শুধু যুক্তি দিয়ে সমাজ-বিকাশের গতি বোঝা যায় না। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা, যেহেতু চব্বিশ ঘন্টা মানুষের সঙ্গেই ওঠাবসা করেন, তাঁদের ঘরগেরস্তির খবর রাখেন, তাই তাঁরা নিজেরা ভাবেন, তাঁদের চোখ ও কান বোধহয় সংখ্যায় একটু বেশি। আবার এর উল্টোটাও সমান সত্য। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তো বাড়ির মানুষজনের সঙ্গেও কথা বলার টাইম পান না। তাঁদের ওপর যে বিবিধ ও বিপুল চিন্তার ভার সব সময় থাকে, তাতে তাঁরা মানুষকে দেখেন শুধুই কাগজের অক্ষরের আড়াল থেকে। আইনের কাগজ। নিরপেক্ষ এক্স-রে প্লেট। তাতে গোটা মানুষ থাকে না শুধু তার অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গের ভিতরটুকু থাকে। ভুলটা হয়, এই ধারণা থেকে। যদি মনে করা যেত, আমি চোখে একটু কম দেখি বা কানে একটু কম শুনি—তা হলে হয়তো ঠিকঠাক আন্দাজ পাওয়া যেত।
একই সঙ্গে ভারতের মেয়েরা #metoo , ‘আমাকেও’, বলে যে-আন্দোলন করছেন ও কেরালার মেয়েরা শবরীমালায় সব মেয়েদের প্রবেশাধিকারের বিরুদ্ধে যে-আন্দোলন করছেন, তাকে স্বাবিবোধিতা মনে হতে পারে, প্রথম ধাক্কাতে। আমার তো তাই মনে হয়েছিল।
তার পরে ভুলটা ভাঙল, কী করে?
যে-মেয়েরা ‘আমাকেও’ বলেছেন, তাঁরা কিছু একসঙ্গে কোনো মিটিং করে বা রাস্তায় নেমে মিছিল করে এ-কথা বলেছেন না। তাঁরা তাঁর নিজের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। যাঁরা বলেছেন, তাঁরা অনেকেই সমাজে নিজের-নিজের পেশায় বেশ চেনাজানা নাম। আমাদের ভারতীয় সমাজে, বড় পরিবারের পরিবেশে একটি শিশুকেও শেখানো হয়, এ-সব কথা কাউকে বলতে নেই, যদি সে-শিশু মেয়ে হয়। সেই শিশু মেয়েটিকে জানানো হয়—তার একটা আলাদা গোপনতার জগৎ আছে। সে তার ভিতর গুটিয়ে যায়। যে-গুটনোটা এতই একান্ত যে তার মা-ও তা বুঝতে পারেন না। আর, যে-পুরুষ তার সঙ্গে ঐ জঘন্য ব্যবহার করে, সে পারিবারিক ভাবে তার অনেক বড় ও অপরিবারিক ভাবেও তার অনেক বড়। কলকাতার কয়েকটি স্কুলে শিশু-বালিকার ওপর যে-অত্যাচার করা হয়েছে, তেমন-অত্যাচার বরাবর হয়ে আসছে। আজ অভিভাবকরা যে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন সেটা আমাদের সমাজের একটা শুভ লক্ষণ।
প্রথমত, এ প্রতিবাদ সমবেত প্রতিবাদ না হলে এর কোনো মূল্যই থাকত না। ব্যাক্তিগত নালিশে যে কেউ কান দিত না, কলকাতার অন্তত একটি স্কুলের ঘটনায় তা প্রমাণিত হয়েছে। এই কারণে অধ্যক্ষাকে অপসারিত করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই সমবেত প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হয়েছে। মেয়েরা মা বা বাবাকেই প্রথম সেই আড় ভেঙে, একবারের জায়গায় দশবার ভেবে, দু-একজন ঘনিষ্ঠকে বলতে হয়েছে। সেই পদ্ধতিতে এই প্রতিবাদ তৈরি করে তুলতে হয়েছে।
এমন হতে পারে যে অভিভাবকদের যে-দুএকজন প্রথম জানলেন গোপন ভাবে তাঁরা হয়তো সেই স্কুলেই তাঁর মেয়ে পড়ে এমন কোনো বড় মানুষের কাছে গিয়ে, কী করা উচিত তা জানতে চাইলেন। সেই বড় মানুষ, খুবই মন দিয়ে খুঁটিয়ে কথাটা বুঝতে চাইলেন। অভিজাত্য; সামাজিক পার্থক্য তাঁদের পৃথক রেখেছিল। মেয়ের স্বার্থ তাঁদের এক করে দিল। অভিভাবক ও অভিভাবিকাদের মধ্যে আর্থিক ও বৃত্তিগত কারণে যে তফাৎটা থাকে, সেটা ভেঙে পড়ে।
তৃতীয়ত, আরো বড় সমাজের ভিতর বিশেষ বিশেষ স্কুল সম্পর্কে যে-অভিজাত্য-সংস্কার কাজ করে, যে-সংস্কার গড়ে তোলা হয়েছে অনেক কাল ধরে, কিন্তু বিশেষ করে গত দুই-তিন দশকে, সেই অভিজাত্যবোধ ধূলিস্যাৎ হয়। একজন বিরাট চাকুরে বা কোটি-কোটি পতি ব্যবসায়ী যদি দেখেন তাঁর শিশুকন্যাটি এক বস্তিবাসিনী মা-বাবার মেয়ের মতই বিপন্ন, তখন সেই দেয়ালটা ভেঙে যায়।
এতদিনে সবাই জেনে গেছে যে একেবারে নিরক্ষর মা-বাবাও গলায় রক্ত তুলে তাঁদের ছেলেমেয়েদের বড় স্কুলে পড়ান, তাঁদের কোচিং সেন্টারে পাঠান যাতে তাঁদের ছেলেমেয়েদের, তাদের মত জীবন কাটাতে না হয়। সমাজের এত বিস্তৃত অংশে যখন এই আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় তখন একটা সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়।
প্রথম দিকে—স্কুল কর্তৃপক্ষ কী করবেন এই নিয়ে বিদ্বল হয়ে পড়তেন। ফলে, বিক্ষোভ জমলে পুলিশ আসতই। গোপন পথে অভিযুক্তকে পুলশের গাড়িতে তুলে দেয়া হত। তাতে খানিকটা সামাল দেয়া যেত হয়তো। কিন্তু পুলিশকে কেউ বিশ্বাস করে না। আর, পুলিশে গেলেই তো ব্যাপারটা পুলিশ-কেস হয়ে যাবে ও অভিযুক্ত ‘প্রভাবশালী’ কাউকে খোঁজার সময় পাবেন।
মাত্র দুটি-একটি ঘটনার পরই এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে। কোনো-কোনো স্কুলে—এমন অভিযোগ অধ্যক্ষ/অধ্যক্ষার কাছে এলেই স্কুলের একটা কমিটিকে জানানো হবে ও অভিযুক্তকে সাময়িক ভাবে তাঁর কাজ থেকে সরিয়ে দিয়ে স্কুলই তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবে। স্কুলের স্বার্থ ও মেয়েদের নিরাপত্তায় শিক্ষক-শিক্ষিকারাই প্রধান ভূমিকা নিচ্ছেন।
এটাও যে সংকটমোচনের ভাল ব্যবস্থা নয়-তা প্রমাণ হল—এতসবের পরেও ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী স্কুলে আবার এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ এসেছে। তা নিয়ে গোলমালও হয়েছে। তবে বিশেষ ছড়ায় নি।
শিশুদের যৌনসঙ্গী করা একটি স্বীকৃত ব্যাধি, অন্তত ১৫০ বছর আগে এক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসক এই ব্যাধি আবিষ্কার করেন। কিন্তু এ-ব্যাধি সামাজিক ব্যাধি। সমাজই এ-ব্যাধি থেকে কোনো ব্যাক্তিকে সারিয়ে তূলতে পারে।
সেটা তো পরের কথা। এখন আমরা বলছিলাম মেয়েদের মধ্যে এই নতুন ধরনের প্রতিবাদ সচেতনতার বিষয়টি নিয়ে।
