Advertisment

শরণার্থী বনাম অনুপ্রবেশকারী

পুজো প্যান্ডেলে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অভয় নিয়ে আপাতত দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠাই মঙ্গল। একটু মনে রাখবেন যে এনআরসির গল্প শুরু আসাম নিয়ে, রাজীব গান্ধীর আমলে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ফাইল ছবি

সংজ্ঞা নিয়ে এখন ভীষণ আলোচনা। কারণ সংজ্ঞা ঠিক না হলে কোন কিছুই প্রমাণ করা যায় না। নড়াচড়া বন্ধ করে সংজ্ঞা স্থির হলে তখন তাদের বলে স্বতঃসিদ্ধ। আর তার ওপর ভিত্তি করেই ঠিক হয় কোনটা ত্রিভুজ আর কোনটা সামান্তরিক। সেই নিয়মেই সংজ্ঞা ঠিক করে দেবে আজকের হোমরা চোমরা নেতানেত্রী আর তারপর নির্দিষ্ট হবে আপনি দেশে থাকবেন নাকি লম্বা তাঁবুতে। এই তাঁবুর চারধারে পোঁতা হবে কাঁটাতারের বেড়া। সকালের বিয়োগ থেকে বিকেলের যোগ, রাতের নাকডাকা থেকে ভোরের দাঁতমাজা, সবই চালু থাকবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। নিজের ঘর যাবে, ঠিকানা যাবে, পরিচয় যাবে। তো এসব বলে বৃদ্ধ অমলবাবুকে সকালবেলা চায়ের দোকানে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছিল কিছু তুলনায় যুবাবয়সী বাঙালি। বাজারের ধারে চা শিল্পী পটলাদা অবশ্য বেজায় চিন্তিত।

Advertisment

কারণ তৃণমূল আর বিজেপি দুদল থেকেই তাকে রোজ শুনিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে এনআরসি কিংবা সিএবি যাই হোক না কেন, তাকে বাঁচিয়ে দেবে দুজনেই। পটলাদা জানে যে রাজত্ব বদলালেও সন্ধের দিকে লাভের কিছুটা অংশ দলকে দিতে হয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর কুড়ি এখন পঞ্চাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারতের জাতীয় মুদ্রায়। তার ওপর পাড়ার দাদারা চায়ের পয়সা দিলেও, বিস্কুট ফ্রি। সেই জায়গায় মাঝে মাঝেই কিছু তিন অক্ষরের ইংরিজি শব্দ তাকে বেশ বিপদে ফেলে দিচ্ছে। নেতাদের অক্ষর সংবাদমাধ্যমে বড় হরফে ছাপা যায়, কিন্তু নেতাদের উদ্দেশে জনগণের চার অক্ষর সবসময়েই দুই ডেসিবেলের নিচে। স্নিগ্ধ সুরে সেই মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে ফুটপাথে এই দোকানেই সারাদিন কাটে, আর তারপর পেছনের ভাঙা চালায় পরিবারের রাত। একটু দূরে জনগণের স্বচ্ছ ভারতে ত্যাগ আর দুপুর-রাতে চায়ের দোকানের ভাঙা বেঞ্চিতে চটজলদি ভাত-ডালের ভোগ। শুধু আধারের চক্করেই মোট সতেরো দিন দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। ভোর থেকে লাইন, কখনও চোখের মণি বিগড়ে যাচ্ছে, কখনও আঙুলের ছাপ মিলছে না, কখনও ঠিকানা হারিয়ে যাচ্ছে ছায়াপথে। দাঁতভাঙ্গা উচ্চারণে সিএবি বেশি কিছুদিন “ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল” ছিল, আজকাল “সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ড বিল”। এক একটা বিলের সঙ্গে ছোট, মাঝারি, বড় নেতার বিল্বপত্রের ব্যবস্থা হয়। অনেকগুলো শূন্য বসিয়ে একটা ছোট অঙ্ক করে দিয়েছে পটলাদার রাস্তার ধারে বাইক সারানো ছেলে সারথি। পশ্চিমবঙ্গের তিন কোটি মানুষকে যদি নাগরিকপঞ্জীর গল্পে সামান্য গুলিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে গড়ে হাজার খানেক টাকা করে পার্টি ফান্ডে চাঁদা তোলা যায়, তাহলেই তিন হাজার কোটি। দলের নাম যাই হোক না কেন, তিন হাজার কোটিতে সংসার চলে যাবে অনেক জনদরদী পার্টিনেতার।

