বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনও প্রতিবেশী সার্বভৌম রাষ্ট্র কি আমাদের আর বন্ধু থাকবে না? বেশ কিছু দিন ধরে নেপালের ঘটনাপ্রবাহ দেখে এই সব হিং টিং ছট প্রশ্ন মাথার মধ্যে কামড়াচ্ছে। একদা হিন্দু রাষ্ট্র, এখন সাংবিধানিক গণতন্ত্র বলে সেখানে সংসদ শক্তিশালী হচ্ছে। এ তো সুখের কথা। কানাঘুষো বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল সরকারি মহল থেকে যে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু কার্যত তিনি চিনের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছেন। নেপাল তাদের মানচিত্র বদলাচ্ছে। ভারতের দাবী অনুসারে, তিনটি ভূখণ্ড নেপাল তাদের মানচিত্রে নিয়ে নিয়েছে।
তাও তো আচমকা হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরে নেপালি সরকারি টিভিতে আবহাওয়ার সংবাদ বলতে গিয়ে এই তিনটি জায়গারও আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল। আর রাজনাথ সিংহ যখন নেপালে গিয়ে কৈলাস যাত্রার সড়ক নির্মাণের উদ্বোধন করলেন, তখন সকলেই গর্জে উঠল। প্রচন্ডর মতো কমিউনিস্ট নেতা, যিনি এখন সংসদে আস্থা রাখেন, তিনিও প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ সৃষ্টি করলেন, গর্জে উঠলেন, এবং সংসদে শেষ পর্যন্ত পাস হয়ে গেল নতুন মানচিত্র।
আমরা এখন ভাবছি, কী করা? ভারত সরকার মনে করছে যে এর পিছনে চিনের উস্কানি আছে। তাই বলে কি আমরা এখন চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাব? মায়ানমারেও তো সড়ক বানাচ্ছে চিন। বিপুল অর্থ সেখানে দান করেছে। পাকিস্তানের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সে তো চিনের একই অক্ষের বাসিন্দা। কিন্তু যেটা কোনও দিনও হয়নি, শ্রীলঙ্কাতে পর্যন্ত চিন তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। এটাকে বলা হচ্ছে চিনের 'expansionism'। তাহলে এরকম একটা পরিস্থিতিতে যখন চিন আমাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে, নেহরুর পর এই প্রথম আকসাই-চিনে সেনা ঢুকল, তারপর লাদাখে গন্ডগোল, তখন আমরা করব কী? আমরা কি যুদ্ধ করব?
আরও পড়ুন: করোনা আবহে চিনা অনুপ্রবেশ, অভিসন্ধি বোঝা জরুরি
আর যাই হোক, যুদ্ধ আমার একেবারেই ভাল লাগে না। যুদ্ধ জিনিসটাই আমার একেবারে ভালো লাগে না। এই পরিস্থিতিতে আসলে ভারতের কখনোই উচিত নয়, প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্রকে 'taken for granted' হিসেবে দেখা, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যে তারা সঙ্গে আছে। 'Taken for granted' কোনও প্রেমের সম্পর্কেও হয় না। বাংলাদেশকেও কিন্তু চিন নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনা যখন চিনে যান, তখন তাঁকে যেভাবে 'রেড কার্পেট' বিছিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল, এবং যেভাবে আর্থিক সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে চিন, সেখানে শেখ হাসিনা, আওয়ামি লীগ, এবং বাংলাদেশ সরকার যে এখনও চিনের একতরফা আনুগত্য স্বীকার না করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক অটুট রেখেছেন, তা প্রশংসনীয়।
