তখন সবে দিল্লি এসেছি। সংসদে বাজেটের দিন দেখলাম - সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। সংসদের গেটের বাইরে বিভিন্ন শিল্পপতি - কর্পোরেট গোষ্ঠীর চাপরাশি থেকে অফিসাররা দন্ডায়মান। প্রতীক্ষারত এই প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্য একটাই। বাজেটটা সন্ধ্যায় সংসদের টেবিলে অর্থমন্ত্রী পেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে যাতে তাঁরাও বাইরে দাঁড়িয়েই কোনও সরকারি সূত্রেও একটা অন্তত কপি পেয়ে যান। এমন কী, তাঁরা অনেক চড়া দামে বাজেটের ওই কপিগুলো কিনেও নিতেন। তারপর কপিগুলো বিমানে চলে যেত মুম্বই।
আসলে তখন ছিল লাইসেন্স পারমিটের যুগ। শতকরা একভাগ বাণিজ্য শুল্কও যদি আমদানি-রফতানিতে কমে যায়, আর তা যদি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলি আগাম জেনে যায়, তবে কত কাণ্ডই না হয়ে যেত! মুম্বইয়ের স্টক মার্কেটে এসব সিদ্ধান্তের কত না প্রভাব পড়ত!
সময় এখন কত বদলে গিয়েছে। নরসিমহা রাওয়ের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং বাজেট পাশের গতানুগতিক সময়টা না বদলালেও দেশের আর্থিক সংস্কারে এক নতুন দিগন্ত এনেছিলেন। আবার, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে বাজেট নিয়ে রহস্যময়তা অবসান ঘটেছিল। কেন আগে সন্ধ্যায় বাজেট পেশ হতো জানেন তো? লন্ডনের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই দেশে ব্রিটিশরা বাজেট পেশ করতেন ভারতীয় সময়ানুসারে সন্ধ্যায়। কারণ, লন্ডনের স্টক এক্সচেঞ্জ না খুললে ভারতের বাজেটও পেশ হতো না। এর ফলে, পরবর্তীতে ভারতের সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার, খুব অসুবিধা হতো। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি সকালে বাজেট পেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আরও পড়ুন: আর্থিক সমীক্ষা এবং বাজেটে দু’রকমের আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস কেন?
ভারত নামের এই দেশটির বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে মধ্যবিত্ত মেট্রোপলিটন মন ও সমাজ এক মস্ত বড় জায়গা জুড়ে আছে। বিরাট অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জুড়ে থাকা মধ্যবিত্ত জনসমাজ, বলা বাহুল্য, একদিনে তৈরি হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পর যখন জাতীয় বুর্জোয়া সম্প্রদায় দ্রুত বিকশিত হতে থাকে, তখন এই মধ্যম বর্গের অস্তিত্ব ছিল টিমটিমে আলোর মতো। আটের দশকের পর থেকে মধ্যবিত্ত সমাজ তুলনায় দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। নরসিমহা রাওয়ের জমানায় আর্থিক উদারীকরণের সুবাদে মধ্যবিত্ত সমাজ প্রায় ২৫ কোটি-তে পৌঁছয়।
ইতোমধ্যে সারা পৃথিবী জুড়ে মধ্যবিত্ত সমাজের বৃদ্ধি ঘটেছে। সেই বৃদ্ধির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতেও আজ মধ্যবিত্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাল্লা দিয়ে আর্থিক অ-সাম্যও বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে। যেটা ছিল ‘ধনী-তন্ত্র’, সেটাকে এখন বলা যেতে পারে ‘প্লুটোক্রেসি’, বাংলায় ‘কুবের তন্ত্র’। গরিব, আরও গরিব হয়েছে। আবার বহু ধনী, নিম্নমুখী সামাজিক সচলতার কারণে, একটু নিচে নেমে, মধ্যবিত্ত হয়েছে। গরিবও, ঊর্ধ্বমুখী সামাজিক সচলতায়, আরেকটু উঠে, মধ্যবিত্ত হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদীর বাজেটে কেন সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাবে মধ্যবিত্ত, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আজ যে কোনও নির্বাচনে মধ্যবিত্ত ভোটই 'নির্ধারক শক্তি' বা 'ডিটারমিনিং ফ্যাক্টর'। নগরায়ন বেড়েছে, বাড়ছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসেছে, আরও আসছে। সেই যে 'গণদেবতা'-র অনিরুদ্ধ কর্মকার শহরে এসে চাকরি খুঁজেছিল, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। গ্রামে প্রবল দারিদ্র থাবা মেরেছে। এদিকে, শহরের বস্তিতে দেখা যাচ্ছে ডিশ অ্যান্টেনার টুকি। সব মিলিয়ে, অর্থনীতির এ এক অদ্ভুত ধাঁধা! শহরে চাপ বাড়লে বাড়ি বানাতে হয়। দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার বড় অংশ সম্প্রসারিত হতে হতে 'গ্রেটার কলকাতা' হয়ে ওঠে। কোনা গ্রাম পঞ্চায়েত হঠাৎ একদিন হাওড়া পৌরসভার অংশ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: বাজেট ২০২০: শেষমেশ মধ্যবিত্তের হাতে রইল সেই পেনসিল
