Advertisment

জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব

নাগরিকত্ব হল আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের পঞ্জীভুক্ত সদস্য হয়ে অর্জন করা একটি স্ট্যাটাস। যে কোনও ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনী প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
citizenship

নাগরিকত্ব প্রশ্ন ও জাতীয়তার প্রশ্ন এক নয়

আজ সারা ভারতবর্ষ নাগরিকত্বের প্রশ্নে উত্তাল। নাগরিকপঞ্জী নির্মাণ হচ্ছে, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হচ্ছে। কিন্তু একটি জরুরী প্রশ্ন অনালোচিত এবং অমীমাংসিত। জাতিসত্তা এবং নাগরিকসত্তা কি এক? বিদেশী এবং বিদেশী নাগরিক কি সমার্থক? ন্যাশনালিটি এবং সিটিজেনশিপ শব্দদুটি কি এক?  একজন সাধারণ মানুষের কাছে জাতীয়তা শব্দটি নাগরিকত্বের বিকল্প হিসাবে কাজ করে এবং উল্টোটাও সত্য। কিন্তু বাস্তবে, জাতিসত্তা এবং নাগরিকত্বের মধ্যে পার্থক্যটি এতই স্বতঃসিদ্ধ যে আমরা এটিকে অস্বীকার করতেই পারিনা, উপেক্ষা করতেই পারি না। কোনও ব্যক্তির জাতিসত্তা তার জন্মের সূত্রটি প্রকাশ করে, অর্থাৎ সে যেখান থেকে সে উদ্ভূত। তার পূর্বপুরুষের সঙ্গে তার রক্তসম্পর্ক। একটি নির্দিষ্ট জাতির সাথে কোনও ব্যক্তির সম্পৃক্ততা। মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে।

Advertisment

ন্যাশনালিটি বা জাতীয়তা এথনিক বা রেসিয়াল। আমি ভারতীয় নাগরিক কিন্তু আমি বাঙালীও। জাতীয়তায় ব্যক্তি নিজের উপর রাষ্ট্রের অধিকার চিহ্নিত করে এবং পরিবর্তে রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদান করে। এই অধিকার এর অঞ্চলগুলি কী গুলি রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলি কী তা রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে পৃথক হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রথা এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশানের মাধ্যমে, প্রতিটি রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে যে, কারা ন্যাশনাল হবেন তা ঠিক করা। এই নির্ধারণ জাতীয়তা আইনের অঙ্গ। নাগরিকত্বের চেয়ে জাতীয়তা প্রযুক্তিগত ও আইনিভাবে আলাদা। কোনও ব্যক্তি এবং একটি দেশের মধ্যে একটি ভিন্ন আইনি সম্পর্ক। “ন্যাশনাল” এই শব্দটি নাগরিক এবং অনাগরিক উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। নাগরিকত্বের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে নাগরিকদের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনে অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে যেমন ভোটদান বা নির্বাচনে দাঁড়ানোর মাধ্যমে।

আরও পড়ুন, নতুন বছরে পুরোনো দেশ, এবং নাগরিকত্বের বিদেশ গমন

মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে "প্রত্যেকেরই জাতীয়তার অধিকার রয়েছে," এবং "কাউকে নির্বিচারে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না বা তার জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকারকে অস্বীকার করা যাবে না।” যে ব্যক্তির পূর্ণ নাগরিকত্ব বা জাতীয়তাকে অস্বীকার করা হয় তাকে সাধারণত রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি বলা হয়।

জাতীয়তা হ'ল মূল পরিচিতি, যা একজন ব্যক্তির স্বদেশ। যে দেশে তাঁর বংশমূল। উৎপত্তি স্থল। ন্যাশনালিটি, নামেই বোঝা যায়, নেশনের সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন একটি অবস্থান যা কোনও ব্যক্তি জন্মগতভাবে অর্জন করে বা সহজাত হয়। অন্যদিকে, সিটিজেনশিপ কিছুটা আলাদা। কোনও ব্যক্তির রাষ্ট্রের স্বীকৃত সদস্য হওয়ার জন্য আইনী আনুষ্ঠানিকতাগুলি পূরণ করা প্রয়োজন।

জন্মসূত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিন্তু অন্য কোনও রাষ্ট্রের নাগরিক এই বাক্যবন্ধটি অনুসরণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। যেমন হরগোবিন্দ খুরানা, সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, ভেঙ্কি রামকৃষ্ণান, ভারতে জন্মেছেন কিন্তু নোবেল পাবার সময় অন্য দেশের নাগরিক ছিলেন। তবু ভারতীয় নোবেলপ্রাপকদের মধ্যে তাঁদের নামও উচ্চারিত হয়। নাগরিকত্ব হল আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের পঞ্জীভুক্ত সদস্য হয়ে অর্জন করা একটি স্ট্যাটাস। যে কোনও ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনী প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারেন।

publive-image

নাগরিকত্বের দুটি প্রাথমিক উৎস রয়েছে: জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (সিটিজেনশিপ বাই বার্থ) বা জুস সলি, যেখানে কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রের আঞ্চলিক সীমানার মধ্যে জন্মগ্রহণ করলে, বা বিদেশে জন্মানো দেশজ পিতা মাতার সন্তানেরাও সে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবেই গণ্য হন। এর বিপরীতে রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিকীকরণ, যা এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনও যোগ্য আইনী অভিবাসী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন এবং গৃহীত হন। এবং রয়েছে নিবন্ধীকরণ। ভারতীয় জাতীয়তা আইন বর্তমানে মূলত ন্যায়সঙ্গত (রক্তের অধিকারে নাগরিকত্ব) জুস স্যাঙ্গুইনিসকে, জুস সলির বিপরীতে (অঞ্চলটিতে জন্মের অধিকারে নাগরিকত্ব) অনুসরণ করে। কোনও ব্যক্তির ভারতের নাগরিকত্ব ভারতের সংবিধানের ৫ থেকে ১১ (দ্বিতীয় খণ্ড) অনুচ্ছেদ দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সম্পর্কিত আইনটি হ'ল নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫। এই নাগরিকত্ব আইন ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ এবং শেষবার ২০১৯ সালে সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন গুলির মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক এবং খোলনলচে পাল্টে ফেলা সংশোধন হয়েছে ২০০৩ সালে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে, বিজেপি রাজত্বে।

  • ২৬.০১.১৯৫০ বা তার পরে কিন্তু ০১.০৭.১৯৮৭ সালের এর আগে ভারতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তি তার পিতা-মাতার জাতীয়তা নির্বিশেষে একজন ভারতীয় নাগরিক।
  • ০১.০৭.১৯৮৭ সাল থেকে ০২.১২.২০০৪ এর মধ্যে ভারতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তি  নাগরিকত্ব পাবেন যদি তার বাবা-মা উভয়ের কোনও একজন জন্মের সময় ভারতের নাগরিক থেকে থাকেন। ৩.১২.২০০৪ বা তার পরে ভারতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তি তখনই নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হবে যখন তার বাবা-মা উভয়ই ভারতীয় বা কমপক্ষে একজন (পিতা বা মাতা) নাগরিক এবং অন্যজন জন্মের সময় অবৈধ অভিবাসী ছিলেন না।
  • ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী বা তার পরে ভারতের বাইরে জন্ম নেওয়া কোনও ব্যক্তি বংশোদ্ভূতভাবে ভারতের নাগরিক হন যদি তার বাবা তাঁর জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক হন। ভারতীয় সংবিধানের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করবে সে আর ভারতীয় নাগরিক নয়।

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে, তা হলো এদেশে ন্যাশনালিটি এবং সিটিজেনশিপ যেহেতু একই অর্থে ব্যবহার হয়, সেখানে দুটোর তফাৎ এত বিস্তারিত বোঝানোর প্রয়োজন কী? উত্তরে একথা বলাই যায় যে ন্যাশনালিটি এবং সিটিজেনশিপ একই অর্থে ব্যবহার হয় না বলেই এন.আর.সি র পুরো কথাটা হল হচ্ছে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ। ন্যাশনাল এবং সিটিজেন দুটি শব্দই এখানে ব্যবহৃত। সি.এ.এ নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী, জাতীয়তা আইনের নয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আর ভারতীয় নাগরিক এক নয়।

এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় আলোচনার আছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্য যে দুটি জনবিরোধী প্রক্রিয়া জনমানসে প্রচুর ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করছে তা হলো এন.পি.আর এবং এন.আর.আই.সি। প্রশ্ন উঠছে যে গতানুগতিক এন.পি.আর কি এন.আর.সি-র পূর্বপক্ষ? এন.আই.আর.সি যে এন.আর.সি-র সর্বভারতীয় সংস্করণ তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। দুটোই ন্যাশনাল এবং দুটোই সিটিজেনস রেজিস্টার। প্রেক্ষিতটা শুধু আলাদা।

কিন্তু এন.পি.আর? তা কি এন.আই.আর.সি বা সি.এ.এ-র পূর্বপ্রক্রিয়া? যদিও বলা হয়ে থাকে এন.পি.আর এবং এন.আর.সি-র কোনও সংযোগ নেই ।  কোনও এলাকার ইউজুয়াল ইনহ্যাবিট্যান্টস (ছয় মাসের বেশী আছেন বা আরও ছয় মাস থাকবেন) দের তালিকা প্রস্তুতিকরণ। তবু মানুষ আতঙ্কিত যে এন.পি.আর এর সংগৃহীত তথ্য এন.আর.সি-র কাজে ব্যবহৃত হবে। আগের এন.পি.আর (২০১০ সাল) এ এতো তথ্য জানতে চাওয়া হয়নি, যা এবার হতে চলেছে। এ নিয়ে মিডিয়ায় বিস্তারিত আলোচনা চলছে। আমি তার মধ্য থেকে প্রায় অনালোচিত একটি বিষয় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবো। এন.পি.আর এ যেসব তথ্য জানতে চাওয়া হবে সেগুলি সেল্ফ অ্যাটেস্টেড। নথির প্রয়োজন নেই। বলে দিলেই হবে। কিন্তু এর মধ্যে লুকানো আছে এক ভয়ংকর আক্রমণের সংকেত।

এন.পি.আর-এ জানতে চাওয়া হবে আপনার ন্যাশনালিটি।

ধরা যাক আপনি দীর্ঘকালীন ভারতের বাসিন্দা। আপনি আপনার ন্যাশনালিটি লেখালেন ভারতীয়। কিন্তু তা প্রমাণের নথি আপনার কাছে নেই (আসামের ক্ষেত্রে যা আকছার ঘটেছে) বা থাকলেও অগ্রাহ্য হলো। তখন এনার্সি  বা এন.আর.আই.সি তে আপনি বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন এবং আপনার স্থান হবে ডিটেনশন সেন্টারে এবং পরিচয় হতেই পারে লেবার ফোর্স হিসাবে। কিন্তু আপনার অনেক পরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় অত্যাচারে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু শরণার্থী সি.এ.এ-বলে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন (!!!!!)। আপনি পাবেন না কেননা এন.পি.আর-এ আপনি নিজেকে ভারতীয় হিসাবে দাবী করেছেন, ঐ তিন দেশের নয়। উল্টো দিক থেকে দেখলে আপনি যদি হিন্দু শরণার্থী হন এবং এন.পি.আরে নিজেকে বাংলাদেশী বা পাকিস্তানী বা আফগান হিন্দু শরণার্থী হিসেবে নিজের ন্যাশনালিটি জানিয়ে থাকেন, তবে প্রয়োজন অনুসারে আপনার কাছে প্রমাণ চাওয়া হতেই পারে যে ১. আপনি ঐ তিনটি দেশের কোনওটির নাগরিক ছিলেন। ২. আপনি অবশ্যই ২০১৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর বা তার আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন। ৩. আপনি এই তিনটি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ৪. ধর্মের ভিত্তিতে নিপীড়নের হুমকিতে আপনি অবশ্যই এই দেশগুলি থেকে ভারতে চলে এসেছেন।

অর্থাৎ ন্যাশনালিটি ভারতীয় দেখালে এবং ডকুমেন্ট না থাকলে আপনি এন.আর.আই.সি ছুট। আর ন্যাশনালিটি ঐ তিনটি দেশের দেখালে এমন হতেই পারে আপনি সি.এ.এ বঞ্চিত হলেন। তপ্ত কড়াই না উনুন, কোনটা ভাল ভাবতে ভাবতেই আপনার বাকি দিন কেটে যেতে পারে।

(পার্থ প্রতিম মৈত্র সমাজকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

nrc Citizenship Amendment Act NPR
Advertisment