কিন্তু ভারতকে আরও সর্তক হতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকাতে হবে 'বড়দাদা' সুলভ মনোভাব ত্যাগ করে। সম-মনোভাবাপন্ন বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' ছবির সেই গানের দৃশ্যটা মনে পড়ছে? হাল্লা চলেছে যুদ্ধে? 'আছ হেথা যত আমির-ওমরা, আর যত বেটা হোমরাচোমরা...' জহর রায় পিছন থেকে গাইছেন, 'আর যত হুঁ হুঁ হোমরাচোমরা... শোনো হে শোনো হে শোনো হে তোমরা, হাল্লা চলেছে যুদ্ধে।' তারপর... 'শুন্ডির দিও পিন্ডি চটকে!' সেখানে কিন্তু মূল প্রশ্নটা ছিল, 'ওরে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল... রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে-অমঙ্গল!' কেননা সেনাও মনে হচ্ছে যেন আধপেটা খেয়ে মরে।
সত্যজিৎ রায়ের এই ছবি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালের ৮ মে। আর ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে ১৭ দিন ধরে চলেছিল ভারত-পাক যুদ্ধ। তার আগে ১৯৬২ সালে চিনের আগ্ৰাসন। ১৯৬৭ সালে ফের চিন লাদাখ আক্রমণ করে। শিশুদের জন্য তৈরি 'গুগাবাবা'-তেও তাই ফ্যান্টাসির হাত ধরে ছিল তীব্র যুদ্ধবিরোধী ব্যঙ্গাত্মক কষাঘাত। চার্লি চ্যাপলিনের চেয়ে কম কী সে? আজ ২০২০-তে চিনের সঙ্গে ভারতের সংঘাত দেখে শুন্ডির পিন্ডি চটকে দেওয়ার মতোই অনেকে বলছেন, দাও ব্যাটা চিনের কোমর ভেঙে।
ভারতের এক অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবে, কারোর সঙ্গেই যুদ্ধ-রক্তক্ষয় আমার ভাল লাগে না। কোনও কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ আজ এই করোনা আক্রান্ত দুঃসময়ে বলতে পারেন না, হাল্লার রাজার মত নরেন্দ্র মোদী ইটের বদলে পাটকেল দিতে চিন সীমান্ত পেরিয়ে 'সার্জিকাল আক্রমণ' করুন। আমার তো কারোর সঙ্গে ঝগড়াই ভাল লাগেনা, আর ঝগড়া হলেও হাতাহাতি আমাদের পরিবার-পাড়া-সমাজ, কোথাওই সমাধানের পথ নয়, বরং প্রতিবেশীর সঙ্গে বারবার দেখাশোনা আর আলোচনাই কলহ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
আরও পড়ুন: শুধু কোভিড নয়, সঙ্গে ঘাড়ের ওপর চিন
তবু যুদ্ধ হয়। গ্ৰীস-রোম-ফ্রান্স থেকে শুরু করে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ শুধু নয়, ভারতের ইতিহাসেও হিংসা-যুদ্ধ কম নেই। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডাঃ মনমোহন সিংয়ের কন্যা তথা ইতিহাসের অধ্যাপিকা ডাঃ উপিন্দর সিংয়ের সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ বই - 'পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ইন এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়া'-তে তিনি দেখিয়েছেন, বুদ্ধ থেকে গান্ধীর অহিংসার দর্শনের পাশাপাশি মহাভারতের যুদ্ধ তো সহিংস। তাই রাষ্ট্র শান্তি চাইলেও আত্মরক্ষার তাগিদে তাকে যুদ্ধের পথে যেতে হয়।