কিন্তু এতদসত্ত্বেও এটা মানতে হবে, সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে না। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সংগঠিত ক্ষেত্রের কোনও ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন, ডিমনিটাইজেশন ও জিএসটির জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারেননি। সাদা-কালো মেশানো অর্থের স্রোতে লাগাম পড়েছে। তৈরি হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চাপ। কেনাকাটার নাম শুনলে এখন সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। সত্যি কথা বলছি, দিল্লির খান মার্কেটের একটা বইয়ের দোকানে একসময় কফি খেতে আমি খুব ভালবাসতাম। আগে, কফির জন্য যদি দিতে হত ১০০ টাকা, এখন দিতে হয় ২০০ টাকা। কারণ, জিএসটি ও সার্ভিস ট্যাক্স। ফলে, আমার সেই শখে এখন লাগাম পড়েছে। ক্যাফে থেকে ধাবায় শিফট করেছি। কফি নয়, এখন চা খাচ্ছি।
এবারের বাজেটে নরেন্দ্র মোদী তাই নানারকম কর ছাড় দিয়ে মধ্যবিত্তের মন জয় করতে চেয়েছেন। চেষ্টা করেছেন মধ্যবিত্তের সেই মনস্তাত্ত্বিক চাপটাকে, যা কেনাকাটা করার প্রশ্নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, ভেঙে দেওয়ার। মানুষ যে কেনাকাটা করে, তার প্রাথমিক কারণ তো এক ধরনের ইচ্ছা বা ‘অ্যাসপিরেশন’। সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে ফলবতী করার জন্যই আর একদফা সদিচ্ছা-র দরকার হয়। অর্থনীতির ভাষায় একেই বলে 'উপভোক্তার সদিচ্ছা'। একজন গ্রামের মেয়ে বিজ্ঞাপনী বাহারে মুগ্ধ হয়ে ল্যাকমে-র লিপস্টিক কেনার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। মফঃস্বলের বাজার থেকে নতুন জিন্স কিনতে চাইতে পারে। অ্যাসপিরেশন না থাকলে এটা সম্ভব হবে না।
বাজার থেকে গায়েব হতে চলা সেই ‘অ্যাসপিরেশন’-কে এই বাজেটে মোদী ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। হা-হুতাশ ওঠা বাজারে মধ্যবিত্তকে কিছু 'ফিল গুড' সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে চেয়েছেন। চেয়েছেন ঝিমুনি-লাগা বাজারকে তেজি করতে। তাই বেসরকারিকরণ ও 'পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেল' গুরুত্ব পেয়েছে। একদিকে, মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উৎসাহিত করা। অন্যদিকে, গ্রামীণ ভারতকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখাতে চাওয়া যে, ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এখনও গ্রামীণ সমাজ। তেলা মাথায় তেল দেওয়া তো আমাদের পুরনো ব্যাধি। তাই 'লাটইয়েনস' (Lutyens) দিল্লির রাস্তায় সামান্য একটা গর্ত হলেই পূর্ত বিভাগ নিমেষে তা মেরামত করে ফেলে। আর গ্রামীণ ভারতে জাতীয় সড়ক বলে যা পরিচিত, তা দরিদ্র জননীর শতচ্ছিন্ন চাদরের মতোই অবহেলিত।
আরও পড়ুন: বাজেট ২০২০: তীব্র মন্দার বাজারে জনসম্পদ নিয়ে জুয়াখেলা
এটা কিন্তু রাজনীতি বা দলের ব্যাপার নয়। এটা দলমত নির্বিশেষ বিচ্যুত অগ্রাধিকার। লালুপ্রসাদ যাদবও একদা বলেছিলেন, পাটনার রাস্তা হেমা মালিনীর গালের মতো করে দেবেন। আমি ক’দিন আগে পাটনা থেকে নালন্দা গেলাম। লালুপ্রসাদের সেই ঘোষণার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির আসমান-জমিন ফারাকও টের পেলাম। দিল্লিতে এককাপ চা খেতে গেলে ১০ থেকে ১৫ টাকা খরচ হয়। কলকাতার যশোর রোডে কিন্তু এখনও ৪ টাকায় কাচের গ্লাসে চা পাওয়া যায়। কাচের গ্লাস কেন? তাতে সস্তা হয়। প্লাস্টিক বা ভাঁড় ব্যবহার করলে দাম বাড়ে। তাই দোকানি সটান বলে দিলেন, এক কাপ চায়ের জন্য ৫ টাকা বা তার বেশি দেওয়ার ক্ষমতা বা সদিচ্ছা, কোনওটাই মানুষের নেই।
এই যে দিল্লি থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে মফঃস্বল, মফঃস্বল থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম - এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিরাজিত আর্থিক অসাম্য কি গ্রামীণ উন্নয়নের বাজেট ঘোষণার ফলে সত্যি সত্যিই ঘুচবে? বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ বাজেটের সমালোচনা করে বলেছেন, মোদী মধ্যবিত্তকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ভালো কথা, কিন্তু যে রোগী ক্যানসারের চতুর্থ স্টেজে, তাকে কিডনি ভাল করার ওষুধ বা ফুসফুস চাঙ্গা করার পথ্য বাতলে দিলে কি দুরারোগ্য ব্যাধি সারবে?
এতে সাময়িক রেহাই হয়তো মিলবে, এমনকী ভোট-নির্ভর ভারতীয় মধ্যবিত্ত জনসমাজের চেতনায় হয়তো একটা 'ফিল গুড' মূর্ছনাও হতে পারে - কিন্তু সেই দ্যোতনা তো কোনও বাস্তব সমাধান নয়! আমি অর্থনীতিবিদ নই। তবে একটা কথা মনে হয় যে, এই প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে ‘বাজার’-কে ‘সক্রিয়’ করার যে ব্যবস্থা নির্মলা সীতারমণ করলেন, সেটা ছাড়া আরও কোন রকেট সায়েন্সের ফলিত প্রয়োগ আশা করা যেতে পারত?