Advertisment

নন্দীগ্রামে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন লেখক-শিল্পীরাও

নন্দীগ্রাম আন্দোলন অতিক্রম করল ১০ বছর। তৎকালীন সময়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন বাংলার লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও। একদশক পর সে সময়কে ফিরে দেখলেন কবি ও সাংবাদিক গৌতম ঘোষদস্তিদার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Buddhadev Bhattacharya at Cpm public meeting,

পাট্টাপ্রদান কর্মসূচিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ফোটো- শুভম দত্ত

গৌতম ঘোষ দস্তিদার

Advertisment

‘মাননীয় মহাশয়, আপনাদিগকে জানানো যায় যে, আগামী ১৪/৩/২০০৭ তারিখে নন্দীগ্রামের জমি দখল হইবে।…আপনারা কিছু লোকজন যোগাড় করিয়া ১৪/৩/২০০৭ তারিখে লোকজন-সহ খেজুরি পার্টি-অফিসে সকাল ৭টার মধ্যে জমায়েত করিবেন। গ্রাহক মারফত দুই লক্ষ টাকা পাঠাইলাম।’

১৪ মার্চের ছ-দিন আগে, ৮ মার্চ, নন্দীগ্রাম-খেজুরির পঞ্চায়েতপ্রধানদের কাছে এমন অবারিত নির্দেশনামা পাঠিয়েছিলেন সিপিয়েমের তৎকালীন সাংসদ তথা নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সেনাপতি লক্ষ্মণ শেঠ। উদ্ধৃত তিনটি বাক্যেই স্পষ্ট, ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে ‘জমি-অধিগ্রহণ’ নয়, ‘জমি-দখল’ হবে শাসকদলের নেতৃত্বে। সেই দখল নির্বাধ করতে ‘লোকজন যোগাড়’ করতে হবে। লোকজনের রাহাখরচ হিসাবে ‘দুই লক্ষ টাকা’ অগ্রিম দেওয়া হয়েছে।

দশ-বছর পরে এই নির্দেশনামার অর্থ আমাদের কাছে জলের মতোই সরল যে, সেই ‘লোকজন’ মোটেই শান্তিদূত নয়, যারা নন্দীগ্রামের চাষিদের ‘ব্রান্ড-বুদ্ধ’-র শিল্পোন্নয়ন কর্মসূচি বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের জমি ছেড়ে দিতে রাজি করাবে। কেননা, সিপিয়েমের মতো বাহিনীভিত্তিক দলের যুক্তিবাদী কর্মীরা দক্ষিণপন্থীদের মতো টাকার বিনিময়ে দলীয় কর্মসূচিতে যুক্ত হয় না। তাহলে, কাদের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য লক্ষ্মণ শেঠ পঞ্চায়েতপ্রধানদের টাকা পাঠালেন! আমরা ১৪ মার্চ টেলিভিশনের পরদায় দেখলাম, তারা আর-কেউ নয়, তারা রক্ষীবাহিনীর-সঙ্গে-মিশে-থাকা ‘হাওয়াই-চটি-পরা পুলিশ’। তারা ভাড়াটে ঠ্যাঙারে, দলীয় কর্মীও নয়। ইতিহাসে তাদের কখনও ‘গেস্টাপো’, কখনও ‘রাজাকার’, কখনও ‘রণবীরসেনা’ বা ‘সালোয়া জুড়ুম’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা সকলেই সকাল-দুপুর তাদের দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছি নন্দীগ্রামের মাটিতে। গ্রামের  মেয়ে-মহিলাদের তারা যেমন চুলের মুঠি ধরে পদানত করেছে, তেমনই পুলিশের সহায়তায় দিনের শেষে রক্তাপ্লুত লুটিয়ে দিতে পেরেছে চোদ্দোটি তরতাজা প্রাণ।

লক্ষ্মণ শেঠের সেই তাৎক্ষণিক সাফল্য ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু, সুদূরপ্রসারে, ওই গণহত্যা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে শুভ হয়নি। তিনি পূর্ব-মেদিনীপুরের রাজপাট হারিয়েছিলেন। যথাসময়ে রাজ্যের বুদ্ধিজীবী-নেতা সব দায় চাপিয়েছিলেন তাঁর কাঁধে। একশো-আশি ডিগ্রি ঘুরে সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছিঁড়ে ফেলতে বলেছিলেন চাষিদের। তাতেও অবশ্য রেহাই পাননি তিনি। রাজত্বহারা হয়েছেন। কেবল তো লক্ষণ-বুদ্ধদেব নন, প্রবলপ্রতাপী দলটিও নখদন্তহীন শার্দূলে পরিণত হল ওই গণহত্যার অভিঘাতে। আমাদের মনে পড়ে, রাবণের নিজ-দোষে  নিজেকে ও লঙ্কারে মজানোর কথা সেই কবে লিখেছিলেন মহাকবি।

Scary Nandigram, then নন্দীগ্রামে আতঙ্কের আবহ ফোটো- শুভম দত্ত

২।

সিপিয়েমের পক্ষে সলতে-পাকানোর কাজটি অবশ্য শুরু হয়েছিল ডিসেম্বর থেকেই। ২৮ ডিসেম্বর ‘নন্দীগ্রামে শিল্প ও উন্নয়নের দাবিতে বিশাল সমাবেশ’ করে সিপিয়েম-লোকালকমিটি। ২৯ ডিসেম্বরের ‘গণশক্তি’ সেই সংবাদ ফলাও করে ছাপে। রাজ্যবাসীর কাছে তারা রাজনৈতিকভাবেই বুদ্ধবাবুর শিল্পোন্নয়ন-ভাবনায় দলীয় সিলমোহর দেয়। ৪ জানুয়ারি ‘গণশক্তি’ লেখে, ‘নন্দীগ্রামে প্রস্তাবিত মেগা কেমিকাল হাব, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বন্দরের উন্নয়নের জন্য ড্রেজিং করে নদী থেকে পলি তুলতে ১৪০০০, ৯১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এজন্য মূলত কালীচরণপুর, সোনাচূড়া এবং কেন্দেমারি জালপাই এই তিনটি গ্রাম-পঞ্চায়েতের ২৭টি মৌজা এবং খেজুরি-২ ব্লকের ২টি মৌজা মোট ২৯টি মৌজা অধিগ্রহণ করা হবে বলে চিহ্নিত হয়েছে। লক্ষণ শেঠ জানান, ওই এলাকার জনগণের অবগতির জন্য এবং তাদের কাছে বিষয়টির স্বচ্ছতার জন্য শিল্পায়নের জন্য প্রস্তাবিত চিহ্নিত এলাকার নাম ঘোষণা করা হয়েছে মঙ্গলবার।’

এর পর, ১১ মার্চ, ব্রিগেডে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভার সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মুষ্টিবদ্ধ হস্তমুদ্রা দেখিয়ে বলবেন, ‘কার কী ক্ষমতা আছে দেখি এবার। ওরা মাঠে নামছে। আমরাও মাঠে নামব।…কার কী ক্ষমতা দেখি…অতীতেও এমন অবস্থা হয়েছে। তবে এখন আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।’ সেই ভাষণের অভিঘাত বোঝা যাবে দু-দিন পরেই।

 CPM captured Nandigram তখন সিপিএম রাজ ফোটো-শুভম দত্ত

৩।

নন্দীগ্রামের নিধন কেবল রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর ‘হাড় হিম’ করে দিল না, বাঙালি বিদ্বজ্জনেরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে। শঙ্খ ঘোষ বাংলা আকাদেমির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। লেখক-কবিরা অনেকেই ফিরিয়ে দিলেন আকাদেমির পুরস্কার। মহামতি বুদ্ধদেব স্বভাবতই জীবনানন্দকে ভুল উদ্ধৃত করে বললেন, ‘যারা যত বেশি অন্ধ, তারা তত বেশি চোখে দেখে আজ।’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়রা গেলেন শঙ্খর বিপরীত পথে। একদা যে-সুনীলের বঙ্কিম-পুরস্কার নিয়ে সিপিয়েমের ঘোর-আপত্তি ছিল, তাঁকে তারা দেখত ‘সিআইয়ের চর’ হিসাবে, সেই তিনিই হলেন তাদের রক্ষাকবচ।  তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হলেন মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, গৌতম ঘোষ, আবুল বাশার, সুবোধ সরকার, জয়দেব বসুরা। সুনীল সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে জানালেন বুদ্ধবাবুর নিভৃত মনোবেদনার অনুক্ত বিবরণ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ২০১৭) যে, ‘নন্দীগ্রামে, প্রতিরোধের সামনের সারিতে যে-মহিলারা এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের আবেগ সঠিক ছিল না।…আমার ধারণা এ জন্য তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) নিভৃতে কষ্ট পাচ্ছেন।’ আমরা ভেবে পেলাম না, সুনীলের মতো শব্দজাদুকর কীভাবে ‘প্রতিরোধ’ শব্দটির বিপর্যাস ঘটালেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্যের আতিশয্যে তিনি ভুলে গেলেন, প্রতিরোধের বিপরীতে থাকে আক্রমণ। দেবেশ রায় লিখলেন(আজকাল, ১৯ মার্চ, ২০১৭), ‘…কয়েকটি মৃতদেহ দরকার ছিল শিল্পায়নবিরোধী সেই রাজনৈতিক কেন্দ্রের। তারা নানা উপায়ে সেই মৃতদেহগুলি জোগাড়ের চেষ্টা করেছে। সিঙ্গুরে একটি মেয়ের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা, নন্দীগ্রামে ধর্ষণ ও হত্যার একটি গল্প, এক বৃদ্ধের স্বাভাবিক মৃত্যু—এইসব চেষ্টা বিফলে গেছে। তারপরই তারা নন্দীগ্রামের মাঠে টেলিভিশন-ক্যামেরাধৃত এতগুলি মৃতদেহ পেয়ে গেলেন! পরমুহূর্তেই তাঁদের ভুলে গিয়ে মৃতদেহগুলিকে রাজনৈতিক দবির ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করলেন।’