চিনের ইতিহাসও বড় রক্তাক্ত, তাই সে দেশের সুন জ়ুর 'আর্ট অফ ওয়ার' যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জেনারেল কার্ল ভন ক্লাউসউইটজ-এর লেখা 'অন ওয়ার'-ও পৃথিবী বিখ্যাত বই। প্রাশিয়ার এই মানুষটি নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, ১৮১৬ থেকে ১৮৩০-এর মধ্যে। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বইটি প্রকাশ করেন। এই বইতে তিনি যুদ্ধের যে সংজ্ঞা দেন, তা আজও জনপ্রিয়, সর্বজন গৃহীত। তিনি বলেন, 'ওয়ার ইজ দ্য কনটিনিউয়েশন অফ পলিটিক্স বাই আদার মিনস্ (যুদ্ধ হলো অন্য পথে রাজনীতি)।' তিনি নিজে সেনা পুরুষ, যুদ্ধ করার পরও লিখে গেছেন, যুদ্ধ তখনই হয় যখন আলোচনার রাজনীতি ব্যর্থ হয়। কিন্তু আলোচনাই যে শ্রেষ্ঠ পথ, তা কিন্তু তিনিও স্বীকার করেছেন।
শত্রুকে গভীরভাবে জানতে হবে। সুন জ়ু একথা বলেছিলেন। চিন আমাদের কাছে যেন আজও এক আশ্চর্য প্রহেলিকা। প্রথমত, চিনকে বুঝতে হবে। চিন শতাব্দীর পর শতাব্দী নানান বহিরাগত লোলুপ আক্রমণকারীর হাতে রক্তাক্ত হয়েছে। সেজন্যই চিনের সম্রাটরা শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য নিষিদ্ধ নগরী গড়ে তোলেন। এখন তো গিয়ে দেখেছি সেটি নিষিদ্ধও নয়, নগরীও নয়, পর্যটন ক্ষেত্র। তবু চিন কেন এই স্থানটিকে গুরুত্ব দেয়? তার কারণ, চিন আর আক্রান্ত হতে চায় না, পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হতে চায়। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। অস্কার-জয়ী ছবি 'দ্য লাস্ট এমপেরার'-এ দেখেছিলাম, একটি বাচ্চা ছেলে, যে চিনের শেষ সম্রাট, রুশ লাল সেনার আক্রমণে সিংহাসনের পিছনে লুকোচ্ছে। পরে সে হয়ে যায় রাজনৈতিক বন্দী।
রুশরাও তো দীর্ঘদিন চিনের ওপর প্রভুত্ব করেছে। সাংহাইতে বেশিরভাগ পুরনো অট্টালিকা ও হোটেল তো রুশ স্থাপত্যের নিদর্শন। ১৯৪৯ সালের পর চিন ভিয়েতনাম আক্রমণ করেছে, কাম্বোডিয়াকে বিপদে ফেলেছে, কিন্তু নিজে কখনোই আক্রান্ত হয়নি। ১৯৪৯-এর পর পশ্চিম দুনিয়ার সঙ্গে যখন চিনের সম্পর্ক মধুর নয়, কার্যত কোনও দেশে চিনা রাষ্ট্রদূত নেই, তখন ১৯৭১ সালে, অর্থাৎ দু'দশক পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাঠান হেনরি কিসিঞ্জারকে। তার আগে মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নো বেইজিং-এ গিয়ে অবশ্য সলতে পাকানোর কাজ করেন।
কিসিঞ্জার তাঁর 'অন চায়না' বইটিতে অনেক গপ্পো শোনান। বলেন, সাধারণত যে কোনও দেশ তার স্থানীয় ভৌগোলিক অবস্থান বা নিজস্ব জাতির পরিচয়ে দেশের নামকরণ করে। অথচ চিন নিজেদের দেশের নাম দেয় Zhongguo - যার মানে 'মিডল কিংডম' বা 'সেন্ট্রাল কান্ট্রি'। কিসিঞ্জার বলেন, এই নামকরণ করার পিছনে মনস্তত্ত্ব হল, পৃথিবীর মধ্যে আমরাই হব প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি আরও বলেন, চিনকে ধৈর্য্য ধরে বুঝতে হয়, সেই প্রথমবার যাওয়ার পর কিসিঞ্জার ৫০ বারেরও বেশি বার গিয়েছেন চিনে।
আরও পড়ুন: লাদাখে চিনের অনুপ্রবেশ যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তার মোকাবিলা করতেই হবে
