Advertisment

এই বাজেটে মোদীর লক্ষ্য আমজনতা, সংস্কার নয়

মোদী বিপুল ভোটে জেতার পর সংস্কারের পথে যেতে চান না। তিনি ব্রিটেনের 'আয়রন লেডি' মার্গারেট থ্যাচারের মত সংস্কারপন্থী হতে চান না। ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়ে শুধু বৃদ্ধিমুখী বাজেট মোদী করতে চান নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
budget 2019 narendra modi

বাজেট পেশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফোন এক সাংবাদিক বন্ধুর।

Advertisment

"শুনলে ভারতের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা?"

"শুনলাম।"

"কিন্তু কেমন যেন একটা নিরামিষ বাজেট। কোন সাংঘাতিক ধামাকা কিছু নেই। কেমন একটা ম্যাড়ম্যাড়ে, বিবর্ণ। ইতিমধ্যেই স্টক মার্কেটে আজ বাজেট দেখে ধ্বস নেমেছে। রিয়েল এস্টেটে সার্বিকভাবে বাজারে উত্তেজনা কোথায়?"

বুঝলাম বন্ধুবর খুব হতাশ। তাকে বললাম, "আসলে আমরা সাধারন মানুষ, আমজনতাও বোধহয় সবসময় চাই একটা ড্রামা, নাটক। হিন্দিতে বলে 'সনসনি'। আর এখনকার মিডিয়ার যুগে এই নাটুকেপনা বোধহয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। দর্শক ও পাঠকদের অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরণ হওয়া বিশেষ জরুরি। আমার মনে হয়, আসলে মোদীর এই দ্বিতীয় ইনিংস, যাকে বলা হচ্ছে মোদী ২.০, তাতে কিন্তু বলা হচ্ছে এবারের বাজেট হলো গত পাঁচ বছরের সরকারের আর্থিক কর্মসূচির রূপায়নের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের এক পথনির্দেশিকা।"

আরও পড়ুন: মোদী বনাম ট্রাম্প, না মোদীর পাশে ট্রাম্প?

বাজেট কী? বাজেট মানে আসলে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসেব। আর তার পাশাপাশি সরকার তার অগ্রাধিকারও নির্ধারণ করে। মোদী ঘনিষ্ঠমহলে তাঁর বিরাট বিজয়ের পর বলেছেন, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী এবং অখিলেশ মহাগঠবন্ধন করলেও জাতপাতের সমীকরণকে অনেকটাই ভেস্তে দিয়ে বিজেপি সে রাজ্যেও ভালো ফল করেছে। এর কারণ হলো, ঘরে ঘরে শৌচাগার হয়েছে। গরিব মানুষদের কাছে গ্যাসের সংযোগ হয়েছে। কৃষকেরা ঋণ পেয়েছেন। গ্রামে পাকা সড়ক হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, এই প্রকল্পগুলির সুবিধা যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা মোদীর ভোটার হয়েছেন, বাকি সব সমস্যা ভুলে। মোদী বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে প্রকল্পগুলির রূপায়ন করতে হবে এবং সক্রিয়তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাতে পরবর্তী লোকসভা ভোট জাতপাতের ভিত্তিতে নয়, ভোট হবে সম্পূর্ণ উন্নয়নের ভিত্তিতে।

তবে মোদীর এই বাজেট দেখে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সেটা হলো, ২০১৯-২০ সালের মোদীর বাজেট দর্শনে অগ্রাধিকার হলো আমজনতার। মোদী বিপুল ভোটে জেতার পর সংস্কারের পথে যেতে চান না। তিনি ব্রিটেনের 'আয়রন লেডি' মার্গারেট থ্যাচারের মত সংস্কারপন্থী হতে চান না। ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়ে শুধু বৃদ্ধিমুখী বাজেট মোদী করতে চান নি। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও বিরোধী দল অভিযোগ করেছিল যে মোদী সরকার 'স্যুট-বুটের' সরকার, গরিবের সরকার নয়। কিন্তু আজ এত ভোটে জেতার পরেও কোনোরকম ঝুঁকি নেন নি মোদী।

তিনি গ্রাম ও গরিব, কৃষক ও মধ্যবিত্তের সরকারকেই বাজেটে তুলে ধরেছেন। আসলে মোদী গুজরাটের শাসন ছেড়ে দিল্লির সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে এসে বুঝেছেন যে ভারতের মতো বিশাল দেশে সরকারের স্টিমরোলার চালাতে গেলে শিল্পপতিরা খুশি হতে পারেন, শেয়ার মার্কেটে তার প্রভাব সাংঘাতিক এগোতে পারে, কিন্তু সরকারের জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেতে বাধ্য। ভারতের শাসকদল যেই হোক, ভারতীয় গণতন্ত্রে এক ধরনের মিশ্র অর্থনীতির কাঠামো আছে। তাই জনমুখী বাজেট করার প্রয়োজন তো আছেই।

