(রাজনীতি কী সে নিয়ে একটা বোঝাপড়া আছে, সকলের নিজের মধ্যেই। সে বোঝাপড়া খুব ব্যক্তিগত হওয়াও অসম্ভব নয়, বা ব্যক্তিগতই হয়ত। নতুন এক রাজনীতির পাঠ শুরু করেছেন দেবেশ রায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য)
জীবনযাপন কাকে বলে? নিশ্চয়ই লাইফস্টাইলকে বলে না। ‘লাইফস্টাইল’ একটা ব্যবসায়িক ধারণা, সুতরাং সেই ভুল ধারণাবশত, রাজনৈতিক। কয়েকদিন আগেই আমাদের গৃহপরিচারিকার আসতে একটু দেরি হল। আমি কলকাতার সেই অঞ্চলে থাকি - যেটাকে একসময়ে শহরতলি বলা হত। আবার, ডায়গাগুলোর বেশ প্রাচীন নামও চালু আছে। আরও দশ-পনেরো কিলোমিটার দূর থেকে উনি সাইকেলে যাতায়াত করেন। বৃষ্টিবাদলের দিন জানতে চেয়েছিলাম - ‘এমন দুর্যোগে অটো করে আসা যাওয়া করলেই তো হয়।’ উনি ওঁর ছোট ব্যাগ তেকে বর্ষাতির ভাঁজ খুলে দেখালেন। বললেন, ‘তিনবার অটো বদলাতে হয়, প্রতিবারই লম্বা লাইন, ঝড়বৃষ্টির দিনে আরো বেশি।’ অর্থাৎ এ শহরে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কোনো পরিবহণ নেই।
সেদিন দেরির কারণ জানাতে বললেন, ‘পাড়ারই একটি কুকুর পাড়ারই একটা ছেলেক আঁচড়ে দিয়েছে, রক্ত বেরিয়েছে। কেউ-কেউ বলছিল - কামড়ালে ইনজেকশন দিতে হয়, আঁচড়ালে দিতে হয় না। ওঁরা কয়েকজন দল পাকিয়ে বলেছেন, ‘পোষা তো বাজারের। রক্ত তো বেরিয়েছে। ইনজেকশন লাগবে কি না ডাক্তার বলুক। পাস্তুরে নিয়ে যাও।’ শেষে এক ‘উবের’ ডেকে ছেলেটিকে আরো দু-জনের সঙ্গে পাস্তুরে পাঠিয়ে উনি আসতে পেরেছেন। ঠিকানা শুনে ‘উবের’ আসতে চায় না। চাইলেও অনেক বেশি ভাড়া বলে। পাস্তুর অবশ্য ওঁদের জায়গা থেকে খুব দূরেও নয়। এ-শহর খেটে-খাওয়া মানুষদের বিপদআপদ বোঝে না।
‘উবের’টা লাইফস্টাইলের অন্তর্গত আর দুর্যোগের দিনে অটো কমে-যাওয়া বা অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জীবনযাপনের অন্তর্গত।
আরো বছরখানেক আগে কলকাতার এক খ্যাততম বড় স্কুলে সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে রোজকার মারামারি খেলছিল। একটি ছেলে আর-একটি চেলের বাহু কামড়ে ধরে। এতটাই জোরে যে দাঁতের দাগ বসে যায় ও রক্ত বেরয়। যাকে কামড়েছে, সে আমার নাতি, আমার ভাগ্নের ছেলে। আমি খবরটা শুনেই বললাম - অ্যান্টির্যাবিজ দিতে হবে। শুনলাম - এক অত্যন্ত নামী প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, ডাক্তাররা বলেছেন, মানুষের কামড়ে র্যাবিজ হয় না। তর্ক বাড়ালাম না। শুধু বললাম, ডাক্তারের বয়স কত। পরদিন ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে (আমি গুগলনির্ভর নই) একটা রিপোর্ট আনিয়ে বোনের বাড়িতে গেলাম। সেখানে তালিকা করে দেয়া আছে ও ব্র্যাকেটে ‘রেয়ার’ও লেখা আছে। কিন্তু এ কথা লেখা নেই আমার নাতি ‘রেয়ার’ হতে পারে না।
