প্রথমে লোকসভায়, পরে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এন এম সি) বিল ২০১৯। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী বিল, ইউ এ পি এ সংশোধনী বিল ইত্যাদি "বড় বড়" রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ বিলের ভিড়ে অপেক্ষাকৃত কম বাধায় সংসদের দুই কক্ষে পাশ করিয়ে নেওয়া হল এই বিল। চিকিৎসক সমাজের বাইরে সাধারণ মানুষ বিশেষ খবর রাখলেন না এই বিল পাশের ব্যাপারে, তেমন আলোচনাও হল না। দোষ দেওয়া চলে না, কারণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে কাশ্মীরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করার পিছনের রহস্যটা কী, তা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি করে মানুষকে ভাবাবে। ইউ এ পি এ-র নব অবতারে কেন্দ্রীয় শাসক দলের স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে কথা বলার পরদিন আপনাকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার করার বন্দোবস্ত রয়েছে জানার পর আর এন এম সি বিল নিয়ে ভাবার মানসিকতা থাকে না প্রায় কারোরই। তবু কথা বলতে হবে, কারণ এই বিল জনজীবনকে অন্য আইনগুলোর তুলনায় কম প্রভাবিত করবে না।
ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষা এবং পরিষেবার মান নিয়ন্ত্রণ এতদিন হত ১৯৫৬ সালের আইন মোতাবেক গঠিত মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার (এম সি আই) দ্বারা। এই বিল এমসিআইকে ইতিহাসে পরিণত করতে চলেছে। এম সি আই সংস্থাটি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না। তাদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে কিছু ত্রুটি ছিল এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মতোই ছিল বেশ কিছু অনৈতিকতাও। কিছু অধিকর্তার দুর্নীতি অতীতে সংস্থাটির মুখ পুড়িয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের তরফেও প্রতিবাদ হয়েছে। কেতন দেশাইয়ের মতো সর্বোচ্চ পদাধিকারী কর্তা আর্থিক ও প্রক্রিয়াগত অনিয়মের জন্য হাজতবাসও করেছেন। নিঃসন্দেহে সংস্থাটির সংস্কার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়ত ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের গড়ে দেওয়া একটি বোর্ড মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাজ সামলাচ্ছিল। এবার এই বিল সংস্থাটির পুনরুজ্জীবিত হবার সম্ভাবনায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিল।
আরও পড়ুন, গণপ্রহার: আদৌ ওষুধ আছে এই সামাজিক রোগের?
অবক্ষয়ের শিকার হয়ে যাওয়া একটি সংস্থার পরিবর্তে ভিন্ন মডেলে নতুন সংস্থা গড়ার উদ্যোগকে বিনা বিচারে অসাধু বলে দেওয়া অন্যায়। তাই মুক্ত মনেই বিলটিকে আমরা দেখেছি৷ বিলটি বেশ কিছু গালভরা কথা বলেছে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (উপযুক্ত পরিকল্পনা বা পপদ্ধতিগত রূপরেখা ছাড়াই) এবং কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে, যা লক্ষণীয়, কিন্তু একইসঙ্গে বিলটির মধ্যে এমন কিছু গলদ এবং প্রবণতা চোখে পড়েছে, যা গুরুতর দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে।
গণতন্ত্র কতটা স্থান পাবে, সেই বিষয়ে বিল প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গী স্ববিরোধী। এমসিআই ছিল মূলত চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত, তাই স্বজনপোষণের সম্ভাবনা ছিল। নতুন কমিশনে যথেষ্ট সংখ্যায় অচিকিৎসক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে এবং তাঁদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা তুলে দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে যে এনএমসি কোনোমতেই চিকিৎসকদের স্বার্থ দেখবে না, রোগীর স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে। একে অবশ্যই "ইনক্লুসিভ" এবং গণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে। এতে খুশি হওয়া যেত যদি বাস্তবে বিলটি গণতান্ত্রিক আদর্শে রচিত হত। দুর্ভাগ্যক্রম্র বিলটিতে গণতন্ত্র, সংবিধান এবং ভারতের ফেডেরাল গঠনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা খুব কম। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আশঙ্কাজনক।
সাবেক মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াতে সব রাজ্যের মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে প্রতিনিধি থাকতেন। নতুন কমিশনে সেই সুযোগ থাকছে না। নির্বাচনের বদলে গুরুত্ব পাচ্ছে মনোনয়ন। বর্তমানের ১৩৩ জন নির্বাচিত সদস্যের কমিটির স্থানে প্রতিষ্ঠিত হবে ২৫ জনের একটি কমিটি। এর মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ সদস্য হবেন কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত। মাত্র ছয়টি রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি আংশিক সময়ের জন্য কমিশনের সদস্য হতে পারবেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ইচ্ছাধীন একটি পুতুল সংস্থা গঠিত হবে বলেই সকলের আশঙ্কা। এই সংস্থা, অতএব, জনগণের নয়, সরকারের স্বার্থই দেখবে। শুধু তাই নয়, গঠনরীতির এই পরিবর্তন ভারতের ফেডারেল চরিত্রের বিরোধী। "মেডিক্যাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল" নামক একটি ব্যবস্থা সম্ভবত হতে চলেছে এন এম সি-র সঙ্গে রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলগুলির বাক্যালাপের প্রধান (কিছুক্ষেত্রে একমাত্র) উপায়।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: স্ত্রীরোগ এবং আমাদের সমাজ