এদিকে ১৯৬২ সালের পর ১৯৬৭ সালে চিন ফের ভারতের ভূখণ্ড আক্রমণ করেছিল। সেবার কিন্তু ভারতীয় সেনা চিনা বাহিনীকে যথেষ্ট মজবুত জবাব দেয় সিকিম সীমান্তে (সূত্র: প্রাক্তন সেনা অফিসার প্রবাল দাশগুপ্তের বই 'ওয়াটারশেড ১৯৬৭: ইন্ডিয়াস ফরগটেন ভিক্টরি ওভার চায়না'), তবে মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সম্পর্ক শুধরোতে উদ্যোগী হন। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বেইজিং যান। প্রাক্তন বিদেশ সচিব জেএন 'মণি' দীক্ষিত লিখেছেন যে বাজপেয়ীর সফর ছিল খুবই সফল। কিন্তু বাজপেয়ী যেদিন হাংঝাউতে যান, ঠিক সেদিনই ভিয়েতনাম আক্রমণ করে চিন। তখন এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিয়েতনাম। মণি দীক্ষিত বলেছেন, "এটাই হল চিনের মাইন্ডসেট। ওরা এভাবেই সবসময় শিক্ষা দিতে চায়। এজন্য বাজপেয়ীর সফল সফরেও কালো ছায়া পড়ে।"
এদিকে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থেকেও চিন নিয়ে কোনও আহ্লাদ দেখান নি। বাবার ভুলটাও হয়ত সবসময় পীড়া দিত তাঁকে। চিনকে তিনি কোনোদিন বিশ্বাস করেন নি। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরার মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে পিএন হাকসারকে চিনে পাঠান বরফ গলানোর উদ্দেশ্যে। এই প্রাক্তন আমলা হলেন বিশেষ দূত। এরপর ১৯৮৮ সালে চিন সফর। ডিসেম্বরের প্রবল শীতেও রাজীবকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন খোদ দেং শাওপিং। রাজীবের সফরের প্রতিদান হিসেবে লি-পেংয়েরও ভারত আসার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তখন আর তাঁর থাকা হয় নি। ১৯৯১ সালে তিনি দিল্লি আসেন, তখন নরসিমহা রাও প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু রাজীবের সফরকে সফল বলতেই হবে, কারণ তখনই সীমান্তে ইট ছড়ানোর জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্ৰুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ভারতের বিদেশ সচিব ও চিনের ভাইস ফরেন মিনিস্টার কথা বলবেন। নটবর সিং চিনে ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবে ছিলেন তখন। তাঁর ডায়েরিতে আছে, দেং শাওপিংয়ের সঙ্গে যখন রাজীবের দেখা হয়, তখন দুজনের মধ্যে করমর্দন ছিল দীর্ঘক্ষণের। দেং বলেন, "আমার যুবক বন্ধুকে আমি স্বাগত জানাই এদেশে। তোমার ঠাকুরদা ও মায়ের সঙ্গে আমার এভাবেই দেখা হয় ১৯৫৪ সালে। তখন আমি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম।"
দেং রাজীবকে আরও বলেছিলেন, "আমি বোধহয় তোমার দ্বিগুণ বয়সী।" দুজনের মধ্যে আমেরিকা-রাশিয়া, এবং আরও নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল। দেং রাজীবকে বলেছিলেন, তিব্বত সম্পর্কে নেহরুর অবস্থানের কারণে '৬২ সালের যুদ্ধ হয়। এখন তো আমরা চাই আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা তুলুক, ভারত তা সমর্থন করুক। নটবরের ডায়েরি থেকে এসব জানা যায়। তবে রাজীবের চিন সফরও ছিল কিয়দংশে অমীমাংসিত। রাওয়ের সঙ্গে লি পেংয়ের যখন দিল্লিতে বৈঠক হয়, তখনও তিব্বত নিয়ে ভারতের অবস্থান বদলায় নি। যেমন কাশ্মীর নিয়ে চিনও অবস্থান বদল করেনি। তবে এই ধারাবাহিক আলোচনার প্রক্রিয়া জীবিত থাকায় যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় নি।