র্যাবিজ, সাপের কামড় - ইত্যাদির প্রতিরোধক ইনজেকশন, কলকাতার সরকারি হাসপাতালে পাওয়া যায় না। বেসরকারি খুব নামী হাসপাতালে পাওয়া যায়, অসম্ভব বেশি দামে। এই ব্যাপারে মানুষজন সরকারি হাসপাতালকে বিশ্বাস করেন বেশি। এমন সন্দেহও করেন যে নামীদামী হাসপাতাল জালি ইনজেকশনও দিতে পারে, রশিদও দিতে পারে ও সে-রশিদে ইনজেকশনের যা নাম লিখবে, তাতে, পরে প্রমাণ করা যাবে না যে তারা অ্যান্টি র্যাবিজ ও অ্যান্টি ভেনমই দিয়েছিল। নামীদামী হাসপাতাল আমাদের লাইফস্টাইলের অন্তর্গত, মেডিক্যাল ইনসিয়োরেন্সের দৌলতে। আর সরকারি হাসপাতাল আমাদের জীবনযাপনের অন্তর্গত। র্যাবিজ বা গোখরো সাপের কামড়ের তো কোনো ইনসিয়োরেন্স হয় না।
ভারতে ২০১৭ তেই র্যাবিজই একমাত্র সংক্রমণ, যার হয়েছে, সে আর বাঁচে নি - ১০০ শতাংশই মৃত্যু। বিপদটা আরো, আরো, আরো বেশি এই কারণে যে সংক্রমণের প্রথম লক্ষণই জীবনের শেষ লক্ষণ। লক্ষণটা চিনতে চিনতেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। কিন্তু সংক্রমণটাকে যথাসময়ে প্রতিহত করতে পারলে দুটি ক্ষেত্রেই নিরাপদ জীবন ১০০ শতাংশ নিশ্চিত। যে-অবধারিত মৃত্যুকে নিশ্চিত রোখা যায়, তা রুখতে না-পারা অপরাধ।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের কলম: নিরাজনীতি (দ্বিতীয় পর্ব)
এই অপরাধের কারণ নিহিত আছে জীবনযাপন ও লাইফস্টাইলের মধ্যে ধারণা বিপর্যয়ের ভিতর। ঠিক তাও নয়। জীবনযাপনের ন্যূনতম শর্তকে লাইফস্টাইলের ন্যূনতম শর্ত না- করে তোলার মধ্যে।
সল্টলেক তো কলকাতার নতুন বসবাসের জায়গার মধ্যে সবচেয়ে বড় শহর। সরকারি অফিস ও ব্যবসার জায়গাও। সল্টলেকের অধিবাসীদের মধ্যে একটা শ্রেণিসাম্যও আছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলতে যে-আয়ের লোক বোঝায়, তাদের কারো জায়গা নেই সল্টলেকে। অথট সল্টলেকে পথ কুকুরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে সন্দেহ হয়। এতই বেশি যে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে একতলার বৈঠকখানায় বসে পথকুকুরদের সমবেত ডাকাডাকিতে গল্পগুজব করতে পারছিলাম না। ফেরার পথেই দেখি, এক বাড়ির, কর্ত্রীই হবেন, সেই কুকুরের পালকে রাতের খাবার দিচ্ছেন। যত্ন করে। অথচ সল্টলেকের সরকারি হাসপাতাল এখনো পূর্ণায়তন নয়। সেখানে অ্যান্টি র্যাবিজ বা অ্যান্টি ভেনম পাওয়া দুর্লভ। ২০১৬-তে ভারতে র্যাবিজে মারা গেছেন ৪৩২০ জন। পৃথিবীতে ১৩, ৩৪০ জন। মানে, দুনিয়ার তিনজন র্যাবিজআক্রান্ত মৃত ব্যক্তির একজন- ভারতীয়। এই বর্ষা নেমেছে - জাপানি এনকেফালাইটিস, সোয়াইন ফ্লু, ইত্যাদি নিয়ে আমরা যুক্তিসঙ্গত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠব। ঠিক এই কারণেই সন্ত্রস্ত হব। সেই ভয়ের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে জীবনযাপনে জনস্বার্থের সচেতনতা। এইখানে নিরাজনীতি। যে- রাজনীতি তার অগ্রাধিকার ভুলে থাকে।