Advertisment

এবার নির্ভয়ার হত্যাকারীদের শাস্তিটা হোক

এই আইনি লড়াইয়ের খরচ কীভাবে চালিয়ে গেল নির্ভয়ার অপরাধীরা? যতদূর জানা গেছে, তারা কেউই বিশাল ধনী পরিবারের সন্তান নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
nirbhaya case

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর। এক কালো দিন। এক কালো অধ্যায়ের শুরু।

Advertisment

চূড়ান্ত পাশবিক এক অপরাধ। অপরাধীর বিচার হলো, কিন্তু শাস্তি হলো না। বিচারের  দীর্ঘসূত্রিতায় দেশের তামাম শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ লজ্জিত, যন্ত্রনায় দগ্ধ। যদিও লজ্জা নেই তাঁদের চোখে, যাঁরা এই পাশবিক কাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য দিনরাত এক করছেন।

তাঁরা কিছুতেই থামছেন না। এক কোর্ট থেকে আর এক কোর্ট, অপরাধের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন একদল আইনজীবী। আর তাঁদের এই তথাকথিত পেশাদারি কুশলতা ও উদ্যোগের কারণেই নির্ভয়ার সুবিচার পাওয়ার আশাতরী প্রত্যেকবার তীরের কাছে এসে ডুবে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: অনুপ্রেরণা নির্ভয়া, নারী সুরক্ষায় অভিনব যন্ত্র আবিষ্কার বাংলার পাঁচ যুবকের

ভারতের গণধর্ষণের কালো ইতিহাস থেকে হয়তো কোনও দিনই মুছে ফেলা যাবে না এই তরুণীর নাম। ভোলা যাবে না মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার অসম যুদ্ধ। কোনটা বেশি যন্ত্রণার? ধর্ষণকারীদের চরম পাশবিকতায় নির্ভয়ার মর্মান্তিক পরিণতি, নাকি সুবিচারের আশায় তার বাবা-মায়ের দীর্ঘ আইনী লড়াই? সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। নির্ভয়ার মা যতবার মিডিয়ার সামনে এসেছেন, ততবার তাঁর অসহায় ক্ষোভ, হতাশা, জ্বালা বিদ্ধ করেছে আমাদের। একদিকে এই ঘটনায় এদেশের কন্যাসন্তানদের সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ে সন্দেহ, আতঙ্ক বেড়েছে। অন্যদিকে এই ঘটনা ঘিরেই বিচার ব্যবস্থার ওপর ভরসা হারিয়েছে মানুষ। সব মিলিয়ে নির্ভয়া কান্ড যেন কোথাও আমাদের দিন যাপনেও দুঃস্বপ্নের দুর্নিবার থাবা বসিয়ে চলেছে।

আইনের ফাঁস, না পরিত্রাণ?

ধর্ষণকারী ছ'জনের একজন নাবালক। সেই সূত্রে প্রথমে জুভেনাইল হোম, সেখান থেকে তিন বছর পর ছাড়া পেয়ে যায় সে। আর একজন আত্মহত্যা করে, অন্তত এমনটাই বলা হয়েছে। কারণ নাকি গভীর অনুশোচনা। বাকি চার, মুকেশ সিং, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্তা ও অক্ষয় ঠাকুর। ২০১২ থেকে ২০২০, এদের শাস্তি  নিয়ে প্রহসনের নাটক চলছে। ট্রায়াল কোর্টে চার অপরাধীর ফাঁসির আদেশ হয় ২০১২-তেই।

তারপর থেকে চলছে এদের আইনী লড়াই। পাঁচ বছর এভাবেই কেটে গেছে। আইনের নানা মারপ্যাঁচ, আবেদন, নিবেদন ইত্যাদির পর ২০১৭-র মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট একই রায় দেয়, অর্থাৎ এদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। কিছুদিন আগের কথা, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন। তিনিও মুখ ফিরিয়েই থাকেন। কিন্তু না, এতে মোটেই দমেন না চার অপরাধীর আইনজীবী। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও যে শেষ কথা নয়, সেটা প্রমান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

আরও পড়ুন: সব আইনি প্রতিকার শেষ: নির্ভয়াকাণ্ডে নয়া মৃত্যু পরোয়ানা জারির আর্জি কেজরি সরকারের