১৯৮৮ সালের পর ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয় চিনের সঙ্গে। প্রত্যেক চুক্তিতেই বলা হয়েছে, সীমান্ত বিবাদ নিরসনে আলোচনা চলবে। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক হোক সজীব। বাণিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে যৌথভাবে। কিন্তু চিন চুক্তি স্বাক্ষর করেও তা ভঙ্গ করে বারবার। ২০১৩ সালে ডেপসাং উপত্যকায় চিনা সেনা একইভাবে অনুপ্রবেশ করে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। ২০১৪ সালে মোদী আসার পরও চুশুল, এবং ২০১৭ সালে দোকলামে চিনা সেনা ঢোকে। ডোকলাম সংঘাত চলে ৭২ দিন। এবার ২০২০ সালে হলো সংঘর্ষ, নিহত অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা।
প্রশ্ন হলো, চিন কেন এমন করল? গোটা দুনিয়া করোনা আক্রান্ত, যখন প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে চিন-আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ, বিল গেটসও ভাবছেন আগামী দিনে প্রতিষেধক ব্যবসাই ভবিষ্যত, তা নিয়ে তাঁর সঙ্গেও চিনের লড়াই, এ অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মনোনীত ভাইরাস নিয়ে তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ভারতীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন। দুনিয়ার থেকে চিন করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টিতে বিচ্ছিন্ন। আবার চিন যতই ভারতের চেয়ে আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে থাক, করোনা নিয়ে গোটা বিশ্বে অর্থনীতির বিপর্যয় হলে চিন সেই বিশ্বায়নের প্রভাব-মুক্ত হয়ে অর্থনীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারে না।
সবশেষে দু'টি কথা বলব আপনাদের। চিন যে উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেরা, তাদের শ্রম যে সস্তা, এসব কথা আমরা সকলেই জানি। বা চিন যে বন্ড কিনে আমেরিকাকে ঋণী করে রেখেছে, সেকথাও। আবার আমেরিকা যদি চিনকে বলে বাজার বন্ধ, তবে চিনের বিনিয়োগ সমস্যায় পড়বে। শুধু মোদী নন, মনমোহন সিংও চিনে গিয়ে দু-দুবার বলে এসেছিলেন, বাণিজ্য ঘাটতির মানসিকতা চিনকে বদলাতে হবে। একদিকে চিন অন্য দেশে বিনিয়োগের নামে ডাম্পিং করবে, অন্যদিকে নিজেদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ঢুকতে দেবে না, এই কৌশল এখন চাপের মুখে। চিনের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ অবস্থাটা ঠিক কী, বা কতটুকু জানা যায়, সেটাও ভাবতে হবে।
সম্প্রতি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অ্যান লী তাঁর লেখা 'উইল চায়না'স ইকনমি কোলাপস' গ্ৰন্থে দেখিয়েছেন, বাইরে থেকে জানা যায় না, কিন্তু চিনেরও আন্তর্জাতিক ঋণ এখন ভয়াবহ। ২০১৬ থেকে চিন বাণিজ্য (ট্টেডিং) রাষ্ট্রের তালিকায় শীর্ষে। ২০১৬ সালে তারা ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু বহু বাণিজ্য সংস্থার ব্যাঙ্করাপ্টসি বা দেউলিয়া দশা, ভয়াবহ বেকারি, আর্থিক অসাম্য, মৃত্যুহারের বৃদ্ধি, দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, নাগরিক সমাজে ভাঙন, শেয়ার মার্কেটে পতন, ভূতুড়ে সংস্থার বিনিয়োগ, এসব এখন কেন হচ্ছে? আসলে ভারতে আর যাই হোক, বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা চিনের তুলনায় অনেক বেশি। একদলীয় শাসনের একনায়কতন্ত্র।
