তপোধীর ভট্টাচার্য
বড় অদ্ভুত সময়ের আবর্তে রয়েছি আমরা সবাই। পৌর সমাজ ভঙ্গুর, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, কেন্দ্রচ্যুত। সবচেয়ে বড়ো কথা, উজ্জ্বল দিনগুলিকে পিছনে ফেলে এসে রাজনৈতিক সমাজের লেজুড় হয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে- অন্ধকার ছিলাম, অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকব। তবে কি এ সময় ‘ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে?’ নইলে যখন পাইকারি হারে মানবাধিকার লুণ্ঠিত হয়, দখলদারি মনোভঙ্গির বিরুদ্ধে খবরের কাগজে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরে লেখকের মুণ্ডপাতসহ মামলা হয়- আমরা কেন পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকি- ঘুমোতেই থাকি? কোথায় গেল তবে ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা!
কথাগুলি বিশেষভাবে মনে এল আসামের সাম্প্রতিক হালহকিকত দেখেশুনে। বহুভাষিক এই প্রান্তিক রাজ্যে ইদানিং প্রকাশ্য গর্জন শোনা যায়, আসামে সংখ্যাগুরু ভাষার ‘প্রভুত্ব’ মেনে নিতেই হবে। হ্যাঁ, ‘প্রভুত্ব’ শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয়ে থাকে। বাংলা, হিন্দি, নেপালি, বোড়ো, ডিমাসা, কার্বিসহ বেশ কিছু ভাষাব্যবহারকারী মানুষ আসামে কয়েক কয়েক শতাব্দি ধরে বাস করছেন। অসমিয়াদের সঙ্গে স্বাভাবিক সহাবস্থানে কোথাও কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব থেকে ভূপেন হাজারিকাকে হৃদমাঝারে রেখেছেন এঁরা সবাই। সংস্কৃতির শর্তই তো তাই, দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, য়াবে না ফিরে। যেমন আসামে তেমনই ভারতে।
কিন্তু সভ্যতার মূল কথা যে সহাবস্থানের নীতি, তাকেই আসামে নস্যাৎ করা হচ্ছে। বিনাবাধায় একতরফাভাবে প্রচারিত হচ্ছে জাতিবিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতার মহামারীতে আক্রান্ত এমনকী বিবেকবান সম্মানিত জনও। না, এ বড়ো সুখের সময় নয়। নইলে আসামের রাজনৈতিক সমাজ কি এমনভাবে পৌরসমাজকে যুক্তিহীন বিদ্বেষে, উগ্র মতান্ধতায় সংক্রামিত করতে পারত? এই মুহূর্তে অনেকেই বুঝতে পারছেন না হয়তো। কিন্তু সব কিছুই ঘটছে, বলা ভালো ঘটানো হচ্ছে ভোটের নিপুণ অঙ্কে। ইচ্ছেমতো লোকগণনার সরকারি পরিসংখ্য়ান পর্যন্ত দুমড়েমুচড়ে ব্যবহার করে ‘সত্য’ ‘উৎপাদন’ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এতসব প্যাঁচপয়জার বোঝে না। তারা ভাবে ‘বিদেশি’গুলিকে তাড়াতে পারলে আরো একটু স্বস্তির সঙ্গে বেঁচে থাকা যাবে।
কিন্তু যারা দিনের পর দিন গণমাধ্যমে জাতিবিদ্বেষের ধোঁয়ায় ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের সহজ বিশ্বাস তাদের খেয়াপারানির কড়ি। আসাম জুড়ে তাই অনসমিয়া ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীগুলি বিপন্ন- বাঙালির তো কথাই নেই। এই সেদিন পর্যন্ত সর্বভারতীয় গণমাধ্যমগুলি ছিল আসামের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে পুরোপুরি নির্লিপ্ত। কদিন হলো একটু আধটু নড়েচড়ে বসছেন তাঁরা, কিন্তু মগ্নশৈলের চূড়ামাত্র তাঁদের নজরে পড়ছে। দেশে-বিদেশে মানবাধিকার কর্মীরা এবং সংকটের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে বিশ্ববিবেক জাগাতে চেষ্টা করছেন। অতিবৃদ্ধ মানুষদের পর্যন্ত রেয়াত করছে না প্রশাসন, রুগ্নজন-নারী-প্রৌঢ়-শিশুদের পর্যন্ত পুরে দিচ্ছে বন্দিশিবিরে। অথচ বৈষয়িক বিবেচনায় আসাম প্রশাসনকে চটাতে চাইছেন না যাঁরা, তাঁদের কাছে ইহুদি-রোহিঙ্গাদের মতো রাষ্ট্রহীন হওয়ার আশঙ্কায় ত্রস্ত লক্ষলক্ষ বাংলাভাষীর সংকটও কোনো ‘খবর’নয়।
আরও পড়ুন, অসম থেকে যাতে কেউ না ঢোকে, নজর রাখতে বললেন মমতা