সাল ২০২০, ফাঁসির দোরগোড়া 

আরও একবার ফাঁসির দরজায় ওরা চার। আগামী ২০ মার্চ ফাঁসি নির্ধারিত। দিন এগিয়ে আসতেই আবার নতুন করে প্রাণভিক্ষার নাটক শুরু। যাতে মোটেই সাড়া দেয়নি দেশের  সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, আর কোনও আইনি সাহায্য অবশিষ্ট নেই। ফাঁসির তারিখ পেছনোরও কোনও প্রশ্ন নেই। হিসেব মতো ১৭ মার্চ (গতকাল) মেরঠের জল্লাদের তিহার জেলে রিপোর্ট করার কথা। জল্লাদ এলেই শুরু ফাঁসির মহড়া।

তাহলে কি এবার সত্যি হতে চলেছে সেই বহু কাঙ্খিত শাস্তি? অত্যন্ত আক্ষেপের কথা হলেও, এখনই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, এই অপরাধীদের তিনজন নাকি এবার আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। ওদের পক্ষের আইনজীবী এ পি সিং, যিনি ইতিমধ্যেই নির্ভয়া কান্ড প্রসঙ্গে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায়। আন্তর্জাতিক আদালতে এ পি সিং-এর আবেদনের পিছনে যুক্তি প্রণিধানযোগ্য। গুরুতর এই অপরাধীদের প্রতি সুপ্রিম-প্রাণদণ্ড নাকি আদতে এদের প্রতি অবিচার। তাহলে কি আন্তর্জাতিক আদালতে আবার নতুন কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়, তা দেখার জন্য আর একটা অপেক্ষার কাল শুরু?

একরাতে বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফেরার পথে দিল্লীর বাসে কোন ঘটনার মধ্যে পড়ে নির্ভয়া, সেই ঘটনায় তার কী পরিণতি, ঘটনা পরম্পরায় সেসব আজ সবারই জানা। সেদিন প্রতিবাদে মুখর হন দেশবিদেশের মানুষ। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ তীব্র আকারে আছড়ে পড়ে প্রশাসনের দরবারে। ধর্না, মোমবাতি মিছিলে সামিল হয় অগণিত ছেলেমেয়ে। শুরু হয় বিচার। আর বিচার শুরু হতেই ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে লেখা হতে থাকে জমজমাট চিত্রনাট্যের এক-একটি দৃশ্য।

আক্ষরিক অর্থেই এহেন কোর্টরুম ড্রামা এর আগে দেখেন নি দেশের মানুষ। কখনও নাবালক ও সাবালকত্বের হিসেবে অপরাধ এবং অপরাধীর গুরুত্ব বিচার, কখনও ধনী না দরিদ্র, তার তুল্যমূল্য আলোচনা। ফাঁসি হওয়া উচিত না আজীবন কারাবাস? নাবালকের ছাড় পাওয়া উচিত না অনুচিত? এসব চর্চায় মুখর হয় আদালত প্রাঙ্গণ, মিডিয়া থেকে সমাজের অলিগলি। এত কথা হয় যে বিচারাধীন চার অপরাধীর ঠিকুজি-কুষ্ঠিও মুখস্থ হয়ে যায় সকলের। অবস্থা এমন, নির্ভয়ার ধর্ষণ নয়, এরা কী অবস্থায়, কী মানসিকতায় ধর্ষণে অংশ নিয়েছে, সেটাই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাঠে নেমে পড়ে সমাজের নীতি পুলিশের দল। মেয়েদের পোশাক থেকে আচার-ব্যবহার নিয়ে যা মন চায় বলার ছাড়পত্র পেয়ে যায় তারা।

আরও পড়ুন: দেওয়ালে মাথা ঠুকে রক্তাক্ত নির্ভয়ার ধর্ষক, ‘চিনতে পারছে না’ নিজের মাকেও

নির্ভয়ার পরিবারের কথা ছেড়েই দিলাম। তাঁরা তো নরকযন্ত্রনা ভোগ করছেন। দেশের আম জনতা, যাঁরা এই চার অপরাধীর কঠিন শাস্তি প্রত্যাশা করেন, তাঁরাও হতাশায়, বিরক্তিতে জর্জরিত হয়েছেন। বারবার শাস্তি ঘোষিত হয়েছে। বারবার নতুন চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে ওদের বাঁচানোর। প্রত্যেকবার শাস্তির দিন এগিয়ে এসেছে। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় প্রহর গুনেছেন নির্ভয়ার পরিবার। সঙ্গে দেশের মানুষ। প্রত্যেকবারই সব প্রত্যাশায় জল ঢেলে নব কলেবরে সেজে উঠেছে নির্ভয়া মামলার নাটক।

নারীধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বিশ্বে নতুন কিছু নয়। গড়ে রোজই একাধিক ঘটনা ঘটে। লিখতে লজ্জাবোধ হয়। তবু নির্মম সত্য স্বীকার করে বলতে হয়, এখন আমরাও যেন অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই ঘটনাক্রমে। তা সত্ত্বেও কেন নির্ভয়া কান্ড আমাদের আলাদা করে এত ভাবায়? কারণ এর নৃশংসতা। নাবালক হিসেবে যে জুভেনাইল হোমে যায়, সে কেমন করে এমন জান্তব কাণ্ডের ভাগিদার হয়? পবন, যে বারবার প্রাণভিক্ষা করে বলছে, ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল, তার নাবালকত্বের পরিমাপ কি নিছক বয়সের হিসেবে করা যায়?  সর্বোপরি বিচারের নামে এই প্রহসন! কোথায় এর শেষ?

এই প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এতদিন ধরে এই আইনি লড়াইয়ের খরচ কীভাবে চালিয়ে গেল নির্ভয়ার অপরাধীরা? যতদূর জানা গেছে, তারা কেউই বিশাল ধনী পরিবারের সন্তান নয়। তাহলে কে বা কারা এদের অর্থ যোগাচ্ছে? যে আইনজীবী তাদের হয়ে সওয়াল করলেন, তাঁর কাছে পেশার তাগিদ কি মানবিকতার উর্দ্ধে? এটা যুক্তির ক্ষেত্রে খুব শক্ত না হলেও উল্লেখ্য। কারণ, কিছুদিন আগেই আর একটি ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণকারীর পক্ষে আইনজীবীরা দাঁড়াতে অস্বীকৃত হন। এটাও কিন্তু এদেশেরই ঘটনা।

এখনই এ নাটকের কোরো না বিচার

এই চার অপরাধীর মনস্তত্ব নিয়েও ভাবনার অবকাশ আছে। বার বার প্রাণভিক্ষার নাটক প্রমাণ করে, কোথাও কোনও অনুশোচনা এদের ভারাক্রান্ত করে না। এমন লোকেরা সুযোগ পেলে এই কান্ড আবার ঘটাবে না, এর গ্যারান্টি আছে কি?

অন্তিম লগ্নে পৌঁছে এহেন প্রশ্নে পাঠকও নিশ্চয়ই আলোড়িত হচ্ছেন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সারা বিশ্ব উত্তাল। তা সত্ত্বেও নির্ভয়ার অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার গুরুত্বকে কোনও অংশে ছোট করে দেখার নয়। আমাদের সকলের ঘরেই নির্ভয়ারা আছে। তাদের সুরক্ষার প্রশ্ন, মারণ ভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে কিছু কম জরুরি নয়। বিষয়ের গুরুত্ব কতখানি তার প্রমাণ এত বছরে নির্ভয়ার অপরাধীদের শাস্তি না পাওয়া এবং এই ঐতিহাসিক বিচার চলাকালীনই একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়া। ধর্ষণকারীরা কতটা নির্ভয়ে সমাজের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এক 'উন্নাও' কান্ডই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

সব শেষে নির্ভয়ার বাবা-মায়ের কথা। পৃথিবীর সবাই সব ভুলে যাবে একদিন। আবেগ ও উন্মাদনার মোমবাতি মিছিল তো কবেই থেমে গেছে। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে এই দু'টি মানুষ প্রহর গুনছেন বিচারের আশায়। অসহায় অপেক্ষায় দিবারাত্র কাটছে তাঁদের। এবার এই অপেক্ষা শেষ হোক। আসুন, আমি, আপনি সবাই নিজেদের চাওয়াটাকে মিলিয়ে দিই ওঁদের প্রার্থনার সঙ্গে। কারণ, নির্ভয়ার অপরাধীরা এরপরও যদি পার পেয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী থেকে বিশ্বাস শব্দটা হারিয়ে যাবে চিরতরে।

(লেখিকা বর্ষীয়ান সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment