(এই নিয়ে ৬ সপ্তাহ। দেবেশ রায় কলম ধরেছেন রাজনীতি নিয়ে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র জন্য। প্রতিটি পর্বে তাঁর অনন্য পর্যবেক্ষণ এবং অনুপুঙ্ক্ষ লিখনের সাক্ষী থাকছে বাংলা ভাষার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ)
একটু খোলা চোখে দেখলে এটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর থেকে রাহুল গান্ধী তাঁর দলকে নতুন ধরনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও বিজেপি-বিরোধী জাতীয় রাজনীতিতে নতুন গতিবেগ আনছেন।
তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি হয়ে উঠেছে অনেক স্পষ্ট ও তাঁর প্রাথমিক লক্ষ যে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থেকে বিজেপি অপসারণ, সে বিষয়ে কোনো আড়াল রাখছেন না। ইতিমধ্যেই তিনি এটা বেশ গভীরে দাগিয়ে দিতে পেরেছেন - বিজেপিকে হারানো ও সরানোর অর্থ সেই জায়গায় কংগ্রেসের আসা নয়। যে-কোনো রকম আপোশই নীতিগত ভাবে সঠিকতম যদি সেই আপোশের এক ও অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য হয় - বিজেপিকে হারানো। রাহুল গান্ধী এই রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নির্বাচনের প্রধানতম নিয়ন্ত্রক সত্য বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন: বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলির অনৈক্য ও বিজেপির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সুযোগ - এই দুটি প্রবণতাই বিজেপির বাড়বাড়ন্তের একমাত্র কারণ।
উত্তরপ্রদেশের যে-উপনির্বাচনগুলি রাজনীতির এই হাওয়াবদল ঘটাল তার মূল কথাই ছিল - প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করো ও তার বিরুদ্ধে একজোট হও।
কিরানা নির্বাচনে কংগ্রেস সরাসরি জোট তৈরি করতে যায়নি ও লোকদলের প্রার্থীর প্রতি সমর্থনের ভিত্তি মধ্যে সেই স্পষ্টতা ছিল না, যে স্পষ্টতা ছিল ফুলপুরে-গোরখপুরে। কিন্তু নির্বাচনের বৃহত্তর লক্ষ যখন স্থির হয়ে যায়, তখন ছোটোখাটো স্থানীয় বিসংবাদ মুহূর্তে অবান্তর হয়ে যায়। রাহুল, মায়াবতী, লোকদলের নানা টুকরো, আরো সব স্থানীয় পার্টি এই সত্যটা বুঝে গেছে।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব-৫)
কর্নাটকে সেই সত্যটা প্রতিদিন পরীক্ষিত ও প্রমাণিত হচ্ছে। কংগ্রেস ও জে ডি (এস) বিধানসভা ভোটে পরস্পরের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়েছে। এই দুই দল কর্নাটকের শহর থেকে সৈকত পর্যন্ত সেই নির্বাচনী যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যে- মুহূর্তে দুই দল - কংগ্রেস ও জে ডি (এস) একত্রিত হয়ে যে সরকার তৈরির প্রস্তাব দিতে পারল, তার কারণ তো কংগ্রেস এক-পা এগিয়ে জে ডি (এস)-এর মুখ্যমন্ত্রিত্ব মেনে নিল শুধু নয়, প্রায় প্রস্তাবই করল।
কর্নাটকের এই অভিজ্ঞতাই মধ্যপ্রদেশের আসন্ন নির্বাচনে মায়াবতীর সঙ্গে কংগ্রেসের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে দিল, এমন সহজ, যেন সেটাই স্বাভাবিক। মধ্যপ্রদেশে ১৫ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের কংগ্রেস সরকার হয়নি। অথচ মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের প্রায় মিছিল। কমল নাথ, সিন্ধিয়া, দিগবিজয় সিং, সুরেশ পচৌরি, মীনাক্ষি নটরাজন, অজয় সিং। আরো কত নেতা। এত নেতা, প্রত্যেক নেতারই নিজের জায়গির আছে। অথচ মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস নেই। এর একটা ঐতিহাসিক কারণ হল - মধ্যপ্রদেশে দেশীয় রাজ্য ছিল সবচেয়ে বেশি ও জায়গিরদারি নেমে গেছে একেবারে গ্রামস্তরে। সকলেই রাজাশাহেব।
মধ্যপ্রদেশে মায়াবতীর সঙ্গে যে ঐক্যটা ঘটেছে, তার ভিৎ নিশ্চয়ই রাজ্যনেতারাই গড়ে তুলেছেন এবং নিশ্চয়ই কংগ্রেস সবাপতির ইচ্ছানুযায়ী। তার ফলেই কংগ্রেস সভাপতির পক্ষে এই ঐক্য ‘কবুল’ করার স্টাইলটাই একটা বিজয়ীর ভঙ্গি এনে দিল। এই ‘স্টাইল’টাই রাহুলকে মোদীর চাইতে অনেক এগিয়ে রাখছে।
কিন্তু এই ঐক্যগুলোর ভিতর ইতিমধ্যেই স্ব বিরোধিতা দেখা দিচ্ছে। দুটো উল্টো উদাহরণ দেয়া যায়।
শনিবার, ১৪ জুলাই, বাঙ্গালোরে জেডি(এস) দলের সমর্থকরা তাঁদের নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীকে সংবর্ধনা দিতে একটি সভা করেছিলেন। সেই সভায় কুমারস্বামী বলেন, ‘তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী হতে চাননি। বাধ্য হয়ে হয়েছেন। কিন্তু এখন এই জোট-সরকারের ভিতরের নানা কারণে তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো কোনো কাজই করতে পারছেন না। এই সরকার তাঁদের দল ও সমর্থকদের আনন্দের কারণ। কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষে যেন বিষপানের কারণ, নীলকণ্ঠের মতো।’ বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য উপস্থিত নেতারা তখন বলেন - কুমারস্বামী নিজের সরকার চালানোর ঝঞ্ঝাট থেকে আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলি বলেছেন, কোনো ভাবেই এই সরকারের অস্তিত্ব অনিশ্চিত নয়।
এর ঠিক উল্টোটা ঘটল মধ্যপ্রদেশে। মায়াবতীর সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য কংগ্রেস সভাপতি মঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গেই কমল নাথ ও সিন্ধিয়ার নিজ নিজ জায়গিরে সচিত্র পোস্টার পড়ল। ‘রাহুল ভাইয়া কি সন্দেশ/ কমল নাথ সম্ভালো প্রদেশ’। আবার, ‘দেশমে চলেগি বিকাশ কি আঁধি/ প্রদেশমে সিন্ধিয়া, কেন্দ্র মে রাহুল গান্ধী'। ওদিকে মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং তাঁর জায়গিরে এক যাত্রায় বেরিয়েছেন।
রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি হিশেবে যে-ভাষাটা তৈরি করে ফেলেছেন প্রায়, নরেন্দ্র মোদী সেই ভাষার উল্টো-ভাষা তৈরি করতে পারছেনই না, তোতলাচ্ছেন। এক ভাষণে তো দেখলাম - কাঁধ নাচিয়ে, হাতের আঙুল খেলিয়ে, ভুরু নাচিয়ে যোগেশ দত্তের কাঁচা ছাত্রের মত নীরব অভিনয়ও করছেন।
তাঁর দলের প্রাদেশিক নেতা ও উপনেতাদের রাহুল গান্ধী কোন ভাষায় বা কোন স্টাইলে বোঝাবেন - রাজনীতিটা ক্ষমতাদখলের নয়, ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে সরানোর?