১৯৪৭ সালে যে জন্মেছিল, সে আজ সময়ের হিশেবেই ৭১ বছরের বৃদ্ধ। এই মানুষটির কথা কিন্তু আমাদের জানাই নেই।
ধরা যাক্, সেদিন, সেই ৭১-বছর আগের ১৫ আগষ্ট, যে বালক বা বালিকার বয়স ১০, অর্থাৎ এখন যে ৮১ বছরের বৃদ্ধ, তার কথাও কিন্তু আমাদের জানা নেই।
সেদিন, সেই ৭১-বছর আগের ১৫ আগষ্ট, যে যুবক বা যুবতীর বয়স, ২০, অর্থাৎ এখন যে ৯১ বছরের অতিবৃদ্ধ, তার কথা আমাদের কিছু-কিছু জানা ছিল—মিহির সেন, সত্যপ্রিয় ঘোষ, ও আরো কারো-কারো গল্প-উপন্যাসে। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে—‘স্বাধীনতার স্বাদ’। আরো কিছু-কিছু লেখায়।
কিন্তু সেও তো ঠিক জানা হয়ে উঠল না আমাদের কাছে। যদিও সাহিত্যের ভিতর দিয়ে জানাই সঠিক জানা। যাঁরা গল্প লেখেন, তারা তো আসলে সামনে যা ঘটছে, তার চাইতে অনেকটা বেশি দেখতে পান। কিন্ত অনেক সময়, খুব ধোঁয়া-ধুলোয় বা গন্ডগোলে যা দেখছি, তা ঠিক-দেখা হয় না।
নরেন্দ্রনাথ মিত্র তেমন লেখক যিনি তাঁর ছোট-গল্পে আমাদের দেখিয়েছিলেন—সময়ের বদলে যাওয়ার নিশানা। মেয়েরা চাকরি করছে। পূর্ব বঙ্গের মেয়েরা কলকাতায় ও শহরতলিতে এসে প্রথম আমাদের দেখাল—মেয়েদের বেরতে হচ্ছে, বাধ্যত, অনিবার্যত। সেই মহাসন্ধিক্ষণের কথা ধরা থাকল, অনেক পরে, ঋত্বিক ঘটকের দুটি ছবিতে মাত্র—কিন্তু সে-ছবি এমন দুর্বল কাহিনীকে নির্ভর করে করা। যে ক্যামেরা আর ছাপা-হরফের বিরোধ বড় বেশি স্পষ্ট ও রূঢ় হয়ে থাকল।
দেবেশ রায়ের নিরাজনীতির সব কটি পর্ব পাওয়া যাবে এই লিংকে
সত্যি কথা বড় বেশি সত্য হলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। সেই অবিশ্বাস্য সত্যটা এই যে স্বাধীনতা মানে যে উদ্ধাস্তুর মহাবন্যা এটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের হিশেবেই ছিল না। স্বাধীনতা যখন আসে নি, কিন্তু প্রায় যেন গেছে, দেশভাগের সিদ্ধান্ত যখন হয়েই গেছে, তখন বাংলার কংগ্রেস নেতা ও হিন্দু মহাসভার নেতারা গোপন ও প্রকাশ্য সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিলেন অন্তত মধ্যবঙ্গের একটা ছোট টুকরোও যদি রক্ষা করা যায় পাকিস্তান-হওয়া থেকে।
আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল এক কিম্ভূত উপায়ে। ও বাধ্যতায়। ব্রিটিশরা একে স্বাধীনতা বলেই না। বলে, ক্ষমতা হস্তান্তর। ‘স্বাধীনতা’ বললে তো স্বীকার করতে হয়, তারা ভারতবর্ষকে ‘অধীন’ রেখেছিল। আর অধীন রাখার অর্থ তো—আর্থিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে ‘অধীন’ রাখা। ব্রিটিশ ও পাশ্চাত্য-ঐতিহাসিকরা তো ‘সাম্রাজ্যবিস্তার’-কে সভ্যতার বিস্তার বলেই ভাবেন। মার্ক্স একটু অন্য ভাষায় বলেছেন—‘ইতিহাসের অচেতন মাধ্যম’। বোধহয়, এটাই মার্ক্স-এর সবচেয়ে ভুল সূত্রানির্ধারণ। সামাজ্য কখনো ‘অচেতনতা’ থেকে তৈরি হয় না। একটু ঠাট্টা মিশিয়ে বলা যায়—ব্রিটিশরা অচেতনে যে-ব্রিটিশভারত হাতের মুঠোয় পেয়েছিল, সেই ব্রিটিশ-ভারতের ‘ক্ষমতা’ তারা সচেতন ভাবে ছেড়ে দিচ্ছে।