আমরা সবিস্ময় দেখলাম, তাঁদের তখন ঘুণাক্ষরেও মনে পড়ল না, চল্লিশের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে কেমন শরিক হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা বুদ্ধদেব বসুর মতো ভিন্ন-মতের লেখকরা। আমরা শুনলাম, যে-বামপন্থীরা একদিন তেভাগা-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, ক্ষমতায় এসে ভূমিসংস্কার করে জমিহীন কৃষককে জমির অধিকার দিয়েছিল, তাদেরই উত্তরাধিকারীরা জমিসৎ্কারের লক্ষ্যে মেধা পাটকরের মতো অহিংস-আন্দোলনকারীকে অবলীলায় ‘বহিরাগত’ বলে চিহ্নিত করল। কৃষকনেতা বিনয় কোঙার নন্দীগ্রামের মহিলাদের উসকানি দিলেন মেধাকে নিতম্ব-প্রদর্শনের, হুমকি দিলেন চারদিক দিয়ে ঘিরে নন্দীগ্রামের মানুষের জীবন নরক করে দেওয়ার। আমাদের মনে পড়ল, ১৯৭৮ সালে হিংস্র ক্যাডাররা মরিচঝাঁপিদ্বীপের শরণার্থীদের সে-ভাবেই পুলিশ ও কর্মীবোঝাই লঞ্চ দিয়ে ঘিরে ফেলে খুন করে লাশ ভাসিয়েছিল মাতলা নদীতে। সে-দিন বৈদ্যুতিন-সংবাদমাধ্যম সক্ষম হয়নি আজকের মতো।

publive-image রোষদগ্ধ সিপিএম পার্টি অফিস, ফোটো- শুভম দত্ত

৪।

১৪ মার্চের গণহত্যায় স্তম্ভিত হল নাগরিকসমাজ। সেই আতঙ্ক কাটতে-না-কাটতেই সিপিয়েম ১০ নভেম্বর ‘নন্দীগ্রামে সূর্যোদয়’-এর নামে ফের গণহত্যায় শামিল হল। দলের বর্ষীয়ান নেতা শ্যামল চক্রবর্তী জানালেন, ‘নন্দীগ্রাম এখন সন্ত্রাসমুক্ত’।  এবার আর পুলিশ নয়, দলীয় হার্মাদদের দিয়েই চলল হত্যালীলা। সেদিন সন্ধ্যায় ‘নন্দন’-এর বাৎ্সরিক চলচ্চিত্রোৎ্সব-বয়কটের ডাকে প্রাঙ্গণমুখী প্রতিবাদী লেখকশিল্পীদের মিছিল রুখে দিল পুলিশ। আমরা বুঝলাম, দেশবিদেশের প্রতিবাদী সিনেমাপ্রতিনিধিদের কাছে রাজ্যের স্বৈরাচারী আচরণ গোপন রাখার দায় ছিল মায়াকোভস্কির সমঝদার বুদ্ধবাবুর। ফলে পুলিশ ‘শালেলোগোকো উঠা লো’ বলে ভ্যানে তুলল লেখক-শিল্পীদের। তাঁদের মুক্ত করতে রাতদুপুরে লালবাজারে গেলেন শঙ্খ ঘোষ-অপর্ণা সেনরা। তবু, শেষরক্ষা হল না। টিভি-তে গণহত্যার ছবি দেখে আর্জেন্তিনার বামপন্থী পরিচালক ফার্নান্দো সোলানাস তৎক্ষণাৎ শহর ছাড়লেন। সিপিয়েম তাঁকে ‘নিজেদের লোক’ ভেবেছিল।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজারে লিখলেন, ‘নন্দীগ্রাম নিয়ে সাহিত্য-শিল্পমহলে অসন্তোষ ধূমায়িত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্‌ যে নিজেও এই নাগরিক-সমাজের মানুষ, তা আমরা জানি ও মানিও। সরকারি আনুকূল্য প্রত্যাখ্যান করে যখন নাট্যকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা সংগঠন ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, তখন তিনি যথার্থই মর্মাহত হন। ফের একটা সমঝোতার চেষ্টাও হয়, কিন্তু সম্পর্কটা আর জোড়া লাগল না, তার দায়ভার তাঁর উপরই বর্তায়।’