ব্যাপারটা কী? সবাই জানেন ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’নবায়ন হচ্ছে আসামে। ভারতের অন্য কোথাও নয়। গিনিপিগদের নিয়ে পরীক্ষা সফল হলে ত্রিপুরায় হবে, পশ্চিমবঙ্গে হবে। নিজ বাসভূমে পরবাসী হতে কেমন লাগে, আত্মবিস্মৃত বাঙালিরা তখন বুঝবেন। আপাতত ঘুঁটে পুড়লে গোবর হাসুক। সবচেয়ে মুশকিলে পড়বেন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকজনেরা কারণ তাঁদের জীবিকা সামান্য বা অনিশ্চিত। নুন আনতে যাঁদের পান্তা ফুরোয়, তাঁরা এনআরসি-র কাগজপত্র পাবেন কোথায়? কল্যাণকামী রাষ্ট্রে কিন্তু এসব সর্বহারাদেরও থাকবার অধিকার রয়েছে। অথচ সরকারি বাবুরা তাদের নাম-ধাম-বয়স-বাবারনাম-পদবি ইত্যাদি লিখতে ভুল করছেন কিনা, এই নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু আজকের নির্মম আসামে এইসব ‘ভুল’-এর সূত্র তাঁদের পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ‘ডি-ভোটার’ করছে। আর নতুন ফরমান অনুসারে ‘ডি(ডাউটফুল) ভোটার’ করছে। জন্মানোর একবছরের মধ্যে যদি বার্থ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা না হয় তাহলে তার নাগরিকত্ব বাতিল।
নামে ‘জাতীয়’ আসলে প্রাদেশিক নাগরিকপঞ্জী। যদি তাতে ৭১ বছর ধরে পুষে রাখা অকারণ ক্ষোভ-সন্দেহ-ক্রোধ প্রশমিত হয়, মন্দের বালো বলে ধরে নেবষ কিন্তু তাতে কি জাতীয় সংহতি অক্ষুণ্ণ থাকবে? এমনিতে নানা কারণে দেশজুড়ে বিভাজনপন্থীরা সক্রিয়। তার ওপর যদি লক্ষলক্ষ অসহায় মানুষের নাগরিক অধিকারসহ মানবাধিকার ছিনিয়ে নেয় ভাষিক প্রভুত্ববাদ, দেশে-বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি কি ম্লান হবে না?এত বড়ো দেশ আমাদের, তাকে তো কখনও নিছক মানচিত্র ভাবিনি। দেশ মানে নানা ধর্মের নানা ভাষার নানা সংস্কৃতির বিচিত্র মানুষ- তাও কি ভুলতে হবে?
আসামে যদি সভ্যতার, মানবিকতার মূল ভাবনা আক্রান্ত হয়- দুনিয়ার দরবারে কি আমাদের প্রত্যেকের মুখ পুড়বে না? ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলিই তো এখনও ‘এনআরসি’ কথাটা অজানা। আমজনতা ভাবতেই পারে, লাগাতার অপপ্রচারে বাঙালিমাত্রই যেহেতু ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত- লাখলাখ ‘বিদেশি’দের আবর্জনার মতো ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে যখন ভালোই তো হচ্ছে। কিন্তু এরা তো কুকুর-বেড়াল নয়, ঝরাপাতাও নয় যে ‘বিদায়’ করা যাবে! কোথায় যাবে এত মানুষ? নাৎসি জমানার ছাঁদে বন্দিশিবির তৈরি করলেও কত লক্ষ মানুষ সেখানে ঠাঁই পাবে? সবচেয়ে বড়ো কথা, অবিভক্ত ভারতের সন্ততি এরা, ভারতেরই এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যদি বাসস্থান পাল্টেও থাকে- এরা আলবৎ ভারতীয়। বাংলা ভাষায় (এবং অন্য কোনো সংখ্য়ালঘুর ভাষায়) এরা কথা বলে, এই অপরাধে তাদের মানুষের যথার্থ মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে দেওয়া যাবে না? মনে গভীর আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, ভারত সরকার কেন ঠুঁটো জগন্নাথ? কেন প্রাদেশিকতাবাদের উন্মত্ত তাণ্ডবকে তাঁরা প্রশ্রয় দিচ্ছেন?
ইতিমধ্যেই আরও কিছু মৌলিক প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আপন ভাষিক অস্তিত্বসহ গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলা প্রভুত্ববাদীদের কাছে অপরাধ কেন? যদি বিশেষ কিছু গণমাধ্যম দিনে-রাতে উগ্র বিদ্বেষ ও আক্রোশে ভরা অপপ্রচার চালিয়ে যায়, কেন সরকার তখন জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা নেয়? কারও বক্তব্য যদি পছন্দ না হয়, পাল্টা যুক্তি দিয়ে বিবাদি বয়ান তৈরি করা, এই তো সভ্য সমাজের স্বীকৃত রীতি। লেখকের স্বাধীনতা মানব না, রে রে করে তেড়ে আসব, কুৎসার সুনামি বইয়ে দেব, এবং সর্বশেষে আগাপাশতলা মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি করে লেখককে শূলে চড়াতে চাইব- এতে কি ভারতের, উদার, সহিষ্ণু ও উচ্চচিন্তীর পরম্পরা রক্ষিত হচ্ছে? জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিক হওয়ার পর আর এক মাস সময় থাকার কথা আবেদন করার জন্য। তখনও যে প্রতাপপন্থীরা নানাভাবে হস্তক্ষেপ করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই এ কেবল আসামের নয়, ভারতেরও পরীক্ষা।