Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (১৭)

যাঁরা আক্রান্ত তাঁরা কিন্তু কৃষিশ্রমিক নন। কারখানার দিনমজুর ও ক্যাজুয়াল শ্রমিক। এঁরা কারখানা সংলগ্ন এলাকাতেই থাকেন। এঁদের কোনো ইউনিয়ন সংগঠনও নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

ভয়-পাওয়াটা শারীরিক প্রতিবর্ত-ক্রিয়া। কোনো কারণে শরীর শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে চায়। ভয় পাওয়াটা তো তা হলে আত্মরক্ষারই একটা উপায়।

Advertisment

আবার সেই কারণেই – হেতুহীন ভয়-পাওয়াটা শরীরের একটা আহেতুক অভ্যেস বা সেটাও একটা প্রয়োজনীয় প্রতিবর্তক্রিয়ার সক্রিয়তার লক্ষণ।

একা মানুষ ভূতের ভয় পায়। দু-জন মানুষ একসঙ্গে থাকলে মানুষ ভূতের ভয় পায় না। ছড়ায় তাই বলে, ‘রামলক্ষ্মণ সাথে আছে, করবি কী?’

মানেটা খুব স্পষ্ট। ভূতরাও জানে একা মানুষকেই ভূতে পায়।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (১৬)

ভয়-দেখানোটা যাদের কাজ, কোনো একটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য যারা ভয় দেখাতে চায়—কোনো বাড়ির দখল নিতে, কোনো জমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করতে, কোনো জমির ধান কেটে নিতে—ভয় দেখানোটা সেখানে একটা ফন্দি। তেমন ফন্দিতে কোনো একটা গ্রাম, পুরো গ্রাম উজাড় করে দেয়া যায়, মানুষ দল বেঁধে সে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে থাকে। এত মানুষ একসঙ্গে থেকেও সে-ভয় থেকে বাঁচে না। এত জন মানুষ মিলেও তখন ‘একা’ হয়ে যায়।

রাজনীতিতে এমন ভয় দেখানোটা পুরনো ফন্দি।

গুজরাতের হিম্মতনগরে গামভোই বলে একটি জায়গায় বীভৎস একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ মানেই বীভৎস। ধর্ষণ কোনো মানবিক বিকার নয়। মানুষের মধ্যে হঠাৎ সুযোগ পেয়ে একটি পাশবিকতা। দু-পায়ের ওপর খাড়া মানুষের হঠাৎ চার পা গজিয়ে ওঠে। পশু থেকে মানুষে উত্তরণের দীর্ঘ দীর্ঘ যাত্রায়—যৌনতার ঋতুবাধ্যতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে দু-পেয়ে মানুষ যৌনতাকে মিলনে পরিণত করে ও সে বলাৎকারকে বদলে ফেলতে পারে যৌনলীলায়। যে তা পারে না—সে লক্ষ-লক্ষ বছর আগের পশুই থেকে যায়।

তেমনই এক পশুত্বের ঘটনা ঘটেছে গুজরাতের ঐ গামভোই গ্রামটিতে। অপরাধী ধরা পড়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে সে বিহারের লোক, গুজরাতে জন-খাটতে এসেছে।

এই খবরটা জানার সঙ্গে-সঙ্গে আর এক পশুত্ব সক্রিয় হয়ে ওঠে। দল বেঁধে সশস্ত্র কিছু গুজরাতি, বিহারি শ্রমিকদের এলাকায় গিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমন চালাতে থাকে। গুজরাতের বাইরে নানা প্রদেশ থেকে যারা গুজরাতে জন-খাটতে যায়, তারা কিন্তু গুজরাতের প্রয়োজনেই যায়। অন্তত উত্তর ভারতে কৃষিকাজের প্রয়োজনে নিয়োজিত কৃষিশ্রমিকরা এখন সর্বভারতীয় কৃষি শ্রমিক হয়ে উঠেছে। তার প্রধান কারণ সম্ভবত দুটি। ১. উত্তর ভারতের কৃষির ঋতুর সঙ্গে উত্তর ভারতেরই অন্যান্য জায়গায় কৃষিঋতুর তফাৎ ঘটে গেছে—খানিকটা চাষের মধ্যে বৈজ্ঞানিকতা এসেছে বলে চাষ আর ঋতুবাধ্য নেই। আর তা ছাড়াও এই কৃষিশ্রমিকদের কিছুটা দক্ষতা তৈরি হয়েছে। ২. এই ভ্রাম্যমাণ কৃষিশ্রমিকদের বেশ বড় একটি অংশ নারী। ওড়িশার দক্ষিণ-পশ্চিমের কৃষিকাজে যখন প্রধানত পুরুষদেরই কাজ, তখন সন্নিহিত মধ্যপ্রদেশের পুবে মেয়েদের কাজই বেশি।

