Advertisment

পিছিয়ে যাচ্ছে ফাঁসি, অপেক্ষায় অধীর জনতা

ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়েও এই নিয়ে প্রচুর সওয়াল-জবাব হয়েছে যে ফাঁসি নাকি পদ্ধতি হিসেবে একেবারেই ভালো নয়, বরং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য অন্য কোনও কম যন্ত্রণার উপায় ভাবা হোক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
nirbhaya rapists hanging

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

খবর বিক্রি হয়। আর বেশি করে বিক্রি হয় মৃত্যু কিংবা দুর্ঘটনার সংবাদ। সেই মৃত্যু ফাঁসি হলে তো কথাই নেই। ফাঁসুড়ের জন্মবৃত্তান্ত থেকে দড়ির ব্যাসার্ধ এবং দৈর্ঘ্য, সবকিছু নিয়েই আলোচনা চলে প্রচুর। এক্ষেত্রে একাধিক মানুষকে সরকারি আয়োজনে মারা হবে। তাই সমাজের উল্লাস চেপে রাখা শক্ত। মোটের ওপর মানুষ হিংস্র। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিংস্রতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

Advertisment

ছোট্টবেলার ইস্কুলে পাশের ছেলেটা বেঞ্চিতে বসার সময় জায়গামত একটা ছুঁচলো পেনসিল সোজা করে রাখে অন্য দুষ্টু। সেখান থেকে বিষয়টা হাসপাতাল এবং থানা পর্যন্ত গড়ায়। তবে তার থেকেও অনেক বেশি আলোচনা করেন অভিভাবক অভিভাবিকারা। জড় পেনসিল কত ইঞ্চি প্রবেশ করেছিল, গোটা ঘটনাটা প্রাণঘাতী হতে পারত কিনা, দোষী ছেলেটিকে সেই একই শাস্তি দিলে তবেই ব্যাটা বুঝত ঠিক কেমন লাগে, ইত্যাদি আলোচনায় ইস্কুলের পাশের গলিতে চায়ের আসর জমজমাট।

এমন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমাদের দেশে শীত চলে যাচ্ছে, এদিকে ফাঁসি এখনও হচ্ছে না। তুমুল অপেক্ষায় ভারতের প্রাণপিপাসু নাগরিককুল। কয়েকদিন অন্তত নাগরিকত্ব সমস্যা ভুলে থাকা। কথা ছিল জানুয়ারি মাসের বাইশ তারিখ চারজনের ফাঁসি হবে, কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে তা নাকি পিছিয়ে হবে ফেব্রুয়ারির পয়লা।

ফাঁসি ব্যাপারটায় গিঁটের গোড়ায় জীবনবিজ্ঞান থাকলেও, বাকিটা পুরো সমাজবিদ্যা। মাঝখানে আইন কিছুটা আছে, তবে সে তো আর স্থির সিদ্ধান্ত পেশ করে না। বিভিন্ন পরিস্থিতির ওপর বিচার করে অপরাধের মাত্রা নির্ধারিত হয়। ফলে স্থান, কাল, পাত্র এবং ঘটনাপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে একই অপরাধের ভিন্ন শাস্তি। সাধারণভাবে, যে কোনও ধরনের অত্যাচারের পর আক্রান্তের মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রেই অপরাধীর শাস্তির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ পরিকল্পনা করে অপরাধে সামিল হতে পারে দোষী, আবার অনেক সময় ঘটে যেতে পারে মুহূর্তের ভ্রান্তি। কোথাও রাজপথের পাশে, কোথাও বা ফাঁকা বাসে। সবশেষে যে মরল আর যে মারল, সেই দুজনেরই সমস্যা সবচেয়ে বেশি। মৃতের তাও ঝামেলা চুকল, আসামীকে পচতে হবে জেলখানায়। বড়জোর তাদের কাছের আত্মীয়স্বজনের কিছুটা কষ্ট হবে, কিন্তু বাকি বিশ্বের কাছে গোটা বিষয়টা চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। বিতর্ক বিশ্লেষণে সময় কাটানোর রসদ।

অর্থাৎ সে খবর কিভাবে উপভোগ করা হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। সবাই তো আর দেশনেতা, জনপ্রিয় অভিনেত্রী, নামকরা লেখিকা কিংবা বিখ্যাত খেলোয়াড় নন। তাই কোনও এক সাধারণ মানুষের মৃত্যু তার পাশের জনাকয়েকের জন্যে দুঃখের, সংখ্যাটা বড়জোর কুড়ি। আর হয়ত শ-দুয়েক প্রতিবেশী ভিড় জমায়, কাকেদের মতো। মৃত্যু যদি হয় নিয়ম মেনে, তাহলে সেটা খবর হয় না মোটে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সংখ্যার ওপর নির্ভর করে গুরুত্ব।

একজন পথচারীর মৃত্যু, পাঁচতলা থেকে ঝাঁপ মারা একটা আত্মহত্যা, গৃহবধূর গায়ে আগুন, এসমস্ত টেলিভিশনে দশ সেকেন্ডের খবর হয় আর ছাপার হরফে তিরিশ শব্দ। সংখ্যা বাড়লে খবরের বহর বৃদ্ধি পায়। ট্রেন দুর্ঘটনায় শ-খানেক প্রাণহানি দিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা পার করা যায়। সঙ্গে কেউ যদি তোবড়ানো কামরায় আটকে থেকে আর্তনাদ করে তাহলে তো কথাই নেই। আধুনিক ভারতে গভীর গর্তে শিশু তলিয়ে গেলে অবশ্য কম সংখ্যাতেও কাজ হয় বেশি। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তাই বাজার আছে।

