Advertisment

রাজনীতিনামা: এনআইএ সংশোধনী বিল পাশ, সকলের এক রা!

সাধু অসীমানন্দ বা সাধ্বী প্রজ্ঞা যখন বলে, বলপ্রয়োগে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল তখন তা গ্রাহ্য হয়। কিন্তু টাডা আইনে ২৫ বছর ধরে বিনা বিচারে আটক ১১জন নির্দোষ মুসলমানের জীবনজীবিকা ধ্বংসের দায় রাষ্ট্র নেয় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NIA

ফাইল ছবি

জুলাই ৫, ২০১৯। লোক সভায় পাস হয়ে গেল ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি (সংশোধনী) বিল। তারপর রাজ্যসভা।  অনেকেই স্মরণ করছেন ১৯১৯ সালে পাস হওয়া কালা কানুন রাওলাট আইনকে - যে কোনো ভারতবাসীকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে বিনা বিচারে যতোদিন ইচ্ছা আটকে রাখা যাবে, বিচারের প্রহসনের পর যা খুশি শাস্তিও দেওয়া যাবে। অনেকের মনে ফিরে আসছে পরবর্তী কালেও এই দেশে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনগুলির কীভাবে অপব্যবহার হয়েছে সেই স্মৃতি।

Advertisment

বিপুল ক্ষমতায় নতুন ভাবে সজ্জিত এনআইএ এই ক্ষমতা অপব্যবহারের নতুন নজির গড়বে এই আশঙ্কায় যখন গলা চড়ছে বিরোধীদের, তখন সংসদে উঠে দাঁড়ালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দুহাত নেড়ে নস্যাৎ করে দিলেন সেই আশঙ্কা। বললেন মোদী সরকার ধর্মীয় ভিত্তিতে এর অপব্যবহার তো করবেই না, বরং একে হাতিয়ার করে দেশ থেকে নির্মূল করবে আতঙ্কবাদের রমরমা। উলটে কংগ্রেস পরিচালিত গত ইউপিএ সরকারকে শাহ একহাত নিলেন, কারণ তার মতে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী পোটা এক্টকে তুলে দেওয়া খুবই অনুচিত হয়েছে। পোটা এবং এনআইএ - এই  যৌথ জাঁতাকলে পড়লেই নাকি এদেশ সন্ত্রাসমুক্ত হতো। অমিতের মতে অন্য কোন কারণে নয়, পোটা আইন তোলা হয়েছিল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক অটুট রাখতে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সংখ্যালঘুর ভোট বজায় রাখতে।

দেখা যাচ্ছে গদিতে বসা সরকার বা গদিচ্যুত বিরোধী, এনআইএ নিয়ে একটি পয়েন্টে এরা একমত। এই এজেন্সি অনেকরকম উদ্দেশ্যসাধনের হাতিয়ার হতে পারে, যেমন ভোট কুড়োনো অথবা রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণ। শুধু যে উদ্দেশ্যে এই এজেন্সি গড়া হয়েছিল, আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সেই উদ্দেশ্য সফল করবার ক্ষেত্রে এর অবদান কতটা সে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

আরও পড়ুন, মানবাধিকার বিরোধী জোড়া আইনে শিলমোহর সংসদে, প্রতিবাদই একমাত্র পথ

সংসদে অমিত শাহ বনাম আসাউদ্দিন ওয়াইসির তর্কযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন- এই সংশোধনী এনে তিনি কাউকে ভয় দেখাতে চান না। কিন্তু যাদের মনে ভয় ঢুকেই আছে তাদের জন্য তিনি আর কিই বা করতে পারেন !

সবাই বুঝবে, আবার টার্গেট করা হলো সংখ্যালঘুদের। তবে কি এনআইএ একটি সংখ্যালঘুবিরোধী এজেন্সি ? আতঙ্কবাদ দমনের নামে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দমন করবার হাতিয়ার ? শান্তির সময়েও একটি যুদ্ধকালীন অশান্ত বাতাবরণ সৃষ্টি করা, যাতে ভয়ের জুজুকে সামনে রেখে অবাধে চালানো যায় একচেটিয়া শাসন কায়েম করবার ব্লুপ্রিন্ট ?  প্রতিবাদের কলরোল নিস্তব্ধ করে দেবার একটি চতুর পরিকল্পনা ?

উল্টেপাল্টে দেখা যাক এই সম্ভাবনাগুলোকে।

ইংরেজ আমলে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে দানবীয় আইনের মোকাবিলা করা এক কথা, আর স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সেই একই রাস্তায় হাঁটতে দেখা আরেক অভিজ্ঞতা। কিন্তু বাস্তবে তাইই তো হলো। পাঞ্জাব ইন্সারজেন্সির পর টাডা, পার্লামেন্ট এটাকের পর পোটা আইন নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। ইউএপিএ এক্টও কোন ব্যতিক্রম নয়। শুধু সন্দেহের বশে কাউকে আটকে রাখা,  আইনী কোন সাহায্য তার কাছে পৌঁছাতে না দেওয়া, সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা এ সবই লাগাতার ঘটে চলেছে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ এই আইনগুলো সবই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। শুধু কঠোরতর করা হয়েছে একটার পর আরেকটির বজ্রমুষ্টি।

মুম্বাই বিস্ফোরণের পর ২০০৮ সালে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে এই ধরণের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে তদন্ত করবার সম্পূর্ণ ভার দেওয়া হয়েছিল। এই কারণে খুবই দক্ষ পেশাদার কর্মতৎপর অফিসারদের নিয়োগ করা হলো, অনেক বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা হলো যেখানে ফয়সালা দ্রুত হবে। কাশ্মীর ছাড়া গোটা দেশে সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ এই এজেন্সির আওতায় এল। ইউএপিএ আইনের সাথ দেবার জন্য ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে বিপুল ও প্রশ্নহীন ক্ষমতার অধিকারী করে গড়ে তোলা হয়।

তাহলে আবার সংশোধনে ব্যস্ত কেন বিজেপি সরকার? কী কী পরিবর্তন এলো সংশোধনের পর?

সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন ইউএপিএ- র ছত্রছায়াতে তদন্ত সংস্থা এনআইএ ক্ষমতার অপব্যবহার করছে কিনা তা বোঝার আর কোনো উপায় রইল না। কারণ পাঁচ বছর বাদে বাদে এদের কার্যকলাপ নিয়ে এতোদিন সংসদে যে রিপোর্ট পেশ করবার বাধ্যবাধকতা ছিল এবার বিজেপি সরকার প্রথমেই তার বিলুপ্তি ঘটালো।

এতোদিন দেশের ভেতরে তদন্তের অধিকার থাকলেও এখন থেকে বিদেশেও যদি ভারতীয়দের বা ভারতীয় দূতাবাসের  ক্ষতি চেয়ে কোন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ হয় তাহলে এন আইএ সেখানে তদন্ত করতে পারবে। আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়া হল এই এজেন্সিকে যাতে দেশে এবং বিদেশে সন্ত্রাসীদের মাজা ভেঙে দেওয়া যায়। জাল টাকা, মানুষ পাচার, সাইবার টেররিজমকেও এন আই এ-র তদন্তের আওতায় আনা হলো। এছাড়া দেশের সেশন কোর্টগুলিকে প্রয়োজনে নিজস্ব কোর্টে পরিবর্তিত করতে পারার ক্ষমতা পেলো এই এজেন্সিকে।

হঠাৎ শুনলে মনে হবে এ তো বেশ কথা।  সংসদে রিপোর্ট পেশ না করলেও মাথার ওপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের খবরদারি তো থাকছেই। অন্য পরিবর্তনগুলো নিয়েই বা এতো শোরগোল কেন!

আরও পড়ুন, আধারের আঁধারে আলোর হদিশ

কিন্তু তলিয়ে দেখলে আরো অনেক প্রশ্ন উঠে আসবে। হয়তো অনেকের মনে থাকবে এক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট অতিথি হয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে এসেছিলেন কিছুদিন আগে। অতিথি বটে, কিন্তু যে হোটেলে ছিলেন তার ব্যবসা লাটে তুলে খোলনলচে অব্দি বদলে দেওয়া হয়েছিল। শুধু গেট জুড়ে ব্যারিকেড নয়, আমেরিকান গার্ড, রান্নাঘরের দখল নেওয়া আমেরিকান রাঁধুনি, এমনকি পান করবার জলের বোতল অব্দি আমেরিকান। এখন আমেরিকায় যদি কোন ভারতীয়ের ওপর বা ভারতীয়ের দ্বারা কোনো টেরর এটাক হয়, তাহলে অন্যের সার্বভৌমত্ব সর্বদা ক্ষুণ্ণ করা এই চূড়ান্ত দাদাগিরির দেশ ভারতীয় সরকারকে অনুমতি দেবে তো সে তদন্ত নিজের হাতে তুলে নেবার ?  নাকি ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মায়ানমারে সেখানকার সার্বভৌম সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের প্রতিপত্তি দেখানো সম্ভব বলে শুধু সেই সেইখানেই আমরা এই এজেন্সিকে ব্যবহার করব ? আমাদের প্রধান টার্গেট কি চিরবৈরী পাকিস্তান ? জন্মদিনে বিরিয়ানি ভাগাভাগি করেছে বলে পাকিস্তান কি নিজের সীমানার ভেতর ভারতীয় এজেন্সিকে তদন্ত করতে দেবার চুক্তিতে সুখী স্বাক্ষরকারী হবে? একতরফা এইরকম সংশোধনী এনে অন্য দেশে "ঘুসপেটিয়া" রাজনীতির দাবা খেলার চেষ্টা কি জায়েজ ? আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন আছে তো। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত সবসময়ই একঘরে। এই অছিলায় দাদাগিরি বাড়লে একাকীত্বও বাড়বে। চাই কি যুদ্ধ বাঁধবার সম্ভাবনাও। হাঙ্গামা বাঁধিয়ে নির্বাচনে জয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া গেলেও, সেটা কোন দেশের সত্যিকারের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

এতো গেল দেশের বাইরে। একতরফা ক্ষমতা দেশের ভেতরে প্রয়োগ করতে গেলেও ঝামেলা আছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথতার সীমানা টপকে যদি রাজ্য তদন্ত করছে এইরকম কেসগুলিকে উন্নততর এনআইএর হাতে কেন্দ্র  তুলে দেয়, তাহলে কোর্ট কাছারির ঝামেলা হতে বাধ্য। ফেডেরালিজমের ধারণাকে আঘাত করা মানে সংবিধানবিরোধী কাজ করা।

আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: সুস্থতার দিকে… রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতা

এছাড়াও এই চেষ্টা এ দেশের গণতান্ত্রিকতা বিরোধী। অনেকদিন ধরে বিনাবিচারে শুধু আতঙ্কবাদী সন্দেহে অভিযুক্তকে আটকে রাখতে পারে এই এজেন্সি। দেশের কোথাও সেই আটকে রাখা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার অধিকার কারো নেই। তারপর প্রলম্বিত বিচার বা বিচারের নামে প্রহসন তো রইলই। এখন "শহুরে নকশালরা" সবাই নাকি আতঙ্কবাদী, প্রায় পঙ্গু অধ্যাপক সাইবাবা, অশীতিপর ভারভারা রাও অথবা  বস্তারে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া মাওবাদীরাও তাই। আসল কথাটি হচ্ছে সিংহাসনের বিরাগভাজন হলেই কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কপালে নাচতে পারে এনআইএ-র চাবুক, একথা এখন দিনের আলোর মতো সত্যি। জেলে পচে মরেন সঞ্জীব ভাটের মতো সৎ পুলিশ অফিসার। এরপর যদি এঁকেও সন্ত্রাসী আইনে চালান দেওয়া হয় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।