তা ছাড়াও কোনো-কোনো বড় উন্নয়ন-মূলক কাজ কোনো একটি রাজ্যে হলে সেখানেও বাইরের রাজ্য থেকে শ্রমিকেরা আসেন। বিদেশেও যান। আমি সিঙ্গাপুরের মিনি-ইন্ডিয়া পাড়ায় মালদার শ্রমিকরা রাস্তা-তৈরির জন্য মাটির কাজ (আর্থ ওয়ার্ক) করছেন দেখেছি। এই বিশেষ কাজে তাঁদের দক্ষতার খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

গুজরাতে অন্য রাজ্যের যে-শ্রমিকরা কাজ করতে গেছেন তাঁরাও এই সব কারণেই গুজরাতে গিয়েছেন। এঁদের মজুরির হার হয়তো একটু বেশি কিন্তু এঁদের জীবন যাপন করতে হয় খুব খারাপ ভাবে, কোনো রকমে অস্থায়ী আবাস তৈরি করে নিয়ে। দেশের কোনো শ্রম-আইনের নিরাপত্তা এঁরা পান না।

অথচ এই ধর্ষণের ঘটনাটাকে ভিত্তি করে উত্তর গুজরাতের গান্ধীনগর, আমেদাবাদ, পটন, সবরকাঁটা, মেহসানা এই সব জায়গায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পুষ্ট ‘সেনাবাহিনী’ এমন দাঙ্গা-পরিস্থিতি তৈরি করেছে—যে বিশেষ করে বিহার ও পূর্ব-উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকেরা নিজেদের দেশে ফিরে যাচ্ছেন প্রায় মরিয়া হয়ে। কাগজে ইতিমধ্যেই সে-সব ছবি ও খবর বেরতে শুরু করেছে।

সেই খবরের ভিতর পড়ে নেয়া যায় যে কংগ্রেসের বিধায়ক ও নেতা অল্পেশ ঠাকুরের ‘ঠাকুর সেনা’রা ও আর-এস-এস-এর কর্মীরা নানা নামে দল বেঁধে ও সংগঠিত ভাবে এমন প্রতিযোগী আতঙ্ক তৈরি করেছে যেন এই বহিরাগত শ্রমিকদের গুজরাত থেকে বিতাড়ন একটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে।

দুটি বিশেষ বিষয় কিন্তু এমন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। প্রথমত, যাঁরা আক্রান্ত তাঁরা কিন্তু কৃষিশ্রমিক নন। কারখানার দিনমজুর ও ক্যাজুয়াল শ্রমিক। এঁরা কারখানা সংলগ্ন এলাকাতেই থাকেন। এঁদের কোনো ইউনিয়ন সংগঠনও নেই। আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৫০০০।

দ্বিতীয়ত, গুজরাতের শিল্পোন্নয়নের যে কথা রাষ্ট্র হয়ে থাকে তার ভিত্তি এই বহিরাগত শ্রমিকরা। তাঁরা যে বহিরাগত তা ধরা পড়ে—এঁরা গুজরাতি জানেন না।

২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। এই লেখাটি লিখছি ৯ অক্টোবর। প্রায় পনের দিন হয়ে গেল। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেছেন।

কতটা ভয় পেলে ৫০০০-এর মত মানুষ গুজরাত ছেড়ে তাঁদের দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁদের দেশটা কোথায়? যেখানে এই ভয় পেতে হবে না? বা, একটা দু-পেয়ে পশুর পাপের মূল্য তাঁদের দিতে হবে না?

editorial Nirajniti Debes Ray
Advertisment