তবে সংবাদ-খাদক মানুষের তার চেয়েও বেশি উৎসাহ অপরাধের ক্ষেত্রে। নিহত এবং হত্যাকারী, এই দুদিকেই যথেষ্ট তথ্যের রসদ থাকে। নারী-পুরুষ সম্পর্কিত খুনের ঘটনা অবশ্যই জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারিতে। কলঙ্ক, কুৎসা, অপবাদ, অখ্যাতি, কেলেঙ্কারি ইত্যাদি যত বেশি করে পাঁচফোড়নের মত ছড়িয়ে দেওয়া যায়, স্বাদ ততই ছুঁতে চায় আলটাকরা। ঝট করে মৃত্যুর মধ্যে যেটুকু সংবাদের রসদ, তার চেয়ে অনেক বেশি মৃতপ্রায় শরীরকে এয়ার-অ্যাম্বুলেন্সে উড়িয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায়।

নৃশংস অত্যাচারের খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্যে যে খাদ্য এবং সংস্কৃতি আমাদের জঠর এবং চৈতন্য ভরায়, তাকে অস্বীকার করার এতটুকু অবকাশ নেই আজকের দিনে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চারজনের ফাঁসি পিছিয়ে যাওয়ায় দেশের সজাগ জনগণ যে কিছুটা হতাশ হবেন, তা বলাই বাহুল্য। আশার আলো যে ঘটনাটা কদিন পরেই ঘটবে। এই যেমন আজকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা। দুসপ্তাহ পিছিয়েও শেষমেশ হচ্ছে তো।

সঠিক শাস্তি হলো বলে তৃপ্তি পাবেন একদল, আবার আসামীদের মৃত্যুতেও কেউ কেউ চুকচুক করে উঠবেন। তবে চিমটি কেটে আর একবার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে অত্যাচারিত এবং তাঁর অতি নিকট আত্মীয়-স্বজন ছাড়া আপামর জনসাধারণের কিন্তু সেই দুঃখের ভাগ নেওয়ার কোন দাবি নেই। যতই মিছিল হোক, কিংবা জলকামানের মুখে বুক চিতিয়ে অপরাধীর শাস্তি চান প্রতিবাদী মানুষ, তাঁরা যে অতিশয় শোকার্ত, এই দাবি কিন্তু অতিকথন। সেখানে জনগণের ক্ষোভ একেবারেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। তাতে মনকষ্টের কোন চিহ্ন থাকার কথাই নয়, বরং পুরোটাই অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ উপভোগ করার একটা উপায়। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আইনসঙ্গতভাবে হত্যা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা তাই সভ্য সমাজে বকধার্মিকতার এক অসাধারণ উদাহরণ।

প্রথম বিশ্বের দেশ শোনাবে গ্যাস চেম্বার, ইলেকট্রিক চেয়ার কিংবা বিষ ইনজেকশনের উপায়। গভীর আলোচনা হবে কোনটায় কষ্ট কম তাই নিয়ে। গ্যাস চেম্বারে নাকি আগে সংজ্ঞাহীনতা, পরে মৃত্যু। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব অভিজ্ঞতা সেকথা বলে না। আজ থেকে ষাট বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় ক্যারিল চেসম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় গ্যাস চেম্বারে। শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি সাংবাদিকদের বলে যান যে কষ্ট হলে মাথা ঝাঁকাবেন। সেই মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান যে বেশ কয়েক মিনিট ধরে তীব্র স্পন্দনহারে মাথা দোলান ক্যারিল।

বৈদ্যুতিক আরামকেদারায় নাকি চটজলদি কাজ শেষ। এদিকে নিন্দুকেরা বলেন অন্য কথা। শরীরের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঝলসে যায় বীভৎসভাবে। মৃত্যু মুহূর্তে ভীষণভাবে কাঁপতে থাকে তড়িদাহত শরীর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের সময় বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়ার প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

বিষ ইনজেকশনের শুরুতে শিরায় প্রবাহিত হয় নির্দোষ নুনজল। তারপর অনুভূতিনাশক সোডিয়াম থিওপেন্টাল, সংজ্ঞাহীনতার পথে হাঁটার শুরু। পেছনেই আসে প্যানকুরোনিয়াম ব্রোমাইড। শরীরের প্রতিটি পেশীকে করবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, থামিয়ে দেবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। শেষমেশ পটাশিয়াম ক্লোরাইড বন্ধ করে দেবে হৃদপিণ্ডের লাবডুব। তবে অন্য কথাও আছে। বিষ-সূচ যদি শিরায় ঠিকঠাক পথ খুঁজে না পেয়ে পেশীতে মুখ বাড়ায়, তাহলে ভীষণ কষ্ট পান মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি।

ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়েও এই নিয়ে প্রচুর সওয়াল-জবাব হয়েছে যে ফাঁসি নাকি পদ্ধতি হিসেবে একেবারেই ভালো নয়, বরং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য অন্য কোনও কম যন্ত্রণার উপায় ভাবা হোক। তবে নিয়ম এখনও বদলায় নি। সামনের কদিন এই নিয়ে আলোচনা জমবে ভালোই। তবে ঐ যে, হপ্তাখানেক পিছিয়ে গেল ফাঁসি। মানবাধিকারের খাতায় চারজনের একসপ্তাহ মানে মোট আঠাশটা ম্যান-ডে। মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশটা অন্য অনেক রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে উল্টো করে ঝুলিয়ে পাথর ছুঁড়ে তো আর আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে না। উপসংহার - ভারতবর্ষে ফাঁসি আইন মেনে এবং বেশ যত্ন সহকারে দেওয়া হয়।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

death penalty
Advertisment