আরও পড়ুন: নেহরুবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন রণকৌশল মোদীর

সোনিয়া গান্ধী ইউপিএ জমানায় গরিব মানুষদের জন্য যেসব সামাজিক প্রকল্প চালু করেছিলেন, অনেকে ভেবেছিলেন, সংস্কারবাদী অর্থনীতিবীদ জগদীশ ভগবতী এবং অরবিন্দ পানাগড়িয়ার প্রভাবেই মোদী হয়তো সেসব প্রকল্প বাতিল করে দেবেন। মোদী কিন্তু তা করেন নি। বরং আরো আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রকল্পগুলিকে নতুন রূপ দিয়েছেন। কৃষকদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক করার চেষ্টা করছেন। ছোট ছোট দোকানদারদের সরকার সাড়ে তিনশো কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। আবার গ্রামের গরিব কৃষকদের জন্য তিনি একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেন, যেমন করেছেন মহিলাদের জন্য।

এবার ভোটে জেতার পর সংসদের সেন্ট্রাল হলে মোদীকে যখন নেতা নির্বাচিত করা হয়, তখন তিনি তাঁর বক্তৃতায় একটা কথা বলেছিলেন যা বিশেষভাবে আমার মনে আছে। তিনি বলেন, "বহু বছর ধরে আমাদের দেশে দারিদ্র মোচনের কথা বলাটা দেশের নেতাদের একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ফ্যাশন নয়, স্লোগান নয়, নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে এই দারিদ্র দূরীকরণের চেষ্টা করছি।" আসলে মোদী ইন্দিরা গান্ধীর 'গরিবি হটাও' এবং কমিউনিস্টদের সর্বহারাদের জন্য অশ্রুপাতকেই ভারতের আজকের জনসমাজকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

আজ গোটা পৃথিবীতে আর্থিক মন্দা চলছে। কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, এবং মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা সর্বত্র। খোদ ব্রিটেনের অবস্থাই শোচনীয়। ইউরোপ তো বটেই, এমনকি আমেরিকাও নানা সমস্যায় আক্রান্ত। আজ ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এতো রক্ষণশীল, এবং উদ্বাস্তু-বিরোধী স্বদেশী লাইনে এত আক্রমনাত্মক, তার পিছনেও আছে এই সমস্যাই। আর ভারতের মতো দেশে তো প্রধান সমস্যাই হলো আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য। আয় বণ্টনে বৈষম্য আছে। জমির মালিকানা বণ্টনে বৈষম্য আছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে মূলধন বন্টনেও বৈষম্য আছে।

আরও পড়ুন: এক দেশ এক নেতা এক আদর্শ এক ধর্ম এক শ্লোগান: এই কি ভবিতব্য?

এই বাজেটকে কেউ কেউ ঠাট্টা করে 'রবিনহুড বাজেট' বলছেন। বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মোদী গরিবদের আয় বাড়াতে চাইছেন, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু এভাবে বলাটা অতি সরলীকরণ। আসলে অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ বলে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নাও হতে পারে, যদি দেশে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। যোজনা কমিশনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় দেখা যায়, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান সে অনুপাতে বৃদ্ধি পায় নি। ভারতের আয় বণ্টনের এই বৈষম্য অনুসন্ধান করার জন্য অধ্যাপক মহলানবীশ এর নেতৃত্বে একটি কমিটি ১৯৬০ সালে গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে কমিটি প্রতিবেদন পেশ করে। এই কমিটির রিপোর্ট থেকে ভারতের আয় বৈষম্যের চিত্র পাওয়া যায়। আজ এত বছর পরও ভারতের দারিদ্র সমস্যার সমাধান হলো না।

এবারের বাজেটে মোদী তাই আর্থিক সংকট মোচনের রাস্তা খুঁজেছেন। প্রথম আর্থিক ঘাটতি দূর করা, দ্বিতীয়ত বাজারে consumption বা ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো, তৃতীয়তঃ বাজার সচল রাখা, তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। আর তাই রাষ্ট্রীয় ও রুগ্ন কলকারখানার জমি বিক্রি করা, রেলের ক্ষেত্রে আংশিক বেসরকারিকরণ, এসবই সরকারের বিশেষ লক্ষ্য। সরকার ও বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের পিপিপি মডেলকেও আবার এই সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একথা বলাই যায়, এবারের বাজেট নিশ্চয়ই সর্বরোগহরা বটিকা নয়, কিন্তু মোদীর ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য নিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ নেই।

narendra modi Union Budget 2024
Advertisment