ভয়
বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নিরাপত্তা এক ধাপ বাড়ানো হয়েছে-- খবরে জানা গেল।
এটা ঘটেছে ইসলামপুরে দাঁড়িভিট স্কুলের ঘটনায় গুলিতে নিহত দুই ছাত্রের মৃত্যুর পর। বিজেপির অভিযোগ ছিল দুই ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। নিহত দুই ছাত্রের মৃতদেহ সমাধিস্থ করে রাখা হয়- ভবিষ্যতে তদন্তের প্রয়োজনে যাতে দেহগুলি তুলে ময়নাতদন্ত করা যায়। ইতিমধ্যে নিহত ছাত্রদের আত্মীয়দের নিয়ে বিজেপির উচ্চ পদস্থ নেতারা দিল্লি গিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ জানাতে, সি.বি.আই তদন্ত চাইতে, মানব অধিকার কমিশনকেও জানাতে। এগুলো ঘটে গেছে ৩০ সেপ্টম্বর ও ১ অক্টোবর। কাগজের খবর এই কর্মসূচি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ অনুমোদিত।
এমন নানা রকমের ঘটনায় রাজ্যপালের কাছে প্রতিনিধিরা যান। রাষ্ট্রপতির কাছেও যান। এই স্মারকলিপিগুলি সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলির দুর্বলতার দ্যোতক। প্রত্যেকেই জানেন এ-সব ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের কোনো ক্ষমতাই নেই। তাঁরা শুধু শুনতে পারেন ও স্মারকলিপি মন্ত্রিসভার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন।
আরও পড়ুন, হিন্দুত্ব নিয়ে দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৫)
ইতিমধ্যে বন্ধ্ ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত মিটিং করে গেছেন সোমবার ‘নন্দন’-এ। রাজ্য সরকার রাজ্যের সি-আই-ডির ওপর এই মৃত্যুর তদন্তের ভার দিয়েছেন।
দাঁড়িভিটের স্কুলের ছাত্র মারা যাওয়ার ঘটনা পরম শোকাবহ। যে-বিষয়ে তদন্ত শুরু হতে না হতেই কলকাতার নাগের বাজারে স্বাভাবিক ব্যস্ততার সকালে একটা বোমা ফাটল (২.১০.২০১৮)। একটি শিশু মারা গেল। দাঁড়িভিটের ঘটনার তো একটা কারণ ছিল – যা হোক। যদিও সে-কারণ এমন মারাত্মক ছিল না যে দু-দুটি প্রাণের মূল্য দিতে হবে।
নাগের বাজারের বোমা বিস্ফোরণের তো তেমন দূরাবহ কোনো কারণই ছিল না। মানুষ জন তাঁদের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কোনো উত্তেজনা ছিল না কোথাও। হঠাৎ একটা বোমায় মায়ের হাত থেকে ছেলে ছিটকে গেল ও মায়ের শরীরও পুড়ে গেল। মা-ও বাঁচবেন কী না ঠিক নেই।
কিছু একটা কারণ পুলিশ থেকে দু-চার দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই বলা হবে। পুলিশ কখনো বলে না যে তাঁরা আন্দাজ করতেও পারছে না। তা ছাড়া আধুনিক তদন্ত বিজ্ঞান এত দূর পারদর্শী যে একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে বের করা যায়ই। নাগের বাজারের বোমা যেখানে পড়েছে তার কাছেই তৃণমূল পরিচালিত দক্ষিণ দমদম পৌরসভার একটা অফিস। সে-অফিসে সেদিন সকালে পৌরসভার চেয়ারম্যানের যাওয়ার কথা। মানে তেমন যাওয়া ওঁর রুটিনের মধ্যে পড়ে। ইতিমধ্যেই এমন কথা উঠেছে যে – চেয়ারম্যানই বোমার লক্ষ ছিলেন। হতেও পারে। নাও হতে পারে।
যে-ছেলেটি মারা গেছে বোমায়, সে এক গৃহপরিচারিকার ছেলে। ছেলেকে ফুটপাথে বসিয়ে রেখে তিনি পাশেই ফ্লাটবাড়িতে কাজ সারতে গিয়েছিলেন। কাজ সেরে বা কাজের মধ্যেই তিনি ছেলেটিকে একটু মিষ্টি খাওয়াতে এসেছিলেন। তাঁর এই হয়তো প্রায় প্রতিদিনের কাজ, রুটিন।