বন্দীর মানবিক অধিকারের দফারফা ঘটানো এই  দানবীয় এজেন্সিকে তাই অপছন্দের লোকের ওপর প্রতিশোধের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হবে না, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার করা হবে না এমন নিশ্চয়তা, এমন ভরসা অমিত শাহের পক্ষে দেওয়া সম্ভবই নয়। তুলসীদাস প্রজাপতি, সোহরাবউদ্দিন কেস বা জাস্টিস লোয়া কেসে আশিরনখ ডুবে থাকা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই সবচেয়ে ভালো জানেন এই এজেন্সির গোপন এজেন্ডার চরম কারিকুরি। কারণ এনআইএ-র সর্বময় কর্তা হচ্ছে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।

যতবার জঙ্গিদের আঘাত নেমে এসেছে ততবারই যান্ত্রিকভাবে তার মোকাবিলার চেষ্টা করেছে সরকার বাহাদুর। ঝুড়ি ঝুড়ি আইন, দমন, পীড়ন, কিন্তু সাফল্য কতোটুকু? একটা এতো ক্ষমতাবান প্রিমিয়াম এজেন্সি, অথচ আজ অব্দি সমঝোতা এক্সপ্রেস এটাক, মালেগাঁও বিস্ফোরণের সমাধানসূত্র পাওয়া গেল না। বিরক্ত বিচারকের কথায় এই এজেন্সির দেওয়া প্রসিকিউশন এভিডেন্সে এতো বড় বড় ফাঁক রয়ে গেছে যে সেগুলো অনতিক্রম্য।

সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেরও আজকাল ধর্ম হয়। তাই হিন্দু সন্ত্রাসীদের কেসগুলো যে অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হবে সেটা প্রথমবারের মতো পরিষ্কার হয় মোদাসা বম্ব ব্লাস্ট কেস,২০০৮-এর মধ্য দিয়ে। আহমেদাবাদে স্পেশাল কোর্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অপ্রতুলতা দেখিয়ে এ বছরের জুন মাসে তদন্ত বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এতে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা অভিযুক্তের কাঠগড়ায় ছিল। খোদ আরএসএসের সদস্যরা জড়িত ছিল। রমজান মাসে মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঠিক পরদিন মোটরবাইকে বিস্ফোরক ঠেসে এই আক্রমণ শানানো হয়। একজন নিহত, আহত বহু।

স্পেশাল কোর্টের নির্দেশে সমঝোতা ব্লাস্ট কেসে গণহারে মুক্তি পাওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের কোন আদালতে এপীল করেনি কেন, সেও এক প্রশ্ন।

আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার

সাধু অসীমানন্দ বা সাধ্বী প্রজ্ঞা যখন বলে, বলপ্রয়োগে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল তখন তা গ্রাহ্য হয়। কিন্তু টাডা আইনে ২৫ বছর ধরে বিনা বিচারে আটক ১১জন নির্দোষ মুসলমানের জীবনজীবিকা ধ্বংসের দায় রাষ্ট্র নেয় না। এ বছরের মার্চমাসে স্পেশাল টাডা কোর্ট এদের নিশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অথচ ভুসোয়াল পুলিশ এদের বিরুদ্ধে চার্জ দিয়েছিল যে গোটা মহারাস্ট্র জুড়ে এরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর জেহাদি। এমন নয় যে এরা সবাই মূর্খ, গরীব। এদের মধ্যে অনেক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। শিক্ষিত মুসলমানেরাও দেশকে টুকড়ে টুকড়ে করতে চায়, এইই কি প্রমাণ করবার ছিল ?

ওয়াইদ শেখকে ইউএপিএ-তে ধরা হয়েছিল মুম্বাই ব্লাস্টের পর। বিচিত্র বীভৎস অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যাবার পর তাকে নাকি "স্বীকারোক্তি" সই করতে বাধ্য করানো হয় এবং বন্দি জীবনের ৯ বছরের মধ্যে সাত বছরই তার কাটে মনুষ্যসংশ্রবহীন সলিটারি কনফাইনমেন্টে। এ এক রক্তমাংসের গণেশ গাইতুন্ডের কাহিনী !

২০১৫ তে কিছুই প্রমাণ করতে না পেরে সমস্ত অভিযোগ থেকে ওয়াইদকে মুক্তি দেওয়া হয়।

একথা তো এখন সবাই জানে ভারতীয় জেলে বন্দীর সংখ্যার বেশির ভাগই দলিত ও মুসলমান। ভারতে মোট জনসংখ্যার ৩৯% দলিত ও মাইনরিটি। অথচ পরিসংখ্যান বলছে বিচারপ্রার্থী বন্দীর মোট সংখ্যার ৫৩%ই হচ্ছে দলিত ও মুসলমান। এদের প্রথম অপরাধ এরা গরীব। দ্বিতীয় অপরাধ এরা শিক্ষিত নয়। আর কোনো অপরাধ সত্যি এদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়।  অথচ সংবিধান অনুসারে উল্লিখিত দুটি বিষয়েরই দায় বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। জীবিকার অধিকার ও শিক্ষার অধিকার। সন্দেহ কী, নতুন দমননীতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হবে এই দুই জনগোষ্ঠীর ওপরেই, কারণ এরাই সবচেয়ে সহজ টার্গেট। আর, কারো জীবন থেকে ২৫ বছর ছেঁটে দেবার দায় যখন কাউকেই নিতে হয়না, তখন কার ওপর নেমে এলো খাঁড়া তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালীদের কম ঘাঁটালেই হল।

অন্য অধিকার চুলোয় যাক, মানুষের মতো বেঁচে থাকবার অধিকারকেই সংকুচিত করে জনবিরোধী টাডা, পোটা, ইউএপিএ-র মতো আইন এবং তদন্তসংস্থা এনআইএ।  এদের বিরোধিতা করা গণতন্ত্রী ও মানবিক অধিকারবোধ সম্পন্ন মানুষের অবশ্যকর্তব্য।

কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল?  অমিত শাহের সাধের এনআইএ এমেন্ডমেন্ট বিলের স্বপক্ষে ভোট ২৭৮, বিপক্ষে মাত্র ৬। কংগ্রেস পার্টির ভূমিকা লজ্জাজনক। আর এই রাজ্যের অধিবাসী বলে নজরে লাগে তৃণমূল পার্টির দ্বিচারিতা। যে পার্টির সুপ্রিমো বিজেপি জুজুর ভয় না দেখিয়ে কোন সভা শেষ করতে পারে না, যার এম পি মহুয়া মৈত্র ঐ ফ্যাসিবাদ আগতপ্রায় বলে বিজেপির বিরুদ্ধে দেওয়া বক্তৃতায় দেশ বিদেশ কাঁপিয়ে দেয়, এমনকি এনআইএ যে আসলে ছদ্মবেশী  'ন্যাশনাল ইন্টারফিয়ারিং এজেন্সি'এই সুপ্রযুক্ত ব্যান্টার টুকুও ধার করতে হয় যে পার্টির ডেরেক ও ব্রায়েনের কাছ থেকে, সেই পার্টিও বিলের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে !

দুমুখো রাজনৈতিক দলগুলি, যাদের সবসময়েই মুখে এক, মনে আরেক, তাদের জন্য এবং কায়েমি শাসকের প্রচন্ড স্বৈরতান্ত্রিক ঝোঁকের জন্য এইদেশ অমোঘ টানে 'পুলিশ রাষ্ট্র ' হবার দিকেই এগোচ্ছে সে ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ না থাকাই ভালো।

(প্রতিভা সরকার অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

NIA Rajnitinama
Advertisment