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রম নির্ধারণ ও গুণমান নিয়ন্ত্রণ, মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান নির্ধারণ, এথিক্স ও রেজিস্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির প্রয়োজনে যে স্বনিয়ন্ত্রিত বোর্ডগুলো এনএমসির অধীনে কাজ করবে, তাদের মধ্যেও মনোনয়নের ছড়াছড়ি এবং তার রাশ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এসব বোর্ডে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাইরের বিভিন্ন বিভাগের মাননীয় মানুষদের অন্তর্ভুক্তি বৈচিত্র্য বাড়াবে এবং জনকণ্ঠের প্রতিধ্বনি চিকিৎসা শিক্ষার অন্দরমহলে গুঞ্জরিত হবে, এমন আশা করাই যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আশার বাস্তব রূপটি সামান্য অন্যরকম। কোন মান্য ব্যক্তি কোথায় স্থান পাবেন, তা নির্ধারণ করবেন কেন্দ্রীয় সরকার। হয়ত ২০২১ সালে এমবিবিএস পাঠ্যসূচি রচনার দায়িত্বে পেতে পারি পণ্ডিত দীননাথ বাত্রা বা সমমনস্ক কাউকে। অতঃপর ফলিত জ্যোতিষের সাহায্যে রোগ নির্ণয় ও পঞ্চগব্যের সাহায্যে চিকিৎসার পদ্ধতি শেখানো শুরু হতে পারে। তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা জনগণই বিবেচনা করুন।এই বিলে স্নাতক স্তরের ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তি হবার জন্য "নিট" (NEET) পরিক্ষাটিকে মানদণ্ড ধরা হয়েছে প্রত্যাশিতভাবেই। সমস্যা হল কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য পরিচালিত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বোর্ডগুলির পাঠ্যসূচি আলাদা এবং পঠনপাঠনে ব্যবহৃত ভাষাও আলাদা। ফলে কিছু বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য বোর্ডের চেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন। সহজ করে বললে সিবিএসই ও আইসিএসই বোর্ডের ইংরেজ, হিন্দি স্কুলের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে থাকবেন এবং আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশুনা করা গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়বেন।
স্নাতক স্তরের পাঠ শেষ হবার পর ন্যাশনাল একজিট টেস্ট (NEXT) নামক একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনার বদলে এটাকে কল্পনা বলাই সঙ্গত। এই পরীক্ষাটি নাকি একইসঙ্গে স্নাতক হয়ে রেজিষ্ট্রেশন পাবার পরীক্ষা এবং স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ভর্তি হবার পরীক্ষা! স্নাতকোত্তর পাঠে ভর্তি হবার প্রতিযোগিতামূলক 'নিট' পরীক্ষাটি তুলে দেবার কথা বলা হয়েছে। অথচ এমবিবিএস ফাইনাল আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এন্ট্রান্স পরীক্ষার উদ্দেশ্য ও চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এমবিবিএস ফাইনালে লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা ও প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার কঠিন পর্যায়গুলো পেরোতে হয়। এই অংশগুলো বাদ দিলে শুধুমাত্র মুখস্থ বিদ্যার সাহায্যে রোগী দেখার অভ্যাস ছাড়াই ডাক্তারি পাশ করা যাবে, যার ফল হবে মারাত্মক। অপরপক্ষে এই অংশগুলো রেখে সর্বভারতীয় স্তরে একদম সমমানের পরীক্ষা নেওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে এই পরীক্ষাকে স্নাতকোত্তর পাঠের প্রতিযোগিতা হিসেবে ব্যবহার করলে তা হবে অনেকের প্রতি অবিচার।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এগোবো কোন পথে?
এই বিলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির হাতে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের পছন্দমতো স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করতে ও সিট বাড়াতে পারবে। সম্ভবত গুণমানের প্রশ্নে তাদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ লঘু হতে চলেছে, যদিও এমন কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। স্পষ্টত যা বলা আছে তা হল এসব কলেজের মোট ছাত্রসংখ্যার অর্ধেক সিট যথেচ্ছ দামে বিক্রি করা যাবে, তার ওপর কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। স্পষ্টত স্বাস্থ্যশিক্ষাকে একটি বহু সহস্র কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত করা এই বিলের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বেশ কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে যাঁরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করবেন এসব কলেজ থেকে, তাঁদের কানের কাছে সেবার মন্ত্রটি জপতে খানিক অসুবিধে হতে পারে।
এই বিলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত 'হাতুড়ে' চিকিৎসকদের রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে সরকার স্বীকৃত চিকিৎসকে পরিণত করার পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটিও বিতর্কিত। এতে চিকিৎসার গুণমান মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে, এই আশঙ্কায় বহু প্রতিবাদ হয়েছে, যাকে সরকার বাহাদুর শান্তচিত্তে অগ্রাহ্য করেছেন। আবার উল্টোদিকে রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের অপ্রতুলতা অনস্বীকার্য। সুতরাং এই বিষয়টি জটিল এবং স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। পরবর্তী পর্যায়ে এ নিয়ে আমরা আলাদাভাবে কথা বলব।
সব মিলিয়ে এই বিল আপনাদের সকলকে শারীরিকভাবে প্রভাবিত করবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। বিনা সংশোধনে বর্তমান চেহারায় এর পাশ হয়ে যাওয়া না পড়ে এমবিবিএস পাশ করার মতোই বিপজ্জনক… রোগীর জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। চিকিৎসকেরা নিজেদের মতো করে এর প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় চিকিৎসকেরা সংখ্যালঘু। এদিকে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক এমনই তলানিতে ঠেকেছে যে চিকিৎসককুল যখন রোগীদের হয়ে লড়াইটা লড়ার চেষ্টা করছিলেন, রোগীরা তখন বিশ্বাস করে পাশে এসে দাঁড়াতে পারলেন না। ফল কী হল, তা আমরা অচিরেই টের পাব।