আরও পড়ুন, একি দুগ্গি দেখায় চাচা
সে-রুটিন তো কারো লক্ষ করার মত রুটিনই নয়। বোমা-সংক্রান্ত যা – কিছু সম্ভাব্য খবর দু-চার দিনের মধ্যে বেরবে, তার কোথাও এই মা-ছেলের কথা থাকবে না, থাকা সম্ভবই নয় – তাঁরা এতই অকিঞ্চিৎকর। তাঁদের বেঁচে থাকার কোনো ভুলে এমন শক্তিশালী বোমা ফাটার কথাই নয়। তাঁরা এতটাই, এতটাই অকিঞ্চিৎকর।
এমন অকিঞ্চিৎকরও যখন তার বেঁচে থাকার অতি সংকীর্ণ রুটিনের মধ্যে নিজেদের আঁটাতে পাড়ে না ও সেই অত্যন্ত, অত্যন্তই সংকীর্ণ জায়গাটির ওপর বোমা – বিস্ফোরণ ঘটে, তখন, আমরা মানি বা না মানি, আমরা একটা যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি। খবরের কাগজে সিরিয়ায় এখন যেমন যুদ্ধ চলছে, তেমন। বা বাগদাদে যেমন যুদ্ধ চলছিল তেমন।
অথচ আমাদের তেমন কোনো যুদ্ধ নেই।
গণতন্ত্র মানে তো বেঁচে থাকার এমন একটা অবস্থা ও ব্যবস্থা যেখানে একজন মানুষ তার মত করে বেঁচে থাকতে পারে। তার মত করে মানে – বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিয়ে তার সঙ্গে কারো কোনো বিসংবাদ ঘটতেই পারে না। প্রত্যেকটি মানুষই তো তার মত করে বাঁচতে চায়। আর, সেই বাঁচাটুকু নিশ্চিত করতেই তো আমরা গ্রাম-পঞ্চায়েতে, পঞ্চায়েত সমিতিতে, জিলা পরিষদে, পৌরসভায়, বিধান সভায়, লোকসভায় ভোট দিয়ে থাকি।
ভোটটা তো একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের নিজস্বতাকে যা রক্ষা করবে। সেই দেওয়ালটাকে রক্ষা করার জন্যই তো আমরা ভোট দি।
কিন্তু এ কেমন ভোট যে ভোটের আগেও অজানা আততায়ীয় অস্ত্রে আমাকে মরতে হবে, ভোটের পরও অজানা আততায়ীর হাতে আমাকে মরতে হবে।
সেই কবে হয়ে গেছে পঞ্চায়েত ভোট, বোর্ড পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু ক্যানিঙে তৃণমূল কংগ্রেসের নিজেদের দলের ভিতরকার মারামারি কাটাকাটি আর শেষ হচ্ছে না। ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে প্রকাশ্যে সেটা হয়ে উঠল গুলি ও বোমা ছোঁড়া ছুঁড়ির লড়াই। লড়াইটা নাকী তৃণমূলের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তৃণমূল যুব-র। ঐ দিন বিকেলে, পঞ্চায়েতে যাঁরা জিতেছেন তাঁদের সংবর্ধনার আয়োজন ছিল ক্যানিং বাসস্ট্যান্ডে। কর্মীরা মিছিল করে আসছিলেন। গোলাবাড়ি এলাকায় হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একজন বুকে গুলি খেয়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেলেন। এক জনের বাঁ হাতে, আরেক জনের পিঠে গুলি বিঁধেছে। জীবনতলা থানার ওসিও ছোঁড়া ইটে আহত হন। সবাইই জানেন তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি শৈবাল লাহিড়ী ও ব্লক যুব সভাপতি পরেশ দাশের ভিতর গোলমাল অনেক দিনের। পরেশ দাশের উদ্যোগে এই সংবর্ধনা হচ্ছিল বলে শৈবাল লাহিড়ীর দল গুলি চালিয়েছে।
একটা ব্লকের একই দলের দুটো শাখার মধ্যে যদি এমন প্রকাশ্যে গুলিবোমার যুদ্ধ ঘটতে পারে তা হলে নাগের বাজারের সেই পরিচারিকা মা ও তাঁর ছেলে তো সেই সব যুদ্ধের শিকার হবেই। কে আমাদের বাঁচাবে?
যুদ্ধ নেই অথচ প্রাণ যাবে যুদ্ধে।
দিলীপ ঘোষ তাঁর ঊর্ধ্বতর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রাণে বাঁচবেন। কিন্তু আমরা?