জয় গোস্বামী ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ লিখলেন, ‘ওই-যে, লেখক নন, সেই শাসককে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দুপুরের হত্যালীলার পর, ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায়, কী সুন্দর স্মিত-মুখে ভাষণ দিচ্ছেন ফিল্ম উৎসবের মঞ্চে! অজস্র নিরীহ মানুষের রক্তপাত ধীরে-ধীরে বিলীন হয়ে যেতে থাকবে ওই সুগন্ধি সংস্কৃতিচর্চায়?’

অভিনেতা-নাট্যপরিচালক বিভাস চক্রবর্তী লিখলেন, ‘চলচ্চিত্রোৎসব-বয়কট নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মতামত বিভাজিত। কিন্তু, বয়কটিদের আবেগের সততা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষ যখন বুদ্ধিজীবীদের ‘বুদ্ধুজীবী’ বলে গাল পাড়েন, তখন স্তম্ভিত হয়ে যাই। অবাক হয়ে ভাবি, তাহলে তাঁর গায়েও কি বিমানবাবু বা বিনয় কোঙারের ছোঁয়া লাগল?’

নাট্যপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘কেন এই মিছিলকে যেতে দেওয়া হবে না? কোন আইনে? নিরুত্তাপ উত্তর: ‘উপরওয়ালার নির্দেশ’। কোন উপরওয়ালা? নিরুত্তর পুলিশকর্তারা। একধরনের বেকেটীয় স্তব্ধতা নেমে এল। মিছিলে এমন স্তব্ধতা থাকে? যেন উপরওয়ালারা কাফকার ‘কাসল’ উপন্যাসের সেই রহস্যময মাতব্বরেরা, যারা রিজয়ানুর থেকে শিল্পী-সাহিত্যিক সবার উপর নজর রাখেন, দাবি করেন নির্বিরোধ আজ্ঞানুবর্তিতা।’

অভিনেতা-পরিচালক ব্রাত্য বসু লিখলেন, ‘মনে হচ্ছিল এ যেন নন্দীগ্রাম নয়, এ যেন প্রাচীন গ্রিকনগরী থেবাই, যেখানে কিছুদূর অন্তর অন্তর মড়কজনিত মৃতদেহ পড়ে আছে, যে নগরীর চামড়ামাংস ফাটিয়ে ভিতরের কঙ্কালটি একনিমেষে বেরিয়ে এসেছে।’

নাট্যাভিনেতা কৌশিক সেন লিখলেন, ‘ক্রমশ সিভিল-সোসাইটির একটা বড়-অংশ ওপেনলি রি-অ্যাক্ট করছে। সাধারণ মানুষের রাজনীতির রঙের বাইরে গিয়ে এই-যে প্রতিবাদে শামিল হওয়া, এটাই একমাত্র আশার আলো।

চাষিদের বিরুদ্ধে যেমন পুলিশ-ক্যাডার, তেমনই লেখক-শিল্পীদের উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হল সতীর্থদেরই বিদ্রূপবাণ। প্রয়াত মল্লিকা সেনগুপ্ত জয়দেব বসু বা আবুল বাশার নাগরিকসমাজের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। টেলিভিশনে সরকারের পক্ষে গলা ফাটালেন চন্দন সেন (ছোট), বাদশা মৈত্র, অরিন্দম শীলরা। সুবোধ সরকার লিখলেন (আজকাল, ১৭ এপ্রিল), ‘কয়েকজন বুদ্ধিজীবী একটা নর্দমায় নেমে কোমর পর্যন্ত নোংরায় দাঁড়িয়ে নিজেদের দাড়ি ও পাঞ্জাবিতে কাদা লাগিয়ে হাতে করে পুরীষ তুলছেন আর ছুড়ে দিচ্ছেন অন্য বুদ্ধিজীবীদের গায়ে। এই দৃশ্য দেখতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।...আর এক বুদ্ধিজীবী বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দালাল’। কেন তিনি ‘দালাল’ হয়ে গেলেন? কী দোষ করলেন তিনি? একজন সৎ এবং দক্ষ মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করেন, তাই?...পুলিশ গুলি চালিয়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছে, তার দায় ও দুর্ভোগ আমাদের সবার ওপরই এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যাদের কাছে এটা পৌষ মাস, সেই বুদ্ধিজীবীদের আমি বলবো, অস্ত্র থামান, গরীবের জন্য আরো বেশি ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিন, রাস্তা কাটতে বারণ করুন। একজন আপাদমস্তক সৎ মুখ্যমন্ত্রীকে যে ভাষায় গালাগাল করছেন অত খারাপ ভাষা মমতাও ব্যবহার করেন না।’

Khejuri Road block খেজুরিতে তখন রাস্তা বন্ধ ফোটো শুভম দত্ত

৫।

কিন্তু, ইতিহাস চিরকালই উপলব্যাহত নদী। দুঃসময়ই ভয় ভেঙে দেয় মানুষের। তাই নন্দনমুখী ১০ নভেম্বরের সংক্ষিপ্ত ও প্রতিহত মিছিলটি মহামিছিল হয়ে ফিরে এল  ১৪ নভেম্বর। মহানগরের সেই মিছিলে পা মেলালেন বিদ্বজ্জনেরা। মিছিলের পুরোভাগে রইলেন শঙ্খ ঘোষ, তরুণ সান্যাল, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, শাঁওলী মিত্র, ঋতুপর্ণ ঘোষ, জয় গোস্বামী, কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসুরা। তাঁদের অনুসরণ করল শতসহস্র সাধারণজন। কোনও প্রলোভন দেখিয়ে কেউ তাদের জড়ো করেনি। তারা এসেছে বিবেকের ডাকে। শান্তভাবে পা ফেলেছে মৌনমিছিলে। শাসক দেখেছে, নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের নীরবতা ও নৈঃশব্দ্যের শক্তি।

আসলে দেখেনি। দেখলেও, তার নিহিত তাৎ্পর্য্ অনুভব করেনি। করেনি বলেই পরদিন আনুগত্যপরায়ণ বিদ্বজ্জনদের মিছিলে নামিয়েছে তারা। সেই মিছিলে ছিলেন মৃণাল সেন (তিনি ছিলেন আগের মিছিলেও, যেমন গৌতম ঘোষ), তরুণ মজুমদার, সুবোধ সরকার, জয়দেব বসু, চন্দন সেন, মেঘনাদ ভট্টাচার্য্, শুভেন্দু মাইতিরা। সেই মিছিল ছিল প্রদর্শনের, পরাভবের। সামান্য বৃষ্টিতেই তা ছত্রখান হয়ে গেল।

৬।

তারপর দশ বছর কেটে গেল। পরিবর্তনেরও সাত-বছর। আপাতত সব শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে। নন্দীগ্রামের অভিযুক্তরা কেউ সাজা পাননি। পরিবর্তনপন্থী কবি-শিল্পী-সাংবাদিকরা অনেকেই বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী হয়েছেন, বা কমিটিপ্রধান। কেউ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, কেউ গেছেন জেলেও। তৈরি হয়েছে ক্ষমতার নতুন অলিন্দ, দুর্গ। সেই অলিন্দে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন অতীতের অনেক বামপন্থী গায়ক লেখক সিনেমাকার নাট্যকার কবিও, পদ ও পুরস্কার পেয়েছেন। নন্দীগ্রামের সময় ‘পঞ্চম বৈদিক’ মঞ্চস্থ করেছিল জর্জ অরওয়েলের ‘পশুখামার’ উপন্যাসটি। ক্ষমতাচক্রের সেই নাটকটির অভিনয়ে বাধা দিয়েছিল সে-দিনের শাসকদল। কেননা, সেই নাটক ছিল তাদেরই্ অবিকল প্রতিভাস। আজ আর সেই নাটক অভিনীত হয় না। কেননা, আজও তার অভিঘাত একইরকম সাংঘাতিক হতে পারে পরিবর্তিত শাসকদলের বিরুদ্ধে।

----------------------

তথ্যসূত্র : নন্দীগ্রাম। সম্পাদনা অশোক দাশগুপ্ত। শাসকের প্রতি। জয় গোস্বামী। দুঃসময়। সম্পাদনা ব্রাত্য বসু গৌতম ঘোষদস্তিদার।

(এ নিবন্ধের মতামত লেখকের ব্যক্তিগতঃ আইই বাংলা)

nandigram Intellectuals
Advertisment