প্রতিবাদের যে-সচেতনতা শিশুদের রক্ষা করার জন্য অনেক সামাজিক বাধা অতিক্রম করে সংগঠিত হয়েছে, সেই একই সচেতনতা কিন্তু #metoo বা ‘আমাকেও’ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। আন্দোলন মানেই সমাবেশ নয়। একই বিষয় নিয়ে যখন সমবেত কথা ওঠে, সেটাও একটা আন্দোলন। সে-আন্দোলন মানুষের সমাবেশের চাইতেও বেশি বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে। উঠছেও। অভিযুক্তদের মধ্যে হাইকোর্টের এককালের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বর্তমান সদস্য পর্যন্ত আছেন। অভিযোক্তাদের মধ্যেও যাঁরা আছেন, তাঁরাও সমাজে ও নিজ-নিজ বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিবাদ ও অভিযোগ বিচারব্যবস্থার আত্ততার মধ্যে আসছে না। সামাজিক ব্যবস্থার আত্ততার মধ্যে আসছে।
এইখানেই এই সব প্রতিবাদের সঙ্গে শবরীমালা-প্রতিবাদের মিল। এ-প্রতিবাদ, আগের দুটি প্রতিবাদের মতই, সরকার ও আদালতের কাছে কোনো ন্যায়ের, মানে, আইনের, মানে নীতির, মানে সংবিধানের, কাছে বিচার চাইছে না। বিচার মানে তো দুই পক্ষ : অভিযুক্ত ও অভিযোক্তা। আর বিচারক মানে তো আম্পায়ার। আইনের কোনো পদ্ধতিগত লঙ্ঘন ঘটছে কী না। যেমন, দুই সাবালক পুরুষ ও নারী যদি সম্মত যৌন সম্পর্ক তৈরি করে, তাতে আইনের পদ্ধতি লঙ্ঘিত হয় না—এই পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের ‘রায়’ আছে।
‘আমাকেও’ বা শররীমালা সচেতন করে দিল : সেই ‘সম্মতি’র পেছনেও কোনো ‘ক্ষমতা’ সক্রিয় ছিল কী না। সে-ক্ষমতা আদালতের ধারার মধ্যে পড়ে না। মানবিক ধারার মধ্যে পড়ে। সেই মানবিক ধারা আদালতের ত্রক্তিযারের বাইরে। সেই মানবিক ধারা অনেক অনুভবের গভীরে। অনেক সময়ই ভাষারও বাইরে।
শবরীমালায় মেয়েদের প্রবেশের অধিকার নিয়ন্ত্রণ সংবিধানের মূল নীতির বিরোধী—এ তো একটা মামলার সূত্রেই সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারকের সংবিধানিক বেঞ্চ ‘রায়’ দিয়েছেন। তাও দু-জন একমত হয়েছেন বলে ‘রায়’ হয়েছে।
শবরীমালা-আন্দোলন জানিয়ে দিল—এতই সহজ নাকি একটি ধর্মীয় আচরণকে সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ করা? যাঁরা শবরীমালার মন্দিরে ঢুকতে পারেন না—সুপ্রিম কোর্টের রায় পেলেই তাঁরা হু হু করে ঢুকবেন? যে-সব মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকারে এমন বাধা ছিল না, সে-সব অনেক মন্দিরে মেয়েরা স্বেচ্ছায় এই অনধিকার পালন করেন। এই অনধিকার দেবতার সঙ্গে ব্যবহারের এক বিধি। দেবতা সুপ্রিম কোর্টের আওতায় আসেন না। মেয়েরাও সুপ্রিম কোর্টের হুকুমের আওতায় পড়েন না।
এই দুটি-তিনটি আন্দোলন অত্যন্ত স্পষ্ট করে দিচ্ছে আমাদের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা। এ-সবগুলি আন্দোলন করছেন মেয়েরা—যাঁরা শোষিততম। শ্রেণিনিরপেক্ষ শোষিততম। স্বাতী ঘোষ-এর একটি সাম্প্রতিক, বইয়ের নাম—‘জেনডারড প্রলেটারিয়েট’।
যাঁরা রাজনীতি করেন, যাঁরা প্রশাসন চালান ও যাঁরা বিচার করে শাস্তি দেন—তাঁদের কিন্তু চোখকান বন্ধ করার সময় হয়েছে। এখন শুধু অনুভবে বুঝতে হবে—ঝড়ের কেন্দ্র কোথায়? ‘আমার কিছুই হারবার নেই’, এমন সর্বস্বহারা উপলব্ধিতে? একজন বিপ্লবী তো তেমন কথাই বলেছিলেন প্রায় একশ বছর আগে: ‘তোমাদের তো কিছুই হারাবার নেই, তা হলে এক হও’।
সেই একতাই কিন্তু ঘটছে।