তেমন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার বড় বেশি তাগিদ ছিল ইংরেজদের। কারণ তাঁরা জার্মানির বিরুদ্ধে যুক্ত চালাচ্ছিলেন আমেরিকার কাছ থেকে ধারে অস্ত্র ও টাকা নিয়ে। আমেরিকা তো প্রথম থেকে ইয়োরোপের যুদ্ধে ছিল না। সুতরাং তাদের সুদের টাকা ও অস্ত্র জোগাতে আপত্তি কীসের। তারা প্রথম থেকেই বলে আসছিল ব্রিটিশদের—তা আমরা দিচ্ছি, কিন্তু তোমরা ভারতবর্ষকে ছেড়ে দাও।
মহাজনের কথা রাখতেই মহাযুদ্ধের মধ্যেই ক্রিপাস মিশন এল ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে স্বাধীনতার শর্ত আলোচনা করতে। কাজ এগলো না। ক্যাবিনেট মিশন এল। আমেরিকা তাদের সবচেয়ে মাথাওয়ালা কূটনীতিজ্ঞকে পাঠাল দিল্লিতে—ক্যাবিনেট মিশনকে ভারতীয় নেতাদের কিছু দাবি মেনে নেয়ার দিকে ঠেলতে ও ভারতীয় নেতাদের ক্যাবিনেট মিশনের কিছু শর্ত মেনে নেয়ার দিকে ঠেলতে। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে হল—‘সামাজ্যটা আমাদের। এর মধ্যে অন্য কোনো দেশের নাক-গলানোর কোনো জায়গা নেই। তাঁদের (অর্থাৎ আমেরিকাকে) আমরা অনুরোধ করছি আমাদের ও ভারতীয় নেতাদের কথাবার্তা থেকে সরে থাকতে’। লর্ড ওয়াভেলকে পাঠানো হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে। ওয়াভেল চেষ্টাও করেছিলেন। কেন পারেন নি, সেটা অন্য কারণ। এতদিনে সবাই জেনে গেছেন।
অবশেষে মাউন্টব্যাটেনকে পাঠানো হল, একেবারে দিনক্ষণ ঠিক করে—১৯৪৮-এর জুন মাসের মধ্যে ভারত স্বাধীনতা পাবে।
মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল হতে চান। তিনি তাঁর অতুলনীয় কূটনীতিতে ভারতের নেতাদের নিয়ে প্রথমে একটা ‘ইনটেরিম’ সরকার তৈরি করলেন। নেতাদের ক্ষমতার স্বাদ বোঝাতে। নেতারা সে-স্বাদ পেলেন। নেতাদের সম্মতিতে ঠিক হল দেশটা ভাগ হবে আর ভাগ করবেন—এক নিরপেক্ষ নতুন শাহেব—র্যাডক্লিফ।
কিন্তু কী ভাবে দেশটা ভাগ হবে তা ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’ বা ‘স্বাধীনতা পাওয়ার’ পরে ঘোষণা করা হবে। জিন্না ও নেহরু ১৪ ও ১৫ আগস্ট করাচি ও দিল্লিতে দুটি দেশহীন দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন সমপরিমাণ অসামান্য দুটি ভাষণে।
একটা দেশ দুটো দেশ হয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করল অথচ কোনো দেশই জানাল না কোনটা তার দেশ।
এমন কিম্ভূত স্বাধীনতা বা ক্ষমতা হস্তান্তর ইতিহাস দেখে নি কখনো।
উৎসব শেষ হলে র্যাডক্লিফ শাহেব তাঁর রোয়েদাদ ঘোষণা করলেন—কোনটা পাকিস্তান আর কোনটা ভারত।
তাঁর কাজ তো খুব কঠিন ছিল না। তিনি ক্যাবিনেট মিশনের প্ল্যানটাই টুকে ছিলেন।
দেশবিভাজনের সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে র্যাডক্লিফ শাহেব বিলেতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সেই কাগজপত্রগুলো পুড়িয়ে দিলেন।
আর আমরা একটা পরাধীন দেশের লোক দুটো স্বাধীন দেশ হয়ে দাঙ্গায় মেতে উঠলাম—বেলুচিস্তান থেকে আসাম। মহাদেশের মত দেশে নিজেদের পা-রাখবার জায়গা খুঁজতে।
আমরা কি জানতাম—একেই স্বাধীনতা বলে?