চিকিৎসকদের পেশাগত অঙ্গীকার মানুষের জীবন বাঁচানো। সব চিকিৎসকই চান, রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। তবু জীবন-মৃত্য়ুর অনিবার্যতার মধ্য়েও অনিবার্যতার মধ্য়েও চিকিৎসকদের নিগ্রহ আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যে গাছ আমাদের বাঁচায়, তাকে আমরা নির্মূল করে দিই - যে চিকিৎসক আমাদের বাঁচানোর চেষ্টায় ব্রতী, তাঁকে নৃশংসভাবে আক্রমণ করি। কোনদিকে আমরা এগোচ্ছি? রোগী পরিবারকে বুঝতেই হবে, চিকিৎসকদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও রোগীর মৃত্য়ু হতে পারে- ব্য়াথাতুর শোকার্ত প্রিয়জনকে তা স্বীকার করে নিতেই হবে। তার পরিবর্তে, হিংস্র আক্রমণ চিকিৎসকদের উপর শুধু অন্য়ায় নয়, নৃশংস নিষ্ঠুর কাজ। এর অর্থ এই নয় যে চিকিৎসায় গাফিলতি হয় না বা তার জন্য় মৃত্য়ু ঘটে না। সে ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি রয়েছে বিচার পাওয়ার। তার বদলে কিছু লোকজন জড়ো করে কুৎসিত বাহুবলের সাহায্য়ে কর্তব্য়রত অসহায় চিকিৎসকদের উপর আক্রমণ এক চরম গুণ্ডাতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, ২০১৯
চিকিৎসকরা আন্দোলনে, ফলে স্তব্ধ গোটা পরিষেবা। ৪ দিন বাদে সরকারি নীরবতা ভঙ্গ হয়, মুখ্য়মন্ত্রী এসএসকেএমে বক্তব্য় রাখেন। রোগীর পরিবারের সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের সংঘর্ষও হয়। মুখ্য়মন্ত্রীর বক্তব্য় অবস্থাকে আরও ঘোরালো করে তোলে। গণ ইস্তফার সংবাদ সারা পশ্চিমবাংলার সরকারি হাসপাতাল থেকে আসতে শুরু করেছে। সর্বশেষ সংবাদ, নবান্নে গিয়ে কয়েকজন প্রতিনিধিকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাঁরা তা প্রত্য়াখ্য়ান করেছেন। মুখ্য়মন্ত্রী তথা স্বাস্থ্য়মন্ত্রীকে এনআরএস হাসপাতালে গিয়ে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার দাবি জানানো হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য়ি, নিগ্রহের ঘটনার পরের দিনই এ রাজ্য়ের সাংবিধানিক প্রধানের হস্তক্ষেপ হয়ত এতদূর পর্যন্ত বিষয়টিকে এগোতে দিত না। উল্টে চারদিন বাদে তাঁর মন্তব্য়গুলো আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে।
আরও পড়ুন, মিছিল থেকে, চিকিৎসকের চোখে
তিনি বলেছেন, একটি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত দু বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসকরা আক্রান্ত। ভাঙচুর থামানোর জন্য় সরকারকে কঠোর আইন পর্যন্ত বানাতে হয়েছিল। তাতেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
ডাক্তাররা পরিষেবা দিতে বাধ্য়। কিন্তু প্রশ্ন হল- কোন পরিবেশে! নিরাপদ, কাজের ন্য়ূনতম সুষ্ঠু পরিবেশ ছাড়া তা কী করে সম্ভব! আতঙ্কগ্রস্ত থেকে, ভয়ের পরিবেশে না হয় সুচিকিৎসা, না হয় মন থেকে কাজ করার স্পৃহা। যথাযথ, নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার দায় কার! অবশ্য়ই সরকারের। সরকার এ ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ব্য়র্থ।
আরও পড়ুন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে
পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে এ কথা আমরা জানি। যথেষ্ট? কেউ জানে না, কী ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। ঘটনা যত পুরনো হবে, তত মামলার হালহকিকৎ, শেষমেশ সাজা হল কি না- এসব তলিয়ে যাবে অন্য়ান্য় বড় বড় ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে।
শুধু পুলিশি পদক্ষেপ কী যথেষ্ট- এ প্রশ্নও উঠেছে। একটা করে ঘটনা ঘটবে, ডাক্তাররা হৈচৈ করবেন, কিছুজন গ্রেফতার হবে- ব্য়াস। আবার পরিষেবা চলতে থাকবে ঠিকঠাক যতদিন না আরেকটা ঘটনা ঘটে। পরিষেবা-নিগ্রহ-পরিষেবা-নিগ্রহ এটাই স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহ হয়ে উঠবে। ভবিষ্য়তে এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে (বা অন্ততপক্ষে শুরুতেই ঠেকানো যায় মারমুখী লোকদের) তার জন্য় কোনও পরিকল্পনা বা নীল নকশা মুখ্য়মন্ত্রী বললেন না। পরিবর্তে, কুখ্য়াত দানবীয় এসমা জারির হুমকি দিলেন। চিকিৎসকরা ভয় না-পেয়ে গণইস্তফার মাধ্য়মে অভিনব প্রতিবাদ শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন, চিকিৎসায় কর্মবিরতি, মানুষের হয়রানি- কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ
তিনি আরও তিনটি তত্ত্ব হাজির করেছেন। তার মধ্য়ে একটি অশ্রুতপূর্ব। এ বঙ্গের চিকিৎসকরা নাকি পদবী দেখে চিকিৎসা করেন, তাঁর সঙ্গে মজুত নানা মাঝি-মল্লার-সেনপদবীধারী কিন্তু এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেন না। শপথ এই পেশায় আগত সমস্ত মানুষকে শেখায় - মানুষের জীবন বাঁচাতে। জাতপাত, সম্প্রদায় বিচার করে মানুষের জীবন বাঁচানো মহাপাতকের কাজ। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ করে নিজেকেই কলঙ্কিত করলেন তিনি। অন্য়দিকে মুকুল রায়ের তত্ত্বও সমভাবে নিন্দাযোগ্য়।
দ্বিতীয় তত্ত্বায়ন বহিরাগত নিয়ে। যে কোনও ন্য়ায়সঙ্গত আন্দোলনের বৈধতাকে, জনগ্রাহ্যতাকে সরকার চেষ্টা করে ষড়যন্ত্র, বহিরাগত ইত্য়াদি তকমা দিয়ে বদনাম করতে। মুখ্য়মন্ত্রী ভাঙড় আন্দোনের সময়ে এ কৌশল নিয়েছেন। হাইকোর্ট বলেছিল, সংবিধানে এরকম কোনও ধারণা নেই। যে কোনও ভারতীয় নাগরিকের ভারতের যেখানে ইচ্ছা যাওয়ার অধিকার রয়েছে, যে কোনও জায়গাতে মিটিং-মিছিল করার অধিকার রয়েছে। শিলচরে গেলে বহিরাগত হয় না, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ালে বহিরাগত হয় না, সল্টলেক থেকে শিয়ালদহ গেলে বহিরাগত! আন্দোলন ঠিক করবে কে তাঁদের হয়ে বক্তব্য় রাখবেন, তেমনই চিকিৎসকরা ঠিক করবেন কোন আন্দোলনকে তাঁরা সমর্থন, সংহতি জানাবেন। সরকারের হস্তক্ষেপের কোনও এক্তিয়ার তাতে নেই।
আরও পড়ুন, কেন হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রাখতেই হল?
২৫ লক্ষ টাকা খরচের পর ডাক্তার বিদেশ চলে যায়। পুরনো যুক্তি। পরিষেবা দেওয়ার কারণে, চিকিৎসাবিদ্য়ার উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের কারণে যে কেউই তেমন যেতে পারেন। আবার পাশাপাশি বহু ডাক্তার আজও গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে মানুষের পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন - তা অস্বীকার করা যায় না। আর এটা যদি অন্য়ায় হয়, তাহলে শাসক পার্টির পতাকা ধরে কোটি কোটি টাকা তোলাবাজি করে মানুষকে কী পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে! তা কি অপরাধ নয়!
মুখ্য়মন্ত্রীর বোধোদয় হোক। চিকিৎসকরা নিগ্রহেক হাত থেকে চিরতরে রেহাই পান। হাসপাতাল চালু হোক। পরিষেবা পান মানুষেরা।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক। মতামত ব্য়ক্তিগত।)