারাবাহিক শিশুধর্ষণের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, ‘একটি শিশুর ধর্ষণে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষিত হয় দেশেরই আত্মা।’ সে-কারণে এই পুরস্কারের মূল্য নিশ্চিতভাবেই সদর্থক। সর্বোপরি, এবারই প্রথম নোবেল পুরস্কার পেলেন এক ধর্ষিতা। সেদিক থেকেও এই অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম।তা সত্ত্বেও হয়তো আরনোর কাঁটাটি খোঁচা দেবে নাদিয়ার নির্বাচনে।\নাদিয়ার সঙ্গে যুগ্মভাবে শান্তির নোবেল পেয়েছেন কঙ্গোর বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক ডেনিস মুকয়োয়েগে। ৬৩-বছর-বয়সি ডেনিস এই মুহূর্তে পৃথিবীর ধর্ষিতাদের কাছে দেবতাবিশেষ। ধর্ষিতাদের শারীরিক-মানসিক ক্ষত-নিরাময়ে তিনি নাদিয়ার মতোই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। দুই-দশক ধরে একাগ্রভাবে এই কাজটিই করে যাচ্ছেন তিনি। কঙ্গোর বুকাভুতে পানজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডেনিসের কাজের সঙ্গে মিল আছে নাদিয়ার উদ্যোগের। নিজের হাসপাতালেই ডেনিস প্রথম ধর্ষণবিধ্বস্ত একটি মেয়েকে দেখেন। মেয়েটি আকাশভেদী আর্তনাদ করছিলেন। ডেনিস পরীক্ষা করে দেখেন, ধর্ষণের পরে মেয়েটির যোনির ভিতরে গুলি করা হয়েছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে যোনির ভিতরাংশ ও ঊরুর একপাশ। সেই সূচনা। তারপর টানা ৮৫-হাজারের বেশি ধর্ষিতার অস্ত্রোপচার করেছেন তিনি। তাঁদের অনেকেই আজ ফিরে পেয়েছেন জীবনের স্বাভাবিকতা।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে একটি ভাষণে ডেনিস বলেছিলেন, ‘মেয়েদের শরীরটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়। এখন যুদ্ধে রাসায়নিক, পরমাণু ও জৈবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ হয়েছে। ধর্ষণও সেই নিষিদ্ধ অস্ত্রের তালিকায় আসুক। ধর্ষণ কোনওভাবেই যুদ্ধাস্ত্র হতে পারে না।’ বয়সে অনেক তরুণ হলেও নাদিয়াও একইরকমভাবে বলেছেন, ‘নারীকে কেন চিরকাল ক্ষমতার দাসী হতে হবে! শরীরের জন্য কেন চিরকাল পরাধীন হয়ে থাকবে মেয়েরা?’ নোবেল কমিটিও দু-জনের মতের অনুরণনেই বলেছে, ‘যৌননিগ্রহ ক্রমশই যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।ডেনিস ও নাদিয়া দু-ভাবে সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এর থেকে মহান শান্তিবার্তা আর-কী হতে পারে।’
নোবেল কমিটি যদি প্রকৃতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার উদ্দেশ্যে ডেনিস ও নাদিয়াকে পুরস্কৃত করে থাকে, তাহলেও এই সিদ্ধান্তের একটি অসামান্য রুপালি রেখা আছে। তা হল, নোবেল ফাউন্ডেশন নিজেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত বিঁধবে প্রভাবশালী ধর্ষক আরনো, তাঁর বিদুষী স্ত্রী ক্যাটারিনা ও সহযোগিনী সারা দানিউসকেও। বোঝা যায়, দুর্নীতি কখনও শেষকথা বলে না।
(মতামত ব্যক্তিগত)