পটলাদার গল্পে অমলবাবু কাগজ পড়তে পড়তে পিছিয়ে পড়েছিলেন। তাই তিন হাজার কোটির হিসেবেও তাঁর বিশেষ হেলদোল হল না। তবে দোসরা অক্টোবর ছশো টাকা কিলো দরের খাসি আর দুশো টাকা কিলোর রসুন কিনে তাঁর এমনিতেই সংসারের ওপর বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল। তাই জোরগলায় তিনি স্বাগত জানাতে শুরু করলেন এনআরসি-কে। এ সংসারে বৌদির গঞ্জনা শোনার থেকে নাকি দাদা-দিদির চক্করে মরিচঝাঁপির ডরমিটরিতে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া অনেক বেশি সুখের। পাড়ার ফচকে ছোকরারা প্রশ্ন তুললো যে “কি করে প্রমাণ করবেন যে আপনি অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী নন? আপনি তো হিন্দু, আপনাকে কেন্দ্রীয় সরকার আদর করে সাজিয়ে রাখবে এই দেশে।” “কী করে প্রমাণ করবি যে আমি হিন্দু?” — জবাবে জিজ্ঞাসাচিহ্ন জুড়ে সুগভীর উত্তর বিদগ্ধ অমল চক্রবর্তী মহাশয়ের। এ নিয়ে আলোচনা বেঁকা দিকে নিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু গুরুজনের সামনে সেকথা আর চটকানো শ্রেয় মনে করল না যুবকবৃন্দ। তবে তাদের মনেও এই প্রশ্ন একটু খোঁচা দিয়েই গেলো যে ঠিক কি করে প্রমাণ করা যাবে যে আমি হিন্দু? হাতে মুঠোফোন থাকতে অসুবিধে কম। গুগলকে জিগ্যেস করা হল। সেখানে কিন্তু উত্তর অস্পষ্ট। চেহারা, কিংবা সাজপোশাক দেখে অনেক ধর্মের মানুষকে চটজলদি বুঝে নেওয়া যায়, কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে ব্যাপক মুশকিল। আর সবথেকে বড় মুশকিল হিন্দু বাঙালির ক্ষেত্রে। বাংলার মাটি চিরকালই দুর্বল, আর তাই যে যার মত ভোগ করেছে এই কোমল মানচিত্র। জাতি, ধর্ম, আচার সব কিছু মিশে আছে এই বাংলায়। তাই তো চিনে থেকে তামিল, সাহেব থেকে আফ্রিকান, সব রকম আকার কিংবা গায়ের রঙই খুঁজে পাবেন হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে, পাবেন সবরকমের হাবভাব।

অনেকক্ষণ কথা বললে হয়ত বুঝতে পারবেন মেদিনীপুর না নদিয়া, কিন্তু চটজলদি দশকোটি মানুষের সারিতে হিন্দু প্রমাণ করতে গিয়ে মুশকিল হবে অনেকটাই। একটু সুবিধে আছে। দেশের রাজা-মন্ত্রীরা আবার জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু হিন্দু নয়, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অন্যান্য ধর্মের মানুষদেরও শরণার্থীর তকমা দেওয়া হবে। নিজেকে খ্রিস্টান প্রমাণ করা তুলনায় সহজ। গলায় স্টিলের যোগচিহ্ন ঝুলিয়ে নিয়ে “যীশু পরম দয়ালু” পাঠ করলে হয়ত বেঁচে যাওয়া যাবে। লাজুক বাঙালি দিগম্বর জৈন হওয়ারও চেষ্টা করতে পারে। সেক্ষেত্রে মুখটুকু ঢেকে রাখলেই নিশ্চিন্ত। অর্থাৎ শরণার্থী সাজার সুযোগ আছে। আর যে ধর্ম নিয়ে কিছু না বলেও অনেক কথা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে সে আলোচনা বাড়িয়ে লাভ নেই। কারণ বাঙালি এখন প্রাথমিকভাবে হিন্দু হওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।

তাই পুজো প্যান্ডেলে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অভয় নিয়ে আপাতত দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠাই মঙ্গল। একটু মনে রাখবেন যে এনআরসির গল্প শুরু আসাম নিয়ে, রাজীব গান্ধীর আমলে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে সরাসরি দায়ী করা শক্ত। তৃণমূল নেত্রী বিজেপির সঙ্গে থাকার সময় বেশ জোর দিয়ে দাবি তুলেছিলেন অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর। এখন মত এবং পথ বদলেছে। আর বিজেপি সরাসরি বলে দিয়েছে তারা শরণার্থীদের জায়গা দেবে আর অনুপ্রবেশকারীদের ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে দেবে। যতদিন তারা ক্ষমতায় থাকবে তারাই খাতার মাঝখানে উল্লম্ব সরলরেখা এঁকে ঠিক করবে অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীর পার্থক্য। আম বাঙালির থাকবে শুধু হয়রানি, সময় কাটবে বিভিন্ন পরিচয়পত্র জোগাড় করার লম্বা লাইনে। নিম্নবিত্তদের পকেট থেকে খসবে প্রভাবশালীদের তুষ্ট করার দায়ে একগাদা টাকা। পাড়ার দাদারা ভোটের বিনিময়ে আমাদের অভয় দেবেন। আপাতত দুর্গাপুজোর কদিন বাংলার সংবাদমাধ্যম তিন অক্ষর ভুলবে। বোধনের আগেই পুজো উদ্বোধনের খবর এখন অনেক বেশি দামী। বিজেপি আর তৃণমূলের নেতানেত্রীরা কি বুঝছেন যে বাঙালি হিন্দুর সনাতন ধর্মাচরণে ষষ্ঠীতেই বোধন? তার আগে মায়ের মুখ থেকে জোর করে আবরণ খুলে ফেলছেন যারা, তাদের কি হিন্দুধর্মের পাসপোর্ট আছে?

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

amit shah nrc Citizenship Bill West Bengal
Advertisment