গত কয়েকদিনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অজস্র আলোচনার মধ্যে যে বইটির নাম বারবার উঠে এসেছে, সেটি হল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর নোবেলজয়ী সঙ্গিনী এস্থার ডাফলোর লেখা পুওর ইকনমিক্স বা দরিদ্র অর্থনীতি। এ বইতে অর্থনীতি ও গণিতের জটিল তত্ত্ব নেই। ঝরঝরে প্রাঞ্জল ভাষায় এ বই সামনে নিয়ে এসেছে একের পর এক প্রশ্ন তার সহজ উত্তর।
প্রথমত এই কথাটা মনে রাখতে হবে যে দারিদ্র্য অর্থনীতি এবং দরিদ্রদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনীতির মধ্যে ফারাক অনেক। দারিদ্র্য অর্থনীতি মনে করে দারিদ্র্যের একমাত্র কারণ আর্থিক দৈন্য এবং তাই দারিদ্র্যদূরীকরণ নীতির মাধ্যমে যে করে হোক ওই দরিদ্রদের হাতে খানিকটা অর্থ তুলে দিতে হবে। মনে করা হয়, ধনীদের হাতে টাকা বাড়লে যেমন তারা জিনিস কেনে ও ভোগ করে, দরিদ্ররাও ওই একই জিনিস একই ভাবে কিনবে ও ভোগ করবে। আসলে কিন্তু দরিদ্রদের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই যে তাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যে কোন জিনিস কিনলে তাদের স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। তাই সরকার নিখরচায় টীকাকরণ কর্মসূচি পালন করলেও অনেক পরিবারই তাদের শিশুদের টীকা দেওয়ায় না। টীকা না দিলে কী ফল হতে পারে, সেটা তারা জানে না, জানে ইঞ্জেকশন দিলে বাচ্চার গায়ে ব্যথা হয়, তারা জ্বরে কষ্ট পায়। এমনকি নিজেদের জ্ঞান সম্পর্কে অনিশ্চিত হওয়ার দরুন, অনিশ্চয়তা তাদের আটকে রেখে দেয় বিনামূল্যের স্বাস্থ্য পরিষেবাও গ্রহণ করতে।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: অর্থনীতির নোবেলজয়ীদের কাজকর্মের খুঁটিনাটি
দ্বিতীয়ত, দরিদ্রদের জীবন বড় বেশি জটিল। তারা পাইপের জল পায় না, তাই সরকার জল পরিস্রুত করলে তার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। তারা সঞ্চয় করার সুযোগ পায় না, কারণ তাদের বাড়ির কাছে ব্যাঙ্ক নেই। তারা সরকারি ঋণ পায় না, কারণ বন্ধক দেবার মত কোনও সম্পত্তি তাদের নেই। তাদের হাতে টাকা দিলেও তারা অর্থকরী ব্যবসা করতে পারে না, কারণ তারা ঝুঁকি নিতে অক্ষম।
তৃতীয়ত, কয়েকটি জিনিসের বাজার দরিদ্রদের জন্য কাজ করে না। সেসব জিনিস, যেমন ঋণ বা বিমার সুযোগ তারা নিতে পারে না তথ্যের অভাবে। তাই নিচের ডালের ঝুলন্ত ফল ছেডে় তারা উপরের অগম্য ডালের দামি ফল কেনার প্রচেষ্টা চালায়। নিখরচার স্বাস্থ্য পরিষেবা ছেড়ে বেসরকারি পরিষেবা চায়। সরকারি ফ্রি স্কুলের বদলে তাদের ভরসা থাকে প্রাইভেট টিউটরের উপর, কারণ নিরক্ষর মা-বাবা প্রথম শ্রেণির শিশুকেও পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারেন না।
চতুর্থত, দরিদ্ররা সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে, কারণ তাদের বোঝানো হয় যে কারা অপারগ, তাদের ক্ষমতা কম। শিক্ষক বা শিক্ষিকা বুঝিয়ে দেন গরিব ছাত্রটি বুদ্ধিমান নয়, আর সে কথা বুঝে সেও ক্রমাগত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। সে বিশ্বাস করতে শুরু করে পড়াশোনা তার জন্য নয়।
দরিদ্রদের এই ব্যবহার, তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা তাই দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে ফেলে রাখে। আর্থিক সাহায্য তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সমাধান দিতে পারে না। আসলে এ কথা অনস্বীকার্য যে আমরা অদরিদ্ররা মনে করি দরিদ্রের অপুষ্টি কমাতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। যেমন, ফল, দুধ, ভাতের ফ্যান, ছাতু। আর আমাদের শিশুরা একই সঙ্গে খাবে যা পুষ্টিকর, লোভনীয় এবং মুখরোচক। ভুলটা এখানেই। নোবেলজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডাফলো তাঁদের বই পুওর ইকনমিক্সে দেখিয়েছেন, দরিদ্র বাবা-মা শিশুর হাতে তুলে দেয় মুখরোচক খাবার- শিশুদের খুশিমাখা মুখ দরিদ্র বাবা-মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু এনে দেয়।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: গণিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না কেন?
অভিজিৎ ও এস্থার তাঁদের সেন্টারের সহযোগিতায় বহু বছর ধরে দারিদ্র্য সম্পর্কিত এই গবেষণা করেছেন। তৃণমূল স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেছেন কোন সমস্যার জন্য ঠিক কোন নীতি গ্রহণযোগ্য হবে। এই সব ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের জন্য তাঁরা পরীক্ষামূলক পদ্ধতি বা এক্সপেরিমেন্টের সাহায্য নিয়েছেন। বিশেষত ওষুধ নিয়ে গবেষণার জন্য ব্যবহৃত Randomised Control Trial (RCT) তাঁরা প্রয়োগ করেছেন অর্থনীতির গবেষণায়। এই পদ্ধতিতে নতুন একটি নীতির প্রয়োগ করা হয় লক্ষ্যহীন(Random) ভাবে। সেক্ষেত্রে যাদের উপর প্রয়োগ করা হল এবং যাদের উপর প্রয়োগ করা হল না, তাদের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য থাকে না। তাই ওই নীতির প্রয়োগের ফলে ফলাফল (Outcome)-এর প্রভাব শুধু ওই নীতির জন্যই হবে বলে মনে করে নেওয়া হয়। ব্যাপারটা একটু সহজ করে বলা যাক। স্বাস্থ্যনীতিতে জননী সুরক্ষা যোজনায় দরিদ্র মহিলাদের প্রসূতিকালীন পরিষেবা ও হাসপাতালে শিশুদের জন্ম দেবার জন্য টাকা দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও দেখা যায় কিছু মানুষ এই সুবিধা নেন, বাকিরা নেন না। তার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিছু মহিলা, যাঁরা সুবিধা নিলেন না, তাঁদের হয়ত কাছাকাছি এমন কোনো হাসপাতালই নেই যেখানে প্রসবের ব্যবস্থা আছে। অথবা শিক্ষার অভাবে তাঁদের বাড়ির লোকেরা মনে করেন এসবের কোনও প্রয়োজনই নেই ও তাঁরা বাড়িতে দাই মা-র কাছে শিশুর জন্ম দেন। এই দুই ধরনের মহিলাদের জন্ম দেওয়া শিশুদের স্বাস্থ্য সূচক যদি নীতির ফলাফল হয়, তবে তাদের মধ্যে যে তফাৎ সেটা নীতির প্রয়োগ ছাড়াও তাদের শিক্ষা, পরিমণ্ডল, স্থান এ সবকিছুর উপর নির্ভর করবে। ফলত, সে তফাৎ শুধু যে ওই নীতির কারণেই ঘটছে, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এই অসুবিধা সরিয়ে দিতে যদি এমন করা যায় যে পরীক্ষামূলকভাবে একদল সমান আর্থ-সমাজিক অবস্থার মহিলাদের মধ্যে এই সুযোগ Random ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হল, ফলে এই মহিলাদের মধ্যে যারা এই সুযোগ পেল তারা তা নিল এবং হাসপাতালে শিশু প্রসব করল। বাকিরা শিশুর জন্ম দিল বাড়িতে। এবার শিশুদের স্বাস্থ্যসূচক শুধুমাত্র এই সুযোগ ও সুযোগের ভিত্তিতে করা হল। RCT-র ব্যবহারে মূলত এইভাবে পরীক্ষামূলক উপায়ে নতুন দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতি নির্ধারণ করা যায়।
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান গুরুতর, কী ভাবে মাপা হয় এই সূচক?
যদিও বেশ কিছু প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এই ধরনের পরীক্ষার সমালোচনা করেছেন, একথা মানতেই হয় যে এই নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ অর্থনীতিতে করার মাধ্যমে অধ্যাপক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডাফলো নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণে শুধু অর্থসাহায্য করা নয়, ছোট ও সঠিক পরীক্ষামূলক নীতির উপকারিতা আফ্রিকা থেকে এশিয়া সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ীদের আসল জয় এখানেই। তৃণমূল স্তরে সঠিক নীতিগুলি প্রয়োগ করা সহজ ও তার থেকে ফলও পাওয়া যায়।
এক কথায়, অভিজিৎ-এস্থারদের কাজের মূল মন্ত্র হল দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতি নির্ধারণ। স্থান, সে জায়গার স্ংস্কৃতি, বিশ্বাস, সব কিছুর উপর নির্ভর করবে এই নীতি। শুধু অর্থসাহায্য করে দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য দূরীকরণ অসম্ভব বলেই মনে করেন তাঁরা। আর এই কাজে নতুন প্রয়োগ পদ্ধতির ব্যবহার তাঁদের সাফল্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সব শেষে বলার, তাঁদের এই কাজ, গতবছরের নোবেল বিজয়ীর Nudge বা সামান্য একটু চাপ সংক্রান্ত আচরণগত পরিবর্তনের সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। দরিদ্ররা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারবেন, তখনই পাল্টাবে তাঁদের অবস্থা, তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারবেন দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে।
(অরিজিতা দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক)