Advertisment

মোদী বনাম ট্রাম্প, না মোদীর পাশে ট্রাম্প?

মোদী জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের শত্রুতাও কাম্য নয়, আবার বন্ধুত্বের নামে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করে হামাগুড়ি দেওয়াটাও সফল কূটনীতির নমুনা হতে পারে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর মুখোমুখি বৈঠকের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করতে মার্কিন বিদেশ সচিব মাইক পম্পেও আগাম ভারতে এসেছিলেন। ট্রাম্প তাকে পাঠিয়েছিলেন দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের আলোচ্য সূচি ঠিক করার জন্য। আপাতভাবে বিষয়টি খুবই নিরীহ। ২৮ জুন জাপানে জি-২০ সম্মেলনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে, এমনটা আগে থাকতেই ঠিক ছিল। কিন্তু বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গেও মার্কিনী বিদেশ সচিব আগাম বৈঠক করেন মূলত নিজেদের তাগিদে। ট্রাম্প মোদীর দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে টুইট করে বিবৃতি দিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য, মার্কিন বাণিজ্য পণ্যের উপর থেকে ভারতীয় শুল্ক প্রত্যাহার করা। ট্রাম্প প্রথম থেকেই হুমকি দিচ্ছেন, ঔষধ, গাড়ি, খেলনা, এসব পণ্যে ভারত বিপুল কর বসিয়েছে, এই কর কমাতেই হবে।

Advertisment

ভারত-মার্কিন বাণিজ্য বেড়ে ২০১৮ সালে ১৪২.১ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। কিন্তু এই বাণিজ্যের পরিমাণ এখন কমে গেছে। ২৪.২ বিলিয়ন ডলার বানিজ্য ঘাটতি হয়েছে। মার্কিন বিরোধিতার ফলে ভারতীয় রফতানিও ধাক্কা খেয়েছে শতকরা ১২ ভাগ। ভারতে যেসব মার্কিন পণ্য আসছে, তাদের মধ্যে ২৯ টির ক্ষেত্রে ভারত শুল্ক বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ।
এবার ট্রাম্প ভারতকে এ ব্যাপারে হুমকি দিলেও মোদী কিন্তু কিছুতেই আত্মসমর্পনের কূটনীতিতে যেতে রাজি হননি। এমনকি রাশিয়ার কাছ থেকে S-800 TRIUMF মিসাইল সিস্টেম ভারত কিনছে বলে হুঙ্কার ছেড়েছেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালে ৩৭,৩৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত এই মিসাইল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০ সালে থেকে এই মিসাইলগুলি ভারত পাবে।

আরও পড়ুন: নেহরুবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন রণকৌশল মোদীর

আমেরিকার স্যাংশন অ্যাক্ট অনুসারে মার্কিন কর্তারা এই প্রতিরক্ষা চুক্তির বিরোধিতা করছেন। মার্কিন আইন অনুসারে যারাই রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। আবার ক্ষিপ্ত মার্কিন কর্তারা ভারতীয়দের জন্য এইচ ওয়ান ভিসা পাওয়ার সুযোগকে আরও কঠিন করে দিয়েছেন। ভিসার খরচও প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে নানা শর্তে জর্জরিত ভারতীয় ছাত্র ও মূলত তথ্য প্রযুক্তির কর্মীরা খুবই সমস্যায় পড়েছেন। এমনকি গ্রিন কার্ড পেতে পারেন, এমন ভারতীয়দের স্ত্রী বা স্বামীর যে স্বতঃস্ফুর্ত ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার সুযোগ ২০১৩ সালে বারাক ওবামা করেছিলেন, তাও ট্রাম্প বন্ধ করে দিয়েছেন। এবার তাই মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের দিকে তাকিয়েছিল গোটা দেশ।

তার ওপর আছে ইরান নিয়ে ঝামেলা। ২০১৮ সালের আগস্ট মসে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর নতুন করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মার্কিন কর্তারা চান, ভারতও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করুক। ভারত কিন্তু মার্কিন হুমকিকে পাত্তা দেয় নি। কারণ প্রতিপক্ষে ভারত যে তেল আমদানি করে নানা দেশ থেকে, তার শতকরা ১০ ভাগ এখনও ইরান থেকে আসে। দ্বিতীয়ত, ইরান হলো পাকিস্তানের প্রতিবেশী। এই প্রতিবেশীর প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে চটানো ভারতের চূড়ান্ত ভুল কূটনীতি। তাই ভারত-ইরান নীতিতে মোদী জমানাতেও বদল হয় নি। যেমন বদল করেন নি অটল বিহারী বাজপেয়ীও। ভারতের পরিস্থিতি বুঝে এবছর মে মাস পর্যন্ত ভারত সম্পর্কে মার্কিন কর্তারাও ইরান ইস্যুতে ছাড় দেন। এখন দেখার, এবার তাঁরা কী করেন।

আবার নিজেদের ‘স্বার্থে’ ট্রাম্প আফগানিস্তানে তালিবানদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছেন। ভারতের জন্য তালিবানদের সঙ্গে শান্তি সমঝোতা মোটেই খুব আনন্দের সংবাদ নয়।
মোদী কিন্তু এবার চোখে চোখ রেখে কূটনীতি করেছেন। মনে হচ্ছে বিদেশ নীতিতেও যে কোন রাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করে, তার পিছনেও থাকে দেশের ভিতর গণতন্ত্রের শক্তি। যে বিপুল ভোটে নরেন্দ্র মোদী জিতেছেন, তার সংখ্যার যে শক্তি, তাতে স্বদেশে রাজা বিশেষভাবে মদত পাচ্ছেন। এই দেশের ভিতরকার শক্তিই মোদীকে ট্রাম্পের মত এক বিশ্বনেতার সঙ্গে লড়াই করার শক্তি দিচ্ছে। তিনি দর কষাকষি করতে সক্ষম হচ্ছেন। সরকার যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়, দুর্বল হয়, জোড়াতালি জোট সরকার হয়, তবে সে সরকারের আন্তর্জাতিক ভূমিকাও দুর্বল হতে বাধ্য।

আরও পড়ুন: চিকিৎসার চেয়েও বড় সমস্যা যখন রাজনীতি

অবশ্য ট্রাম্পের বিদেশ নীতিও বড় অভিনব। বোঝা কঠিনও। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন, কানাডার মত প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া। মেক্সিকোর মত দেশের সঙ্গেও তো ঝামেলা। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ধারাবাহিক ভাবে ভালই হয়েছে। ২০০৮ সালে জর্জ বুশ এবং পরে ওবামা ভারতের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি চূড়ান্ত করেন। তারপর তো দুদেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।

ট্রাম্প আসার পর এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় কালো মেঘ দেখা যায়। কারন ট্রাম্প তো নিজেই এক অভূতপূর্ব চরিত্র। ট্রাম্প অনেক সময় দুদেশের সম্পর্কের বৃহৎ প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক ছোট ছোট ব্যাপারে বোঝাপড়া করে ফেলেন। এখন যদি ট্রাম্প মোদীকে বলেন মাসুদ আজহার, যিনি জইশ-এ-মহম্মদের প্রধান, তাঁকে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী ঘোষনা করে দিলে তার বদলে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুক ভারত, তাকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষনা করুক, ভারতের পক্ষে কিন্তু কাজটা সহজে হবে না।
এখানেই মোদীকে কূটনৈতিক মুনশিয়ানা দেখাতে হবে। এখনও পর্যন্ত মোদী এবং জয়শঙ্কর জুটি একাজে সফল হয়েছেন। মোদী জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের শত্রুতাও কাম্য নয়, আবার বন্ধুত্বের নামে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করে হামাগুড়ি দেওয়াটাও সফল কূটনীতির নমুনা হতে পারে না।

তাই দুপক্ষই সুসম্পর্ক চাইছে, আবার মোদী এবং ট্রাম্প দুপক্ষই স্নায়ুর যুদ্ধ চালাচ্ছেন কূটনৈতিক দরকষাকষির ক্ষেত্রে। মার্কিন বিদেশ সচিব পম্পেও দিল্লি এসে বলে গেলেন, এবার মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানাবেন এবং ট্রাম্প তারপর খুব শীঘ্রই দিল্লি আসবেন। বোঝা যাচ্ছে, মোদীর কূটনীতির চাপে ট্রাম্পও জমি ছাড়ার কৌশল নিচ্ছেন। শেষ হাসিটা কে হাসবেন দেখা যাক। আমরা তো চাইব ভারতই জয়যুক্ত হোক।

আসলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন। এই ভোটে ট্রাম্প আর একবার নির্বাচিত হতে চাইবেন, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? নির্বাচনের জন্য তিনি এখন আরও বেশি রক্ষণশীল, আরও বেশি স্বদেশী, এবং আরও বেশি আক্রমণাত্মক হচ্ছেন। আশা করা যায় আরও হবেন। অতএব ভারতকে বুঝতে হবে এই সময়ের বাধ্যবাধকতা। এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে ভারতের বিদেশ নীতির জন্য যা যা প্রাপ্তি সম্ভব, তা পাওয়ার চেষ্টা করা।

আরও পড়ুন: বাঙালির ‘বিজেপি প্রীতি’ কতদূর যাবে?

বিদেশ নীতির প্রাথমিক পাঠ হল, প্রত্যেক সার্বভৌম রাষ্ট্রের কিছু প্রত্যাশা থাকে, যাকে বলা হয় 'desire', এবং সেই প্রত্যাশার মধ্যে কতটুকু প্রাপ্তি সম্ভব, সেটার বাস্তব মূল্যায়ণ প্রয়োজন। একে বলা হয় 'effective desire' বা কার্যকরী প্রত্যাশা। এখন ভারতের এমনটা আশা করা উচিত নয় যে মোদীর সমস্ত দাবি ট্রাম্প মেনে নেবেন। অথবা ট্রাম্পের যাবতীয় প্রত্যাশা ভারত মেনে নেবে। এই মৌলিক চাহিদা এবং কার্যকরী চাহিদার মধ্যে সব সময়েই ফারাক থাকে। স্ববিরোধী দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের চাহিদার মধ্যে সংঘাত আছেই। এই সংঘাত সমূহের ভিতর থেকেই প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত হয়।

জাপানে জি-২০ সম্মেলনের পাশাপাশি মোদী এবং ট্রাম্পের বৈঠককে আপাতত দুপক্ষই ফলপ্রসূ বলে মনে করছে। বলা হয়েছে, এই বৈঠক productive এবং pragamtic. ২০১৭-র পরেই প্রথম দুই নেতা মুখোমুখি বসে দুদেশের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেন। প্রথমত, ট্রাম্প বৈঠকের আগেও টুইটকরে গরম গরম বক্তব্য পেশ করেন। বলেছিলেন, মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করতেই হবে ভারতকে, কিন্তু যখন দুপক্ষের আলোচনা শুরু হয়, তখন কিন্তু ট্রাম্প সেই দাবি উত্থাপন করেন নি। আবার মোদী নিজেই তাঁর বক্তব্যে জানান যে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ককে তিনি পর্যালোচনা করতে প্রস্তুত।

আজ পৃথিবীর কূটনৈতিক মানচিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য  বদল হলো এই যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় অতিবাহিত এখন এ পৃথিবী বহুকেন্দ্রিক (polycentric)। পৃথিবীর সমস্ত দেশই আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। আর্থিক মন্দার চোটে গোটা ইউরোপের শোচনীয় হাল। ব্রিটিশরা একদিন ভারত শাসন করেছে, কিন্তু আজ সেই লন্ডনের কী অবস্থা ভাবুন। এই পরিস্থিতিতে সমগ্র পৃথিবীর প্রায় সকল সার্বভৌম রাষ্ট্রই বেশি বেশি করে protectionist হয়ে উঠছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী স্বদেশি রক্ষণশীলতা বাড়ছে। কিন্তু এই মানসিকতায় সংঘাত বাড়বে। অসহিষ্ণুতা বাড়বে। তাই এখন উচিত পারস্পরিক আলোচনা। চাই ঐক্যবদ্ধ ভাবে বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে এগোনো।

Donald Trump narendra modi
Advertisment