আর্থিক সংস্কারের পথে গেলেও চিন রাজনৈতিক সংস্কারের পথে হাঁটে নি বলেই তিয়ানানমেন স্কোয়ার ঘটে। তারপর চিন আরও বেশি দমননীতি গ্রহণ করেছে। ফলে চিনের অর্থনীতি 'কোলাপস্' করতেই পারে। মনে রাখবেন, ১৯৪৯ সাল থেকেই চিন মানুষের সামনে সুশাসন এবং সুখী জীবনের জলছবি তুলে ধরেছে। আজ আমরা ট্রাম্প-মোদীর যুগে 'ম্যানুফ্যাকচারড' জনমতের কথা বলছি, চিন মাও জে দংয়ের সময় থেকেই পোস্টার সংস্কৃতি চালু করে। রাস্তায় রাস্তায় বিলবোর্ড, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি বিদেশেও, এসব ছবি প্রচারিত হয়। সেসব পোস্টার দেখা যায়।
সম্প্রতি 'চাইনিজ প্রোপাগান্ডা পোস্টারস' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই কৌশল কার্যকর হয়। মিউনিখবাসী মাইকেল উলফ নামের এক ফটোগ্ৰাফার সমস্ত পোস্টার সংগ্ৰহ করে, সেসব ছবিতে যাঁদের দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে যাঁরা জীবিত, সেসব মডেলের সঙ্গে একটি চিনা টিমের মাধ্যমে যোগাযোগ করে এক অসাধারণ ইতিহাস আবিষ্কার করেছেন। অনেককে সাংহাই ফিল্ম স্টুডিওতে প্রশিক্ষণ দিয়ে পোস্টারের মডেল বানানো হয়। এও এক অসাধারণ হোলোগ্ৰাম রাজনীতি, যা আজ তথাকথিত উত্তর-সত্যযুগে দেখা যাচ্ছে। তাই চিনেরও বাধ্যবাধ্যকতা আছে।
চিন চিরকালই এমন করেছে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরমণ যখন বেইজিং যান, ঠিক সেসময়ে চিন পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায়। এ হলো চিনের পেশি প্রর্দশনের সাবেকি রাজনীতি। চিনের জাতীয় পশু হলো পান্ডা - তৃণভোজী, শান্তশিষ্ট, সুন্দর একটি প্রানী। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চিনা পুরাণের প্রাচীন প্রতীক হলো লাল-হলুদ ড্রাগন। যে কনফুশিয়াসের সময় থেকেই চিনা শক্তির প্রতীক। একে বলা হয় চিনের পান্ডা ও ড্রাগন যৌথ কৌশল। একদিকে যৌথ বার্তা, অন্যদিকে বারবার সীমা অতিক্রম করতে করতে ধীরে ধীরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বদলে দেওয়া।
আবার আমেরিকাও চিনকে দুর্বল করতে চায়, নানা ভাবে টুকরো টুকরো করে দিতে চায়। যাকে বলা হয় 'কনটেইন ডকট্রিন'। কিন্তু চিন এখন চাইছে যাতে করোনা বিপর্যয়ের আবহে ভারত-আমেরিকা অক্ষ একপেশে না হয়। আমার খুব সাধারণ জ্ঞান থেকে মনে হচ্ছে, ভারতের উচিত চিন ও আমেরিকা, দু'পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রক্ষা করা। যাতে আমেরিকার বন্ধুত্বকে সামনে রেখে ভারত চিনের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। আর যাই হোক, চিনের সঙ্গে যুদ্ধের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
শুধু মণি দীক্ষিতের কথাটা বোধহয় মনে রাখা প্রয়োজন, 'হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই' স্লোগান আর নয়, তবে ভাই না হলেও একটা দ্বিপাক্ষিক পেশাদারী ও আর্থিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে উচিত কাজ। তার জন্য সর্তক থাকতে হবে চিন সম্পর্কে, অথচ বন্ধুত্বের পথেও এগোতে হবে। অর্থাৎ বাগানে গাছগাছড়ার পরিচর্যা করতে হবে, গাছে জলও দিতে হবে, কিন্তু গাছে সাপ থাকতে পারে, এটাও মাথায় রাখতে হবে। এবং সেই সাপ সম্পর্কে সাবধানতা রক্ষা করেই গাছের পরিচর্যা করতে হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন