শেষ না শুরু কোনটার কথা বলা হবে নির্ণয় করা সমস্যা। আমাদের কাছে দুটোয় দেখি তফাৎ বিশেষ করা যায় না, যে কোনো উৎসবের ভাসান অর্থাৎ অবসানেও নিশ্চিন্তে বলে ‘আসছে বছর আবার হবে’। আবার যখন হবেই তখন আর ভয় কিসের? ভরসাই বা কিসের? যতো উদ্বেগ, দুর্দশা, আশঙ্কা, যতো প্রিয়জন বিচ্ছেদের বেদনা এবছর পেয়েছি, সামনের বছর যে তার একটিও কম পড়বে এমন আশ্বাস কেউ দেয় নি। যা কিছু সাফল্য, প্রতিরোধ, ন্যায়প্রতিষ্ঠার শুভ চেষ্টা, যত সৌভাগ্য হারানোকে ফিরে পাবার বা নতুন ভালোবাসার- তাইই বা তাহলে কম পড়বে কেন? কেবল নতুন করে শুরুর চেষ্টা। কেবল মনে মনেই কালকে কোথাও ছেদ করে একটি বিন্দুতে পৌঁছে হিসেব নেওয়া- যা যা আমাকে দুঃখ দিয়েছে, সেগুলোকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে আনন্দের ভাগটিকে আরেকটু কী করে বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম...’র বোকা ভাবনা ছেড়ে একটু একটু করে মানুষের, অধিকাংশ মানুষের, এই বোধ যেন আবার ফিরে আসছে যে একা বাঁচা যায় না। সকলকে নিয়ে যে বাঁচা, তাতেই সৌন্দর্য, তাতেই সুরক্ষা। একা মানুষ যতো বড়ই হোক, যতো শক্তিশালী, বিপদকালে দেখা যায় তার প্রয়োজন হয় অন্য মানুষকেই। সেই ‘অন্য’কে আমি পাবো কোথায় যদি বাকি সময় তার মুখের দিকে না তাকাই? যদি তাকে না-চিনি? কেবল দুঃখ বিপদেই কেন, সুখ ভাগ করার জন্য, আনন্দ উদযাপন করার জন্যও তো সেই অন্যদের দরকার হবে যারা সত্যিই আমার সুখে সুখী হবে, আমার সৌভাগ্যে খুশি। না হলে বাইরে আলো জ্বালব কেন, যদি অন্যকে ডাকতে না চাই?
যে সমাজ সততার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হয় মাত্র
আজকের এই বছরটির শেষ সপ্তাহ যা কিনা পরের বছরের শুরুও সূচিত করবে, আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের এই দেশের ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে আজকের নবীন বা তরুণ প্রজন্মের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল বলে। আজ থেকে সত্তর বছর আগেকার এক বেদনাবহ ইতিহাস বারে বারে নির্দেশিত হচ্ছে এই মুহূর্তের পয়েন্ট অব রেফারেন্স হিসাবে- ধর্মের নামে এক বিরাট জনগোষ্ঠিকে দুটি দেশে ভাগ করে দেওয়ার সেই ইতিহাস যেখানে নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য লোক বিদেশী হয়ে গেল। তারপর দশকের পর দশক ধরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই কথা যে মানুষ বাঁচে, ভালো থাকে তার ধর্মে নয়, নিজস্ব সংস্কৃতিতে।
যেখানে মানুষ বাস করে সেখানেই তার দেশ- এই সহজ আর স্বাভাবিক হিসেব ছেড়ে প্রকৃতির মধ্যে জন্মানো, ঘর বাঁধা, প্রাকৃতিক শক্তি আর নিয়মের ওপর ভিত্তি করে হাজারহাজার বছর চলা সাধারণ মানুষদের যে জীবনধারণ পদ্ধতি নিজের চলার মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে চলেছে, তাকে অগ্রাহ্য করে কিছু ক্ষমতাসীন লোক একটি ক্ষণস্থায়ী কালে একটি নির্দিষ্ট মৃত্তিকাখণ্ডের ওপর নিজেদের মালিকানা ঘোষণা করার মত চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর, তা করতে গিয়ে এই গ্রহটির প্রাকৃতিক বিশেষত্ব, যা কিনা এই গ্রহে প্রাণের এত বিচিত্র, জটিল প্রকাশ সম্ভব করেছে, সেগুলিকে নষ্ট করে ফেলছে।
এই অতি সাময়িক প্রাধান্যলাভের জেদে নিয়মাবলী এমন বিধ্বংসী ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী লঙ্ঘন করে চলেছেন যে তাঁদের কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে সেরকম ডেলিঙ্ক্যোয়েট বালকদের মত যাদের চিকিৎসা দরকার। জীবনধারণের যে সব দুঃখ, সমস্যা নিবারণ করা যায় না তার সঙ্গে আরো বহু বহু মর্মান্তিক দুঃখ-বেদনা এই ক্ষমতাধারীরা কেবল আমদানিই করছেন না, তার সপক্ষে দার্শনিক যুক্তিও দিচ্ছেন। এই বিশৃঙ্খলা মানুষের সমাজজীবনে বারে বারেই ফিরে আসে, কারণ একদল ক্ষমতালোভী পরাস্ত হবার পর আবার অন্য কোনো উচ্চাশা নিয়ে অন্য ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত হয়, পুনরায় পরাস্ত হবার জন্য।
এই চক্র বহুকাল ধরে চলতে চলতে অনেক সহজমনের মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছেন ক্ষমতাশালীদের পরাস্ত করার বদলে ক্ষমতার লোভ ব্যাপারটাকেই যদি পরাস্ত করা যায়! ক্ষমতার হাতে পীড়নের এত ক্ষতিকর, এত কুৎসিত নিষ্ঠুরতার কথা যুগের পর যুগ ধরে ইতিহাসে আঁকা আছে, যে ওই কাঠামোর প্রতি সুস্থ মানুষদের মনে এক আন্তরিক বিতৃষ্ণা আসা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত ক্ষমতাশাসিত সমাজের তুলনায় এত বেশি সুন্দর সমানাধিকারের, ভালোবাসার, সহযোগিতার সমাজ- যে সারাপৃথিবীতে হিংসায় ক্লান্ত মানুষের, তরুণ মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
বঙ্গ রাজনীতি থেকে ‘তরমুজ’ কি হারিয়ে গেল!
একে-দুইয়ে আমাদের মত সামান্য মানুষরাও তাইই চাই, যদভদ্রং তন্নয়াসুব- ‘যা সুন্দর, তাই যেন পাই আমরা।’ এই শুভেচ্ছা নিজেরাই নিজেদের জানাতে হলে কী যে সেই ‘ভদ্র’ তার ভাবনা আমাদের নিজেদের মনে পরিষ্কার থাকতে হবে। না হলে সে পথে যাব কেমন করে! অন্যদের সঙ্গে কথা বলে রাস্তা চেনা, বড়ো কাজকে ছোট্ট জায়গার মধ্যে ধরে এক এক পা করে চলা- এই তো উপায়, মনে হয়। কারো কারো মনে হতে পারে-স্বপ্ন। হতেই পারে তাই, কিন্তু দখলদারীর কুশ্রী পথে গটগট করে যাবার থেকে, সুন্দর স্বপ্ন দেখাই ভাল নয় কি? খুব নিকট অতীতে পথে ঘাটে, ভালোবেসে বাঁচতে চাওয়া হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে কী দেখলাম না? এবারে না হয় তারাই শিক্ষক?
দেশের বাইরে সাহসী প্রতিবাদ তোলা ছোটদের দেখছিলাম সপ্রশংস চোখে, তারপর আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা উঠে দাঁড়াল দেশের শক্তিমানদের অন্যায়ের বিপক্ষে, নিরস্ত্র সাহসের বীরত্বে। যখন সবাই মেনে নিয়েছিল শক্তিমানদের যথেচ্ছাচার, ঠিক তখনই নতুন করে প্রতিবাদের জন্ম হল তরুণদের মধ্য থেকে। প্রবীণরাও এগিয়ে এলেন। সারাবিশ্বের গণতান্রিক আন্দোলনের নকশার সঙ্গে যেন টায় টায় মিলে গেল এই প্রাচীন, বৈচিত্রময়, সমৃদ্ধ দেশের জনগণের স্বর। এক নতুন ভালোবাসা জন্ম নিল।
এই বছরটির পাওয়া শিক্ষা যদি টেনে নিই আগামী বছর পর্যন্ত, ‘যা কিছু ভালো, তাই যেন প্রাপ্ত করতে পারি’ এই চেষ্টায়, তাহলে যেন আশপাশের বিপন্ন মানুষদের ভালোবাসি সবচেয়ে যত্নে আর একই রকম করে ভালোবাসি নিজেদের নদী জল পাহাড় জঙ্গল পশুপাখিদের। জীবজগতের একমাত্র ধাত্রী পৃথিবী আমাদের শুভ পথে চালিত করুন। আমরাও যেন তাঁকে রক্ষা করার দিকে যাই।
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে